পাকিস্তানে ভোট শেষ, গণনা শেষ হয়েও শেষ নয়। ৪০টার মতো কেন্দ্রে নাকি আবার নির্বাচন হবে। জনগণনা হয়নি বহুদিন, তবুও হিসেব বলছে ২৪ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তান যেখানে রেজিস্টার্ড ভোটার ১৩ কোটি, তাঁদের ন্যাশন্যাল অ্যাসেম্বলির জন্য ৩৪২ জন প্রতিনিধিকে নির্বাচন করেছেন, কিন্তু আপাতত হিসেব মিলছে ৩০২ জনের। ইমরান খানকে ব্যাট হাতে নির্বাচনে নামতেই দেওয়া হয়নি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন ইমরান খান এখন জেলে, কয়েদি নম্বর ৮০৪। তিনি জেল থেকে প্রচার চালিয়েছেন বটে কিন্তু আদালতের রায়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি এবং তাঁর অনুগামীরা নির্দল। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা গেছে, তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু পাক আইন অনুযায়ী তাঁরা ক্ষমতা দাবি করতে পারবেন না। কিন্তু তাঁদের নেতা জেল থেকেই বিজয় ভাষণ দিয়েছেন, ইতিমধ্যেই তা ভাইরাল। কী করে জেলে থাকা ৮০৪ নম্বর কয়েদির ভাষণ রেকর্ড হল? তার মানে সেনাবাহিনী বা প্রশাসনের কিছু লোকজন নিশ্চয়ই ইমরান খানের সঙ্গে আছেন। আরেকজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন বহু আগেই, ফিরে এসেছেন, নির্বাচনে লড়েছেন, আপাতত দল হিসেবে তিনিই এগিয়ে। অন্যদিকে জুলফিকার আলি ভুট্টোর নাতি, বেনজির ভুট্টোর পুত্র বিলাওল ভুট্টোও মাঠে আছেন, দলগত হিসেবে তিনি দু’ নম্বরে। কিন্তু দেশের মানুষ জানেন, যেই আসুক চাবিকাঠি থাকবে সামরিক কর্তাদের হাতে, ইতিমধ্যেই তাঁরা তাঁদের প্রেফারেন্স জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা বিলাওল এবং শরিফের যৌথ সরকার চান, তা মেনেই দু’ দল প্রাথমিক কথাবার্তাও সেরে নিয়েছে। সরকার যত দুর্বল হবে সামরিক কর্তাদের লুঠতরাজ তত সহজ হবে। সেনাবাহিনীর হাতে, যিনি জিতলেন বা যাঁরা হারলেন তাঁদের টিকি বাঁধা।
ওদিকে প্রাদেশিক সভার নির্বাচনেও একেক জায়গায় একেক রকমের ছবি। ইমরান খানের সমর্থকরা খাইবার পাখতুনখোয়া প্রাদেশিক সরকারে বিরাটভাবেই এগিয়ে। ওদিকে পঞ্জাব প্রাদেশিক সভাতে ইমরান খান এবং নওয়াজ শরিফের দল প্রায় সমানে সমানে, বালোচিস্তান প্রাদেশিক সভাতে কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারে কাছেও নেই, আবার সিন্ধ প্রাদেশিক সভাতে বিলাওল ভুট্টোর জয়জয়কার। অর্থাৎ একেক অঞ্চল একেক নেতার দখলে, এবং গোটা দেশের দখল নিয়েছে সেনাবাহিনী। অর্থনীতির কথা না বলাই ভালো, মানুষের মানে ওই আম আদমির আয় সমানে কমছে, মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া, দেশের জিডিপি ক্রমাগত পড়ছে আর কিছু শিল্পপতি। কিছু বড় বড় জমির মালিকের মুনাফা আকাশছোঁয়া, দেশের বৌদ্ধিক দখল তো কবেই নিয়েছে কাঠ মোল্লারা। সে ইমরান খানই হোক আর বিলাওল ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ হন বা অন্য কোনও নেতা, প্রত্যেকে ওই কাঠ মোল্লাদের নির্দেশ মানতে বাধ্য। সেনা কর্তারাও মোল্লাতন্ত্রের নির্দেশের বাইরে যেতে চান না আর মোল্লাতন্ত্র তাদের ধর্মীয় রাজনৈতিক নির্দেশ পালনের বিনিময়ে এইসব রাজনৈতিক নেতা বা সেনা কর্তাদের লুঠমারের ছাড়পত্র দিয়েছে। কিন্তু এরকম ছিল নাকি পাকিস্তান? ১৯৪৭-এ আমাদের একদিন আগে যে দেশ স্বাধীনতার পতাকা তুলল, ধর্মকে ভিত্তি করেই পথচলা শুরু করল তা কি প্রথম দিন থেকেই এরকমই ছিল?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নরেন্দ্র মোদি নিজেই জানালেন বিজেপি ৩৭০-এর বেশি আসন পাবে, পাবে কি?
না। ছিল না। ছিল না কারণ জিন্না মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ চেয়েছিলেন, ধর্মকে কাজে লাগিয়েছিলেন কিন্তু নিজে যথেষ্ট ধার্মিকও ছিলেন না। মুসলমান ধর্মে ঘোষিত হারাম মাংস খেতে তাঁর আপত্তি তো ছিলই না বরং তিনি নাকি তা ভারি পছন্দও করতেন। না, তাঁকে নুর বা ফেজ মাথায় দেখা যায়নি কোনও দিন। এবং সে সময়ের পাকিস্তান কেমন ছিল? পুরনো এক অ্যামাজিং পাকিস্তানের বিজ্ঞাপন নেটেই পাওয়া যাবে যেখানে পাকিস্তানের সমুদ্র বেলাভূমিতে বিকিনি পরা বিদেশিরা চান করছে। পাকিস্তানের বাজার, দফতরে মহিলাদের সংখ্যা দেখার মতো এবং বোরখা বা হিজাবের চিহ্নমাত্র নেই। ওই বিজ্ঞাপনেই বৌদ্ধ ধর্মের কথা আছে, তক্ষশীলার মূর্তি আছে। ছিল তো সেসব, গেল কোথায়? কেমন করে গেল? ৪৭-এ স্বাধীনতার সময় কায়েদে আজম জিন্নার বক্তৃতা, তিনি বলছেন পাকিস্তানে ভেদভাব থাকবে না, সমস্ত গোষ্ঠীর মানুষ, সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে থাকবে। মজার কথা হল পাকিস্তানের জিডিপি এক সময়ে আমাদের চেয়ে বেশি ছিল, ইউরোপের পত্রিকাতে পাকিস্তানকে ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং স্টেট বলা হচ্ছিল। ৬০–৬৫ সালে পাকিস্তানের জিডিপি বাড়ছিল ৪.৮ শতাংশ হারে আর আমাদের ৩ শতাংশ হারে। দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তানকে এশিয়ান রোল মডেলের তকমা পরানো হচ্ছিল। ৫১তে জিন্না মারা যাওয়ার পরে আয়ুব খান দায়িত্ব নিলেন। ল্যান্ড রিফর্মের প্রাথমিক কাজ শুরু হল, গ্রিন রেভেলিউশনের কথা শোনা গেল। আমাদের দেশ তখন জোট নিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলছে। নেতৃত্ব দিচ্ছেন নেহরু, নাসের, টিটো আর সেই সময়ে আয়ুব খান পাকিস্তানের হাত ধরলেন। ৬৩তে ৭০-৮০ বিলিয়ন ডলার ঋণ এল সেখান থেকে। ১৯৬১তে মুসলিম ফ্যামিলি ল পাশ করানো হল, মানে শরিয়ত নয়, দেশের আইন মেনেই ইসলামিক ফ্যামিলি ল তৈরি হল। কেবল তাই নয়, কাঠমোল্লাদের বিরুদ্ধে গিয়েই সেই ১৯৬১তে ফ্যামিলি প্ল্যানিং আইন লাগু করা হল।
তখনও পাকিস্তানে বোরখা হিজাব ছিল না, মিনিস্কার্ট ছিল। কিন্তু ধর্ম নিয়ে সক্রিয় হল বিরোধীরা, পেছনে কাঠমোল্লারা, এর মধ্যে খাদ্যের দাম বাড়ছে এই পপুলার স্লোগান নিয়ে দেশ অশান্ত। আয়ুব খান পদত্যাগ করলেন ১৯৬৯-এ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম নির্বাচন হল ১৯৭০-এ। পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামি লিগ পেল ১৬৭ আর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেল মাত্র ৮৬টা আসন। ব্যস, পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট, বড় জমির মালিকেরা বা মোল্লারা পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে থাকার এই রায়কে এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন। উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করা নিয়ে, আর্থিক বৈষম্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামি লিগের কাছে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়া রাস্তাও ছিল না। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করলেন, তাঁর নেতৃত্বেই বাঙালি নিধন শুরু। ক্রমশ পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের এই লড়াইয়ের মধ্যেই চলে এল ভারত। পাকিস্তান দু’ টুকরো হল, স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নিল। ইয়াহিয়া সরে গেলেন ভুট্টো এলেন ক্ষমতায়। কিন্তু সেনাবাহিনীর হাতে মূল ক্ষমতা থেকেই গেল, কাঠ মোল্লারা আরও সক্রিয় ভূমিকাতে এল। গোটা দেশের পড়াশুনো, সিনেমা, সামাজিক জীবনে ধর্ম, শরিয়ত হয়ে উঠল মূল ভরকেন্দ্র। যারা আমাদেরও আগে অ্যাটমিক শক্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিল তারা অ্যাটম বোম তো ফাটাল কিন্তু তার সবটাই ছিল এক মোল্লাতন্ত্রের জেহাদ। সমাজ জীবনে নারীরা পিছিয়ে গেল, চলে গেল বোরখা হিজাবের আড়ালে।
পাকিস্তান সেই থেকেই পিছনের দিকে হাঁটছে, গ্ল্যামার বয়, প্লে বয় ইমরান খানের বউ কেন বোরখায় মুখ ঢাকে না তা নিয়ে টিভির সান্ধ্য আলোচনা শুরু হল, ভাবা যায়? মধ্যে বেনজির ভুট্টো এসে রাশ হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তাঁকে মেরে ফেলা হল। আপাতত পাকিস্তান মানে গণতন্ত্রহীনতা, পাকিস্তান মানে অর্থনীতির তলানি, পাকিস্তানে জিডিপি নামছে, মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। নির্বাচন শেষ, এখন তো ছেড়েই দিন আগামী এক মাসেও ৫টা প্রাদেশিক সভা বা জাতীয় সভা নতুন করে কাজ শুরু করবে এমন আশা কারও নেই। যদি এই পতনের ইতিহাস দেখেন, যদি একটু মন দিয়ে আমাদের এই পড়শি দেশ, যারা আমাদের থেকেও এগিয়ে গিয়েছিল অর্থনীতির দিক থেকে, আমাদের চেয়েও স্বাধীন গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল ধর্মকে উপেক্ষা করেই, তার পিছিয়ে পড়ল। তার কারণগুলো খোঁজার চেষ্টা করেন তাহলে তিনটে জিনিস চোখে পড়তে বাধ্য। প্রথম হল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে, উগ্র মৌলবাদীদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়া, ধর্ম আর কাঠমোল্লারাই হয়ে উঠল নির্ণায়ক শক্তি, সেদিন থেকেই পাকিস্তান নেমেছে, ধারাবাহিকভাবেই নেমেছে। দ্বিতীয় হল গণতন্ত্রহীনতা, ভাবুন না একটা দেশ স্বাধীন হল ১৯৪৭-এ, তাদের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে ১৯৭০-এ, এবং তাও সেই নির্বাচনের রায় মেনেই নিল না পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা। গণতন্ত্রহীনতার ফলে দেশ দু’ টুকরো হল। গণতন্ত্রহীনতার ফলেই গোটা পাকিস্তান আজ কিছু কুলাক, কিছু মোল্লা আর কিছু সামরিক কর্তাদের হাতে চলে গেছে। আর তিন নম্বর কারণ হল দেশের সংবাদমাধ্যম, শিক্ষিত মানুষজনের হয় ভয় পেয়ে না হলে কিছু পুরস্কারের বিনিময়ে চুপ করে থাকা। সেই জিয়াউল হকের জমানায় ইকবাল বানো প্রকাশ্যে স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে গেয়েছিলেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা হম দেখেঙ্গে, কিন্তু সে ছিল একক আওয়াজ। তার আগে থেকেই দেশের মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত গণতান্ত্রিক মানুষজন চুপ করে গেছেন, ফল হাতেনাতে। এক প্রকাণ্ড গাড্ডায় পড়ে আছে পাকিস্তান, মাথার ওপর ঋণ, দেশ চালাচ্ছে সামরিক কর্তারা আর কাঠমোল্লাদের নির্দেশে চলছে সমাজ। যে উগ্রপন্থার জন্ম দিয়েছিল এই ইসলামিক মৌলবাদ তা আজ দেশের সর্বনাশের কারণ। আজ যখন আমাদের দেশের অগ্রগতির কথা চর্চা হচ্ছে বিশ্বের বহু পত্রপত্রিকাতে, যখন কাগজে কলমে এক অর্থনৈতিক অগ্রগতির হিসেব দেখানো হচ্ছে তখন মাথায় রাখুন এক ধর্মীয় মৌলবাদের ছায়া এখন প্রবল থেকে প্রবলতর। চেয়ে দেখুন গণতন্ত্রহীনতার উদাহরণ সর্বত্র, এতটুকু প্রতিবাদ সহ্য করছে না এই সরকার এবং দেশের বুদ্ধিজীবী, দেশের সংবাদমাধ্যমে এর কোনও প্রতিবাদ নেই। যা যা ঘটেছিল পাকিস্তানে আজ আমাদের দেশে সেটাই ঘটছে। পাকিস্তান পিছিয়েছে, আমরা কোন দিকে চলেছি?