দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ব্রিটিশদের অনুগত খয়ের খাঁ আরএসএস, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি সংগঠনের তো কোনও লুকনোর ইচ্ছেই ছিল না। তাঁরা তো সাফ বলেইছিলেন এই সংবিধান তাঁরা মানেন না, এই জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সঙ্গীতকে তাঁরা মানেন না। এসব নিয়ে তাঁদের কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না কোনওদিন। তাঁদের পত্রিকা অর্গানাইজারে, তাঁদের গুরুজিদের, কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার, মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকর বা বিনায়ক দামোদর সাভারকর ইত্যাদিদের লেখায় সেসব রত্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বহুবার বহু জায়গায় এই চতুর্থ স্তম্ভেই তার উল্লেখ আমরা করেছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাঁরা ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়েছেন, প্রভিন্সিয়াল গভর্নমেন্ট তৈরি করেছেন মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। দ্বিজাতি তত্ত্বের সূচনাও তাঁদের হাতেই হয়েছিল, যার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল দেশের বিভাজন। তাঁরা রাষ্ট্রপিতাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছেন এক দীর্ঘ সময় ধরে, তাঁরাই শেষ পর্যন্ত গান্ধীজিকে হত্যাও করেছেন, তাঁরা সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত কোনওটাকেই মেনে নেননি। স্বাধীনতার পরে রাজ্যে রাজ্যে দাঙ্গা ছড়ানোর কাজ করেছেন, হিন্দু রাষ্ট্রের অবতারণা কেবল নয় হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন রোজ। সেই তাঁরাই অপেক্ষায় ছিলেন কবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন, কংগ্রেসের দুর্নীতি, আদর্শহীনতা আর বাম কমিউনিস্টদের অপদার্থতার সুযোগ নিয়ে তারা সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন এবং যতদিন সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁদের ছিল না, তখন এক ধরনের শাসন প্রক্রিয়া নিয়ে চলেছেন, এক ধরনের কথা বলেছেন বা বলেননি। কিন্তু যেইমাত্র নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এসেছে সেই তখন থেকে দেশের যে যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দেশকে স্বাধীন করতে নেমেছিলেন, যে যে আদর্শের ভিত্তিতে দেশ গঠন শুরু হয়েছিল সেই ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, এক বহুস্বরের আবহ, তার প্রত্যেকটাকে পদদলিত করে, ধ্বংস করে এক হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে চলেছেন সেই তাঁরাই। গোটা দেশের প্রত্যেক সংখ্যালঘু মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, মানুষের প্রত্যেক গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, মানুষ কী খাবে, কী পরবে তা ঠিক করছে কতগুলো উন্মাদ। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রত্যেকটা ধারণাকে আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলা হয়েছে, বিরোধিতাকে স্তব্ধ করার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে এই সরকার, প্রতিটা অনুষঙ্গে আনা হয়েছে এক মধ্যযুগীয় ধারণাকে।
সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই এবারে আনা হল দণ্ডসংহিতা। তিনটে বিল আনা হল আমাদের ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের পরিবর্তে, কেবল আনাই হল না, বিরোধী শূন্য লোকসভা, রাজ্যসভায় তা পাশও হয়ে গেল। এমনিতে বিজেপি আরএসএস যাবতীয় কিছুর রাস্তাঘাট, সরকারি প্রকল্প, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম, স্টেশনের নাম সবই পাল্টাচ্ছেন, রোজ পাল্টাচ্ছেন। এখন ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের বদলে মনুসংহিতার মতো শোনাচ্ছে এমন একটা নাম দিয়ে পরিবর্তন করলেও তেমন কিছু বলার থাকত না। কিন্তু এই তিনটে বিল এনে আমাদের দেশকে এক পুলিশি রাষ্ট্র তৈরি করার প্রথম পদক্ষেপ নিয়ে ফেলল মোদি–শাহের সরকার। এই বিল নিয়ে আলোচনা হল না, বিরোধীরা সংসদের বাইরে সিঁড়িতে বসে আছেন, তাঁরা এই গোটা শীতকালীন অধিবেশন থেকে বহিষ্কৃত, কিন্তু তিন তিনখানা দানবীয় বিল বিনা আলোচনাতেই পাশ হয়ে গেল। যে বিলের সাহায্যে যে কোনও বিরোধিতাকে স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে, যে বিলের সাহায্যে দেশ হয়ে উঠবে এক পুলিশি রাষ্ট্র। আসুন দেখা যাক কী কী আছে সেই বিলে। আগে সন্ত্রাসবাদ বা টেররিজম-এর জন্য কিছু আলাদা আইন ছিল, সেই নির্দিষ্ট আইনেই সেই অপরাধের বিচার হত, এখন তা আনা হল সাধারণ আইনের আওতায়, এবং সংগঠিত অপরাধের ব্যাখ্যাও পাল্টে দেওয়া হল। মানে দু’ তিন জন মিলে একটা অপরাধ করেছে, কাউকে পিটিয়েছে, কোথাও ভাঙচুর করেছে, এখন ইচ্ছে হলে ব্যাখ্যা অনুযায়ী সেটাকেও সংগঠিত অপরাধ ও ষড়যন্ত্র বলে চালানো যাবে, সেই মামলায় একের পর এক মানুষকে জুড়ে দেওয়া যাবে, নতুন করে চার্জশিট আনা যাবে। এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা কথাটা তুলে দিয়ে দেশদ্রোহিতা কথাটাকে চালু করা হল এবং এই আইনের আওতায় সেই দেশদ্রোহিতার এক বিরাট ব্যাখ্যা দেওয়া হল যাতে এমনকী সরকারের বিরোধিতাকে, সরকারের মাথায় বসে থাকা মানুষদের বিরোধিতাকেও দেশদ্রোহিতা হিসেবেই যাতে চিহ্নিত হয় তার ব্যবস্থা করা হল। এতদিন রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনে সশস্ত্র উপায়ে রাষ্ট্রকে উৎখাত করার কথা বলা হলে সেই আইনে তাকে গ্রেফতার করা হত, এ আইন ছিল ব্রিটিশদের, সেই আইন চালু ছিল এতকাল, বার বার দাবি তোলা হয়েছিল এই আইন বাতিল করা হোক। কংগ্রেস সরকার তা করেনি, বিভিন্ন রাজ্যের সরকার এই আইন প্রয়োগ করেছে, বাম থেকে ডান প্রত্যেকেই করেছে। আজ সেই আইনের বদলে যা আনা হল তা আরও মারাত্মক। আগে এই আইন প্রয়োগের অধিকার ছিল উচ্চপদে আসীন পুলিশ কর্তাদের, সেই গ্রেফতারির পর তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এনে ওই আইন বলবৎ করার ব্যাখ্যা দিতে হত এখন থানার ইন্সপেক্টরও এই আইনের ধারায় আপনাকে গ্রেফতার করতেই পারবে। আমাদের ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, কিন্তু সে ক্ষেত্রে বার বার বলা হত রেয়ারেস্ট অফ দ্য রেয়ার। মানে এমন অপরাধ যা শুধু জঘন্যই নয় তার উদাহরণও বেশি নেই, এমন সব ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে। তারপরেও বিভিন্ন মহল থেকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি বাতিল করার দাবি উঠেছে, দুনিয়ার প্রায় সমস্ত সভ্য দেশ থেকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি তুলে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই আইনে নতুন করে আরও বহু ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির ব্যবস্থা করা হল। এর আগে আপনাকে গ্রেফতার করার পরেই আপনার হ্যান্ড রাইটিং, গলার স্বর বা আঙুলের ছাপ নেওয়া যেত, এখন সেসব না করেই এগুলো আইনি মতেই নেওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: ইন্ডিয়া জোটের চার নম্বর বৈঠকে আদতে কি এক অশ্বডিম্ব প্রসব হল?
মানে বলা নেই কওয়া নেই একজন পুলিশ অফিসার এসে আপনার হাতের লেখা, আপনার আঙুলের ছাপ বা আপনার গলার স্বরের স্যাম্পল নিতে পারবে। আপনাদের অনেকের মনে আছে নকশাল নেতা আজিজুল হককে বাম জমানায় হাতকড়া দিয়ে বেঁধে সেই সমেত হাসপাতালে ভর্তি করে রাখা হয়েছিল। সেই ছবি এক দৈনিক পত্রিকায় ছাপানোর পরে ছিছিক্কার পড়ে যায়, সরকার বাধ্য হয় হাতকড়া খুলে নিতে। অভিযুক্ত হলেই তাকে বা সন্দেহের বশে কাউকে ধরা হলে তাকে হাতকড়া পরানোর অধিকার এতদিন ছিল না, নতুন আইনে আপনাকে এমনকী সামান্য অভিযোগের ক্ষেত্রেও ঘর থেকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার সময়ে হাতকড়া বেঁধে নিয়ে যেতে পারে তার ব্যবস্থা এই আইনে আছে। আপনি থানাতে গিয়ে সাধারণ কোনও অপরাধের কথা বললে থানা একটা ডায়রি নেয়, কিন্তু যদি রক্তপাত হয়, হতাহতের খবর হয়, অপরাধ বড়সড় হয় তখন পুলিশ এফআইআর নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই নয়া কানুনে পুলিশ যদি মনে করে এই অপরাধের জন্য ৭ বছর বা তার বেশি সাজা হবে, হতে পারে, তাহলেই একমাত্র এফআইআর নেবে না হলে ওই ডায়রি। অর্থাৎ পুলিশের নিজের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া হল এখন পর্যন্ত যা ব্যবস্থা ছিল তাতে পুলিশ একজন অপরাধীকে তাদের হেফাজতে নেওয়ার কথা বলত, আদালত সায় দিলে তার পুলিশি হেফাজত হত। সেই সময় পার হলে আর পুলিশি হেফাজতের আবেদনে বিচারক সায় না দিলে তাকে জেল হেফাজতে পাঠানো হত। এখন ৬০-৯০ দিনের জেল হেফাজতে থাকা কয়েদিকে যে কোনও সময় আবার পুলিশি হেফাজতে আনার ব্যবস্থা করা হল। অনেক সময়েই এই ইডি মামলা নিয়ে একটা কথা শোনা যায় এবং সেটা সত্যিও বটে যে এই ইডি মনি লন্ডারিং মামলাতে যে অভিযোগ আনা হয় তা যে ঠিক নয় তা প্রমাণ করতে হয় তাকেই যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে। ইডি-র এই আইন ছিল ব্যতিক্রম এখন দেশদ্রোহিতার আইনেও এই ব্যবস্থা হল, বলা হবে আপনি দেশদ্রোহী এবার আপনাকেই প্রমাণ করতে হবে যে আপনি দেশদ্রোহী নন। তার মানে আমরা এতদিন যে শুনে এসেছি অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সেই মানুষ অভিযুক্ত হতেই পারেন অপরাধী নন, এখন থেকে একজন দেশদ্রোহে অভিযুক্ত মানুষ কিন্তু অপরাধী, তাকে নিজেকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে অপরাধী নয়। মানে সরকারের হাতে, পুলিশের হাতে, আমলাদের হাতে যে ক্ষমতা দেওয়া হল তাতে যে কোনও অভিযোগ এনে আপনাকে জেলে পচিয়ে মারা এখন বাঁয়ে হাত কা খেল, চাইলে সেই প্রতিবাদী মানুষকে ফাঁসিতেও লটকে দেওয়া যাবে। বহুকাল আগে যে সময়ে আজকের শাসকদের পিতা, পিতামহরা ইংরেজদের দালালি করছিলেন, তাঁদের উচ্ছিষ্টে লালিত পালিত হচ্ছিলেন সেই সময়ে এমন এক কালা কানুনের বিরুদ্ধে আমাদের ঠাকুর বলেছিলেন,
বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান? তুমি কি এমনি শক্তিমান?
আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমন অভিমান–
চিরদিন টানবে পিছে, চিরদিন রাখবে নীচে—
এত বল নাই রে তোমার, সবে না সেই টান॥
শাসনে যতই ঘেরো আছে বল দুর্বলেরও,
হও-না যতই বড়ো আছেন ভগবান।
আমাদের শক্তি মেরে তোরাও বাঁচবি নে রে,
বোঝা তোর ভারী হলেই ডুববে তরীখান।
বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান ? তুমি কি এমনি শক্তিমান?