হীরক রাজা বুদ্ধিমান করো সবে তার জয়গান’
অনাহারে নাহি খেদ বেশি খেলে বাড়ে মেদ,
ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেওয়া চাই
লেখাপড়া করে যেই অনাহারে মরে সেই
জানার কোনও শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই
বিদ্যালাভে লোকসান, নাই অর্থ, নাই মান
হীরক রাজা বুদ্ধিমান করো সবে তার জয়গান’
মগজ ধোলাই যন্ত্র, মনে আছে সব্বার, আজ আমাদের দেশজুড়ে সেই জয়গান চলছে, সর্বত্র, কে করছে জয়গান? কেন রাজা নিজেই, তিনি ঢেঁড়া পেটানোর লোকজন জোগাড় করেছেন, ভাড়ায় এনেছেন, রাজকোষ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ পয়সা দেওয়া হচ্ছে, সেই পয়সায় পুষ্ট সংবাদমাধ্যম জয়গান করেই চলেছে, নন স্টপ জয়গান, টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন। গত কয়েক বছরে বিজেপি ২৫০০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন করেছে, আর করবে নাই বা কেন? লাগে টাকা দেবে তো গৌরি সেনেরা, না দিলে দরজায় ইডি কড়া নাড়বে। কিন্তু সেটাই তো শেষ নয়, সরকারও লাগাতার খরচ করেই চলেছে।
মোদিজি ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৪ সালে, তো এক ভদ্রলোক, অজিত গলগলি, মুম্বইতে থাকেন, রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্ট-এর সাহায্য নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ধর্মাবতার, এই মোদি সরকার ২০১৮ সাল অবধি বিজ্ঞাপন বাবদ কত টাকা খরচ করেছে? উত্তর এসেছে, ৪৩৪৩ কোটি টাকা। হ্যাঁ প্রিন্ট, ডিজিটাল আর নিউজ পেপারে এই পরিমাণ টাকা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ওই ঢেঁড়া পেটানোর জন্য সরকারি বড় বড় অনুষ্ঠানের খরচ ধরা নেই, বিজেপি দল হিসেবে যা প্রচার করছে, স্বাভাবিকভাবেই সে খরচও ধরা নেই। সেই একই অজিত গলগলি ২০১৯ সালে আবার একই প্রশ্ন করলেন, তাতে করে জানা গেল ২০১৭-২০১৯ সালে সরকার বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করেছে ৩৭৬৭ কোটি টাকা। এবারে এগিয়ে এলেন যতীন দেশাই, তিনি আরটিআই করে যা পেলেন তা হল ২০১৯ থেকে ২০২০ আর্থিক বছরে ৭১৩ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, মানে প্রতিদিন ১.৯৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বিজ্ঞাপন বাবদ। এগুলোর বাইরে আছে সরকারি অনুষ্ঠান, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপন, দলীয় কর্মসূচি ইত্যাদি। ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩–২৪-এ কেবল ছাপা হয় এমন কাগজ বা পত্রিকাতে ৯৬৭ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন ছেপেছে মোদি সরকার। শর্ত একটা, বলতে থাকো হীরকের রাজা ভগবান, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।
তো এসব কি আগে ছিল না? ছিল, নিশ্চয়ই ছিল, তবে আড়ে বহরে অনেক অনেক কম। মিডিয়া কি তেল দিত না? যাকে বলে বাটারিং? দিত। কিন্তু এমন নির্লজ্জভাবে সরকারের প্রচারে, এক এবং একমাত্র নরেন্দ্র মোদির প্রচারে, এইরকম নগ্নভাবে মিডিয়াকে নেমে পড়তে দেখা যায়নি। রিপাবলিক নামে এক বাজনদার তো সব রেকর্ড ম্লান করে দিয়েছে, সন্ধে হলেই আসুরিক গর্জনে ভরিয়ে দিচ্ছে আকাশ বাতাস। এইরকম কিছু টেলিভিশন চ্যানেল আজও, সরকারকে নয়, আজও রাহুল গান্ধী আর মনমোহন সিংহকেই প্রশ্ন করে যাচ্ছে, জবাব দো রাহুল গান্ধী, প্রতিদিন। রিপাবলিক আবার কেবল রাহুল নয়, ইন্দিরা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুরকেও প্রশ্ন করছে, জবাব চাইছে। এই তামাশা আমরা দেখছি, ডিমনিটাইজেশনের সময়ে এইরকমই এক চ্যানেলের অনুষ্ঠানে জানানো হয়েছিল, নতুন দু’ হাজার নোটে নাকি মাইক্রোচিপ আছে, জমা করে ফেলে রাখলেই বের করে নেওয়া যাবে। সিরিয়াস আলোচনা, শুনে হাসব না কাঁদব ভেবে উঠতে পারিনি। এর পাশাপাশি আরএসএস–বিজেপি জোর দিয়েছিল সিনেমায়, তারা জানে ক্রিকেট আর সিনেমা এই দুটো হল ভারতীয়দের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা, এইখানে ঘা দিতে হবে। শুরু হল সেই কাজ, তিন ধরনের সিনেমা, প্রথমটা হল ঐতিহাসিক, হিন্দু রাজা আর অত্যাচারী মুসলমান শাসকের গল্প, বুঝিয়ে দাও হিন্দুদের উপর কত অত্যাচার করা হয়েছে, তাহলে আজ উল্টোটা করার হক জন্মাবে। হিন্দুত্বকে সামনে রেখে মধ্যযুগীয় রাজারাজড়াদের নিয়ে সিনেমা উগরে দিতে থাকল মুসলমান বিদ্বেষের বিষ।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নির্বাচনের আগে মতুয়াদের নিয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি
দ্বিতীয়টা হল এক্কেবারে আরএসএস–হিন্দু মহাসভা-বিজেপির এজেন্ডা, ৪৭ থেকে দেশের কিচ্ছু হয়নি, কোনও কাজ হয়নি, উন্নয়ন হয়নি, পাকিস্তানের কাছে মাথা নত করেছে সরকার, এসবই হল কংগ্রেসের চরিত্র, গান্ধী–নেহরু মিলে সুভাষকে দেশছাড়া করেছে, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে খুন করা হয়েছে, প্যাটেল আর নেহরুর ঝগড়া ছিল, নেহরুর জন্যই কাশ্মীর সমস্যা তৈরি হয়েছে। কাশ্মীরে হিন্দু পণ্ডিতদের পাশে দাঁড়ায়নি সরকার, তাই কাশ্মীর ফাইলস তৈরি হল, তাসখন্দ ফাইলস বা গুমনামির মতো সিনেমা তৈরি হল। এক তরফা মিথ্যে, মিথ্যের পাহাড়, কিন্তু সত্যি আর মিথ্যের মিশেল দিয়ে এক ঝাঁঝালো ককটেল, যা দেখে মানুষ বুঝল, এতদিন তো দেশে কোনও সরকারই ছিল না, এই প্রথম এক জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে, যারা মুসলমানদের শবক শেখাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং তৃতীয়টা হল এই মোদি সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প আর সিদ্ধান্তের পিছনে যে কী অসীম দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদ লুকিয়ে আছে, সেটা তুলে ধরার জন্য সিনেমা, ওটিটি সিরিজ, খুল্লমখুল্লা মিথ্যে, ডাহা মিথ্যে এনে হাজির করা হচ্ছে মানুষের সামনে। সেই ওটিটি সিরিজের, দমবন্ধ করা উত্তেজনা, পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র, আর ভারতের কড়ারা জবাব।
তার একটার গল্প শুরু হচ্ছে, মূল চরিত্র বাঙালি, তিনি একাধারে ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, অন্যধারে সৈন্যবাহিনীর মেজর, পিস্তল থেকে একে ফর্টি সেভেন, হ্যান্ড কমব্যাট সবই জানেন। আল্লাই জানে এরকম সত্যিই আছে কি না, সেই চরিত্রের অভিনেতা আবার বামপন্থী পরিবারের, তাতে কী? টাকা পেলে মুখে রং মেখে নেতাজি উন্মাদ ছিলেন একথাও বলা যায়, এ তো সামান্য ব্যাপার। তো সেই চরিত্র ধরে ফেলছে রাশি রাশি জাল নোট। তারপর পেঁয়াজের খোলার মতো পাকিস্তানের চক্রান্ত বেরিয়ে আসছে। তিনি একবার ইনকাম ট্যাক্সের দফতর, পরক্ষণেই কাশ্মীর, কখন যে কোথায় আছেন বোঝার আগেই জানা গেল, আর আরডিএক্স নয়, একে ফর্টি সেভেন নয়, এবার ভারতবর্ষকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। সিরিজে আমাদের ন্যাশন্যাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার অজিত দোভাল টাইপের এক চরিত্র আছে, পিএমও-র একটু স্কেপটিক্যাল এক চরিত্র আছে, আর আছেন প্রধানমন্ত্রী। না অন্য কোনও মন্ত্রী নেই, থাকার কথাও নয়, একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, হুবহু মোদিজি, দাড়ি থেকে পোশাক এবং অসম্ভব প্রাগম্যাটিক, আগে কেউ যা করেননি, উনি তাই করছেন, এই ওটিটি সিরিজের সিজন ওয়ানে ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে, দেখানো হয়েছে, নাকি দেশের প্রথম কোভার্ট অপারেশন, সার্জিকাল স্ট্রাইক, সেখানেও তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি এই বোল্ড ডিসিশন নিচ্ছেন, জওয়ানদের স্যালুট করছেন। দ্বিতীয় এপিসোডেও তাই, স্পেশাল ফোর্সের সঙ্গে কথা বলছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন, ওদিকে পাক চক্রান্ত পৌঁছে গেছে তামিল গেরিলাদের কাছে, উত্তর পূর্বাঞ্চলের মিজো–নাগা বিদ্রোহীদের কাছে, অন্ধ্রে মাওবাদীদের কাছে, স্পেশাল ফোর্স বুঝে ফেলেছে কোটি কোটি জাল টাকা ঢুকিয়ে অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার চক্রান্ত। কিন্তু তারা অসহায়, করবেটা কী?
এই সময়ে সেই দাড়িওলা প্রধানমন্ত্রী সবাইকে চমকে দিয়ে নোটবন্দি করে দিলেন, মাস্টার স্ট্রোক, হোক না একটু অসুবিধে, নাই বা রেডি থাক এটিএম ব্যবস্থা, গোপন পাক চক্রান্তকে রুখতেই এই নোটবন্দি আনা হয়েছিল, হুঁ হুঁ বাওয়া, এটাই ছিল আসল কারণ। ওটিটি শেষ হলে এটাই মেসেজ, এটাই বক্তব্য। এটা দেখার পরে লোকে বলবে, ও তাই? ওটা ছিল পাক চক্রান্ত রুখতে এক মাস্টার স্ট্রোক, আর বিরোধীরা এই রকম প্রাজ্ঞ প্রধানমন্ত্রীকে কীই না বলেছে। আসলে সেই ৮ নভেম্বর ২০১৬-র রাতে মোদিজি নোটবন্দির ঘোষণা করেছিলেন, এক অশিক্ষিত অর্বাচীন সিদ্ধান্ত, বলেছিলেন, এর ফলে কালো টাকা হু হু করে বেরিয়ে আসবে, ভেবেওছিলেন। তারপর অবশ্য নতুন নতুন কারণ বলা শুরু হল, বলা হল উগ্রপন্থাকে আটকাতে এই নোটবন্দি, তাদের হাতে জাল ভারতীয় টাকা দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে, এই নোটবন্দি তাকে রুখবে। কিছুদিন পরে বলা হল, নোটবন্দির ফলে ডিজিটাল মানি সার্কুলেশন বাড়বে, বাজারে ক্যাশ কমবে। কিছুদিন পরে বোঝা গেল কালো টাকার সবটাই ফেরত চলে এসেছে, ৯৯.৭ শতাংশ টাকা ফেরত এসেছে, জাল নোট বছরখানেকের মধ্যেই যে জায়গায় ছিল সেই জায়গায় চলে গেল, আজও বাজারে ক্যাশ লেনদেন চলছে, একইভাবেই চলছে। এবং প্রধানমন্ত্রী চুপ, সাংবাদিক তো ছেড়েই দিন, সাংবাদিকের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে বা সাহস তাঁর নেই, তাহলে? তাহলে সিনেমা হোক, ওটিটি সিরিজ হোক, সেখান থেকেই মানুষ জানুক ৮ নভেম্বর আমাদের মোদিজি আসলে এক মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছিলেন, আমরা নাদান, অর্থনীতিবিদরা শিশু, তার পর থেকে লাগাতার নামতে থাকা জিডিপি, পার ক্যাপিটা ইনকামও আসলে ওই মাস্টার স্ট্রোকেরই অঙ্গ।
সাধারণ মানুষের বয়েই গেছে অর্থনীতিবিদদের কচকচানি শুনতে, দিনান্তের পরিশ্রমের পরে পর্দায় সিনেমা বা টেলিভিশনে ওটিটি চ্যানেল খুলবেন, দেখবেন দেশে এক মহামানবের জন্ম হয়েছে, তিনি যা করছেন সব ঠিক, যা করছেন সবই দেশের জন্য, যা করছেন সবটাই মাস্টার স্ট্রোক। জয়ধ্বনি দেবেন, গুমনামি বাবা দেখে শিহরিত হবেন, দাঁড়িয়ে পড়বেন, বুঝে ফেলবেন জওহরলাল আর গান্ধী মিলে নেতাজীকে দেশে ঢুকতে দেয়নি, তিনি ঢুকে পড়লেও ওনাদের ভয়েই লুকিয়ে ছিলেন, কাশ্মীর ফাইলস দেখে রাগে গা কির কির করবে, আহারে হিন্দুদের উপর কী অত্যাচার, হিন্দু খতরে মে হ্যায়। তাসখন্দ ফাইল দেখে বুঝে ফেলবেন, ইন্দিরাকে আনার জন্য, লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে খুন করা হয়েছিল। কেরালা স্টোরি দেখে বুঝবেন কমিউনিস্ট শাসিত রাজ্যের প্রথম কাজ হল মহিলা পাচার। সাভারকর দেখে বুঝতে পারবেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজনই বীর ছিলেন, উনিই ক্ষুদিরাম থেকে ভগৎ সিং সব্বাইকে প্রেরণা জুগিয়েছেন, এমনকী নেতাজিও পরামর্শ পেয়েছেন এই মুচলেকা বীর সাভারকরের কাছ থেকে। গোধরা নামে একটা সিনেমা বেরিয়েছে, কেন শয়ে শয়ে নিরপরাধ সংখ্যালঘু মানুষজন খুন হয়েছিল তার কৈফিয়ৎ, তারাই যে আসলে এই দাঙ্গা শুরু করেছিল, সামলাতে না পেরেই জান খুইয়েছে, সেটা বোঝানো আছে, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে তথ্য দিয়ে। সিনেমা তৈরি হয়ে গেছে জেএনইউ নিয়ে, সেখানে বামেরা যে নেহাতই টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের সদস্য তা বোঝানো হয়েছে, বামপন্থা যে এক জঘন্য ব্যাপার তার বর্ণনা আছে এবং পীযূষ মিশ্রার মতো এক বামপন্থীর মুখেই বলানো হয়েছে, ওসব ম্যায় নহি মানতা, ওই যে বামপন্থা, আদর্শ, মার্ক্স, লেনিন ম্যায় নহি মানতা। একই লাইনে বেরিয়েছে, উরি, গদর, আর্টিকল ৩৭০, ম্যায় অটল হুঁ, সবরমতী রিপোর্ট, দ্য ভ্যাক্সিন ওয়ার, রাজাকার, বস্তার, গুমনামি, ক্যালকাটা কিলিংস। আমার খালি ভয় হয়, এসব দেখত দেখতে কবে হয়তো আমার সহনাগরিক চিৎকার করে, একটা হাত তুলে বলেই ফেলবেন “হেইল হিটলার।”