গাধার জল খাওয়া দেখেছেন? গাধা ডোবা বা নালার কাছে যায়, তারপর খানিকক্ষণ জলের দিকে তাকায়, তারপর প্রায় হঠাৎই জলে নেমে পড়ে, খানিক পা চালায়, জলটা ঘোলা হয়ে গেলে নিশ্চিন্তে জল খায়। অনেকেই তাই বলে যে গাধার মতো জল ঘোলা করে খেও না। এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। গাধা কেন? বেশিরভাগ পশুই এই কাজটা করে তার কারণ স্বচ্ছ জলে তাদের নিজেদের ছায়া দেখে নিজেরা ভয় পায় তাই জলটা ঘোলা করে খায়। আমাদের সরকার বা আরও ছোট করে বললে নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহের এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। আসলে যে কোনও স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। কারণ মূল বিষয় থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়াটা তাদের আসল কাজ হয়ে দাঁড়ায়। নরেন্দ্র মোদি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন কীভাবে? কোন কোন ইস্যুগুলো তখন সামনে ছিল? গুজরাতে নাকি দারুণ শিল্প গড়ে উঠছে, লাইসেন্স আজ চাইলে কাল পাওয়া যাচ্ছে, দিনে নাকি ১৮ ঘণ্টা করে কাজ করছেন রাজ্যের মন্ত্রীরা। শিল্পপতিরা জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, মিডিয়াতে কাজের মুখ্যমন্ত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে গুজরাত রায়টের কথাও রয়েছে, কিন্তু সব ছাপিয়ে তিনি কথা কম, কাজ বেশি করছেন, গুজরাত রমরম করে এগোচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেস সরকার। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ছে, সীমাহীন দুর্নীতি। উল্টোদিকে নরেন্দ্র মোদি বললেন, না খায়েঙ্গে না খানে দেঙ্গে, তখন উনি আম আদমিকেই এই কথা বলছিলেন, তা তো বোঝা যায়নি। তিনি বলছেন জিএসটি লাগু করতে দেব না, তিনি বলছেন সবকা সাথ সবকা বিকাশ, Inclusive Growth-এর কথা। তিনি বলছেন প্রধানমন্ত্রী নয়, হতে চান প্রধান সেবক।
২০১৪, একটু খুঁজে দেখুন, এসবই বলছিলেন সেই তখনকার ভাবি প্রধানমন্ত্রী। গরু মা হবে কি না, সবচেয়ে বড় স্ট্যাচু বানানো হবে কি না, রামমন্দির হবে কি না, তিন তালাক সরানো হবে কি না বা ৩৭০ ধারা তোলা হবে কি না এসব কিছুই বলেননি। অনেকে বলবেন বিজেপির ম্যানিফেস্টোতে তো এসব ছিল। আরে দূর মশাই ম্যানিফেস্টো পড়ে মানুষ ভোট দেয় নাকি? সভার পর সভা করে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি, এক জায়গাতেও বলেননি এসব কথা। বলেছেন সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, বলেছেন না খায়েঙ্গে না খানে দেঙ্গে, বলেছেন বিদেশ থেকে কালাধন নিয়ে চলে আসবেন, তার ফলে দেশের সব মানুষের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা আসবে। প্রধানমন্ত্রী হলেন ব্যস, গজনী, শর্ট টার্ম মেমোরি লস। সভায় যা বলেছিলেন ভুলে গেলেন, তারপর নতুন স্লোগান এল। মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে, ৩৭০ ধারা বাতিল, তিন তালাক আইন তুলে দেওয়া। সব মিলিয়ে আগে যা বলেছিলেন, এখন তার সবটাই ভুলে, মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে। জল ঘোলা হচ্ছে, জল ঘোলা হচ্ছে। আদানির ব্যবসা বাড়ছে, আম্বানি দেশের নয়, সারা পৃথিবীর বড়লোকদের তালিকায় চলে এসেছেন। কৃষক আত্মহত্যা করছে, শিল্প ধুঁকছে, চাকরি নেই, টাকার দাম কমছে, মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। জল ঘোলা করেই চলেছেন। এবং মিথ্যে। এত মিথ্যে বলে চলেছেন যা আগে কোনওদিন আমরা দেখিনি, শুনিনি। এরকম কোনও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না যিনি জনসভায় অম্লানবদনে ডাহা মিথ্যে কথা বলেছেন, এমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের মানুষ দেখেননি যিনি প্রতিদিনই মিথ্যেই বলে চলেছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | রাজা রামমোহন কাঁদছেন?
প্রথমে বললেন অত্যাচারিত হিন্দু শিখ পারসি খ্রিস্টান জৈন বৌদ্ধদের জন্য আইন আনা হচ্ছে। মানুষ বুঝে ফেলল যে আসলে এর সঙ্গে এনআরসি-কে জুড়ে এক দানবীয় আইন আসছে যা দেশের গরিব মানুষকে আবার পথে বসাবে। দেশজোড়া প্রতিবাদের পর প্রধানমন্ত্রী ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামলেন, বললেন সিএএ-র সঙ্গে এনআরসি-র কোনও সম্পর্কই নেই। আধ ঘণ্টার মধ্যে ভিডিও সামনে এল শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যিনি বলছেন যে এনআরসি আসবে সারা দেশেই আসবে। বিল তো পাশ হয়ে গেছে সেই কবেই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপি দল বা অমিত শাহকে একটু দিশেহারা মনে হচ্ছে। কেন? তার প্রথম কারণ হল এই বিল বা এনআরসি নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া। ওনারা ভেবেছিলেন মুসলমানরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নামবে, হিংসাত্মক আন্দোলন হবে দেশ জুড়ে, একে ৪৭ বের হবে, হিন্দু আর মুসলমান আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাবে, ফুলকো লুচি, খেজুর গুড়। হয়নি। বরং দেখা গেল মুসলমান সমাজ হাতে তেরঙা নিয়ে রাস্তায় জাতীয় সঙ্গীত গাইছে, দিল্লির জামা মসজিদের সামনে এক দলিত নেতা উপস্থিত হাজার হাজার মুসলমানদের নিয়ে সংবিধানের ভূমিকা পাঠ করছেন। দেখা গেল কেবলমাত্র উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক, অসমেই হিংসা হল, করানো গিয়েছিল, যে রাজ্যগুলো বিজেপি-শাসিত। অন্য জায়গায় মৃত্যুর খবর নেই, দিন দুয়েক অশান্তি ছড়ানোর খবর হলেও বাংলা শান্ত, তখন বিরাট বিরাট মিছিল রোজ বের হচ্ছে রাজ্য জুড়ে এনআরসি, সিএএ-র বিরুদ্ধে। অন্য ধারার এই প্রতিবাদে মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে হাত ধরে মাঠে নেমেছে সব ধর্মের মানুষ, ধর্ম না মানা মানুষ। এই ধরনের প্রতিবাদ, দেশজোড়া প্রতিবাদ বিজেপি নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি বা অমিত শাহজিরা আশা করেননি। অতএব ব্যাকফুটে। ভারতবর্ষ এক নতুন মুসলমান সমাজকে দেখল যা আগে দেখা যায়নি, ভারতবর্ষ এক নতুন অসাম্প্রদায়িক সহমর্মিতা দেখল, যা আগে অন্তত এই মাপে রাস্তায় দেখা যায়নি। সেই কারণেই আজও ওই নাগরিকত্ব বিলের রুলবুক তৈরি হল না, কিন্তু নির্বাচন তো এসে গেছে, কাজেই আবার সমস্বরে হুক্কা হুয়া, লাগু হবে সিএএ, বলছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
গোয়েবলস-এর জমানা শেষ অমিত শাহজি, স্যোশাল মিডিয়া গোয়েবলস-এর প্রচারে গ্যামাক্সিন ঢেলে দিচ্ছে। বিশ্বাস করুন, টাকা দিয়ে ভয় দেখিয়ে যে গোদি মিডিয়া যে বশংবদ সংবাদমাধ্যম তৈরি করেছেন তাদের খবর মানুষ বিশ্বাস করছে না। বরং সমান্তরাল হয়ে উঠছে স্যোশাল মিডিয়া, সেখানে মুহূর্তের মধ্যে সেই খবর চলে আসছে, আকে আটকাতে পারছেন না, পারবেন না। কুস্তিগিররা আন্দোলন করছেন, খবর সোশ্যাল মিডিয়াতে, কৃষকরা আন্দোলন করছেন, খবর সোশ্যাল মিডিয়াতে। একটা প্রার্থী খাড়া করলেন আসানসোলে, তার কেলোর কীর্তি কে বার করল? সবটাই তো সোশ্যাল মিডিয়াতে। বাপ বাপ করে সেই প্রার্থীকে তুলে নিতে হল। মেন স্ট্রিম মিডিয়ার গুরুত্ব কমছে। বাংলায় এসেই মতুয়াদের ভোট চাই, সিএএ-র কথা বলছেন। কেন? মতুয়ারা নাগরিক নন? আপনার দলের নির্বাচিত সাংসদ দেশের নাগরিক নন? বাংলা কেরালা সমেত অবিজেপি রাজ্য সরকার প্রায় সবাই সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সিএএ লাগু করা হবে না। কাজেই সিএএ ঘুঁটি কাজ করছে না। এবারে বিজেপি, অমিত শাহ বিরোধী দল পরিচালিত সরকার ভাঙার কাজে নামলেন, তাঁদের লক্ষ্য এক কেন্দ্রীয় সরকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তাঁদের না-পসন্দ। মহারাষ্ট্র থেকে বিহার, সর্বত্র নির্বাচিত সরকার ভেঙে দাও। সেই ইচ্ছে কি এখানেও নেই? আছে বইকী? তার চেষ্টা তো চলছে। কিন্তু দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, চাকরি নেই, ৬০ হাজার পদের জন্য ২৮ লক্ষ বেকার ছেলে আবেদন করছে, পরীক্ষায় বসছে। মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষজন সন্তানের পড়াশুনো আর মেডিক্যাল বিল নিয়ে হাঁসফাস করছে, কাজেই সব সমস্যার দাওয়াই এল ওই রামমন্দির, সেও তো তৈরি হয়ে গেল, তাতে কী?
এবার নতুন করে মথুরা কাশীর দাবি উঠছে। বিজেপি এই ধর্মীয় উন্মাদনাকে কাজে লাগানোর জন্যই নাগরিকত্ব বিল এনেছে, অন্য কোনও কারণ নেই। কিন্তু তাদের সমস্যা হল উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় মেরুকরণ মানুষ আর নিচ্ছে না, নেবে না। কারণ আগেই বলেছি মানুষ পেঁয়াজ কিনতে মন্দিরে তো যায় না, বাজারে যায়, আর বিক্রেতা তার দেশভক্তি দেখে পেঁয়াজের দাম কম করে না। যার ফলে মানুষ তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বুঝতে পারছে যে চাই আসলে চাকরি শিল্প খাবার শিক্ষা স্বাস্থ্য বস্ত্র মাথার উপর ছাদ যার সঙ্গে রামমন্দিরের উচ্চতার কোনও সম্পর্ক নেই। এবার নির্বাচনে বিজেপির স্লোগান এক বিরোধীমুক্ত ভারত, যেখানে ওনারাই থাকবেন, ওনারাই সিদ্ধান্ত নেবেন, ওনারাই ঠিক করে দেবেন দেশের মানুষ কী খাবে কী পরবে, কী পড়বে। কিন্তু তা তো হয় না। আপনি ভালো কাজ করুন, শিল্প হোক, চাকরি পাক, মানুষ খেয়ে পরে বাঁচুক, শিক্ষা স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো হোক। এমনিই বিরোধীরা হেরে যাবে, এটাই গণতন্ত্রের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের লাল নীল কমলা কোনও দলই এই সহজ সরল সত্যটা বুঝতে পারে না। কংগ্রেসমুক্ত ভারত চাই, বিরোধীমুক্ত ভারত চাই, তাতে দেশ এগোবে? দেশের মানুষকে খাদ্য শিক্ষা বাসস্থান পানীয় জল, স্বাস্থ্যের সুযোগ, শিক্ষার সুযোগ দিন, তারপর হোক না ধর্মচর্চা। একটু কাজে মন দিন মোদিজি, যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মসনদে বসেছিলেন সেগুলো আবার বার করুন, সেগুলো Implement করুন। চারিদিকে একটা হাওয়া উঠেছে জিতেই গেছেন মোদিজি, কিন্তু একটু কান পাতুন, যাঁরা বলছেন, সেই তাঁরাই বলছেন আমাদের এলাকাতে জিতবে না, কিন্তু দেশে তো বিজেপিই আসবে, এই চিন্তার ফলাফল কী হবে ভেবে দেখেছেন? মানুষ মনে করছে তাদের ঠকানো হয়েছে, মানুষ বাস্তব অবস্থার সঙ্গে প্রতিশ্রুতিকে মেলানোর চেষ্টা করছে, মিলছে না। মোদিজি, মাথায় রাখুন মানুষ বড্ড সোজাসাপ্টা, অমন ক্ষমতাশালী ইন্দিরা গান্ধীকে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল, আপনার ইতিহাস তো বড্ড ছোট।