বাজনদারেরা ঢাক পেটানো শুরু করে দিয়েছে, ২০২৪, আয়েঙ্গে তো মোদি হি। কাজেই ভক্তকুল আহ্লাদিত, হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে সমবেত ঘোঁৎ ঘোঁৎ। মধ্যে বসে থাকা এমন অনেক মানুষ, যাঁরা কংগ্রেস নয়, তৃণমূল নয়, সিপিএম-সিপিআই নয়। এক উদার পরিবেশে মানুষ হয়েছে বড় হয়েছে, ছোটবেলা থেকেই শুনেছে দেশের ভিত্তি হল সংবিধান, উই দ্য পিপল, ধর্ম এক ব্যক্তিগত অভ্যাস, জেনেছে আপ রুচি খানা কিন্তু জামাকাপড়ের স্থান কাল ভেদাভেদ আছে। পড়েছে জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া, পড়েছে রবীন্দ্রনাথ, সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই। অনায়াসে দুর্গাপুজোয় ধুনুচি নাচ নেচেছে, ইদের সেমাই খেয়েছে, বড়দিনের কেক কিনেছে নাহুমস থেকে। সেই তাঁদের একটা অংশও কুঁকড়ে গেছে, থাক আর রাজনীতি নিয়ে কথাই বলব না, চোখের সামনে দেশ বদলে গিয়েছে, আর কিছুই করার নেই গোছের কথাবার্তা চলছে। এক সর্বগ্রাসী হতাশা গ্রাস করেছে বিরোধী দলের কিছু নেতাদের আর এই অংশের শিক্ষিত মানুষজনদের। অন্যদিকে দিন আনি দিন খাই মানুষজনের চিন্তা তাদের রোজগার নিয়ে, ডাঁয়ে আনতে বাঁয়ে কুলোচ্ছে না। বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে আথায় হাত, পড়াশুনো ক্রমশ হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, ঘরে সবল ছেলেমেয়ে, হাতে কাজ নেই বেকার। আর এটাই আমাদের দেশের এক বিরাট অংশ, এদেরই এক বিরাট অংশ ভোট দিয়েছে মোদিজির বিরুদ্ধে, বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে।
সি ভোটারের সমীক্ষা বলছে, দেশের গরিব মানুষজনের বড় অংশ বিজেপি বিরোধীদের ভোট দেয়, বড়লোকের বেশিরভাগটাই বিজেপিকে দেয়। সেই গরিব মানুষজন দেখছেন তাঁদের ভোটে সরকার বদলাচ্ছে না। সেখানেও হতাশা। এরপরে আবার এক মহলের ইভিএম নিয়ে সংশয় আছে, বিজেপি ইভিএম ম্যানিপুলেট করছে, আর কিচ্ছু করার নেই। সেই হতাশা কাটানোর জন্য ক’টা বিষয় বুঝে নেওয়া দরকার। বিজেপির স্ট্রং হোল্ড কোথায়? তাদের গড় কোনটা? বিনা দ্বিধায় বলা যায়, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান। হ্যাঁ, এই চার রাজ্যে তারা দারুণ ফল করবে। কিন্তু আগেরবারের মতো করবে? যাকে বলে সুইপ করা সেটা হবে? হতেই পারে। কিন্তু নাও হতে পারে। কীভাবে? ধরুন গুজরাত, ২৬-এ ২৬ পেয়েছিল গতবার। এবারে যদি আপ আর কংগ্রেস একসঙ্গে ভোটটা লড়ে, ওখানকার আদিবাসী সংগঠনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হয়, তাহলে? রেজাল্ট উল্টে যাবে না, কিন্তু গোটা তিনেক আসন বিরোধীরা জিততেই পারে। চলুন উত্তরপ্রদেশ, মাথায় রাখুন ২০১৯-এ কিন্তু ২০১৪-র ফল হয়নি বিজেপির। ২০১৪তে জিতেছিল ৭১টা আসন, আদিত্যনাথ যোগী বিরাট ভোটে রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পরেও বিজেপি ৬৪টা আসন পেয়েছে, মানে ৭টা আসন কমেছে। ২০১৭তে যোগীজি ক্ষমতায় এলেন ৩১২ জন এমএলএ নিয়ে, ২০২২-এ জিতেছেন ২৫৫টা আসন। তার মানে খুব পরিষ্কার যে মুখ্যমন্ত্রী যোগীজির রাজ্যেও বিজেপির আসন কমছে, ভোট কমছে, সমর্থন কমছে। তাহলে এবারে হঠাৎ তা বাড়বে কেন? রামমন্দিরের জন্য? অযোধ্যায় গিয়ে দেখুন মধুভাণ্ড নিয়ে খেয়োখেয়ি চলছে, তাছাড়া অযোধ্যা ইস্যুতে নতুন করে কাদের ভোট পাবে বিজেপি? এতদিন যাঁরা ওই ইস্যুতে বিজেপিকে ভোট দেয়নি তাঁরা ভোট দেবেন? কাজেই উত্তরপ্রদেশেও কমবেশি ৩-৪-৫টা আসন কমবে।
আরও পড়ুন: ইন্ডিয়া জোটকে জেতার জন্য কী কী করতে হবে?
রাজস্থান ২০১৯-এ ২৫ ছিল, এবারেও ২৫ থাকবে? বেশ থাকুক। মধ্যপ্রদেশ ২০১৯-এ ২৮ ছিল? ২৮ থাকবে? থাকুক। কিন্তু এখানে বলে রাখি রাজস্থান মধ্যপ্রদেশের হিসেবে গন্ডগোল হতে পারে, এই দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন? এখনও ঠিক করতে পারেনি বিজেপি, কংগ্রেসের শপথ গ্রহণ হয়ে গেল। কাজেই সেখানে জটিলতা না কাটাতে পারলে আসন কমবে। ব্যস, এই চার রাজ্যের পরে যে বড়, মাঝারি রাজ্যের নাম নেবেন, সেখানেই বিজেপির সাংসদ সংখ্যা কমবে। মহারাষ্ট্র থেকে কর্নাটক, তেলঙ্গানা থেকে হিমাচল, বিহার থেকে বাংলা সাংসদ সংখ্যা কমবে। ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশে তেড়েফুঁড়ে নামলে নির্বাচনের পরে জোট হবে না, সমর্থন নাও আসতে পারে, কাজেই সেখানে কোনও অগ্রগতি সম্ভব নয়। বাকি রইল কোন কোন রাজ্য? রাজস্থান, বিহার, বাংলা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরল, পঞ্জাব, দিল্লি। মনে হচ্ছে কি এই রাজ্যগুলোতে বিজেপি গতবারে ফলাফলের ধারেকাছেও আসতে পারবে? মহারাষ্ট্রে ভাঙা শিবসেনা আর এনসিপির সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে সার্কাস তো এখনও বাকি আছে। হ্যাঁ, অসমে যা ছিল তাই থাকবে, কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কয়েকটা আসন কমতে পারে। এইসব রাজ্যে আসন কমলে বিজেপি হেরে যাবে? কতটা হার জানি না কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হাঁপিয়ে যাবে, এটা জানি। সেই জন্যেই কেবল সাধারণ অঙ্কের হিসেবে ২০২৪ বিজেপির কাছে কেকওয়াক নয়। কেবল এটাই কী কারণ? না, কারণ আরও আছে।
২০১৪ থেকে বিজেপি বছরখানেকের মধ্যেই এক অন্য আকার ধারণ করেছে। আজকের বিজেপির দিকে তাকালে স্পষ্ট যে সে ৮০-র দশকের কংগ্রেস হয়ে উঠেছে, হাইকমান্ডের কংগ্রেস, দিল্লি থেকে পরিচালিত কংগ্রেস, রাজ্যে রাজ্যে শক্তিশালী নেতাদের অবহেলা করে কিছু পুতুল, জো হুজুর দিয়ে দল চালানো কংগ্রেস। সেই হাই কমান্ড পলিটিক্স যখন চলেছে তখন কি আদৌ বোঝা গিয়েছিল যে এই বিরাট দলটা একবার ক্ষমতা থেকে হেরে গেলে কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকবে? বোঝা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী গেলেন কর্নাটকে। মুখ্যমন্ত্রী, কর্নাটকের জনপ্রিয় লিঙ্গায়েত নেতা বীরেন্দ্র পাতিলের সঙ্গে কথা না বলেই তাঁকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিলেন। তারপরে নির্বাচনের পর নির্বাচনে হেরেছে কংগ্রেস, এককভাবে ক্ষমতায় আসেনি, ২০২৩ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল কংগ্রেসকে। বিজেপি এখন ঠিক সেই জায়গাতে দাঁড়িয়েছে। এক যোগী আদিত্যনাথ আর অসমের হিমন্ত বিশ্বশর্মা ছাড়া সেদিকে তাকাবেন, বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরা কাঠপুতুলের চেয়েও খারাপ। ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীর সময়ে তবু ক্যাবিনেটে কিছু স্বাধীন মন্ত্রী দেখা যেত, নরেন্দ্র মোদির ক্যাবিনেটে এক অমিত শাহ ছাড়া কারও কোনও কথা বলারই সুযোগ নেই, কারও স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। পিএমও থেকে প্রতিটা দফতর চালানো হয়, প্রতিটা দফতরের সেক্রেটারি থেকে শুরু করে দুই কি তিন নম্বর আমলাও পিএমও ঠিক করে দেয়। নীতিন গডকড়ি এটা মানেননি বলে তাঁকে নিয়ে সমস্যা। আজকের ঠিক এই মুহূর্তের নরেন্দ্র মোদি মন্ত্রিসভার একজনও অটল বিহারীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন না। হ্যাঁ, ১৫ বছরের মধ্যে খোলনলচে পাল্টে ফেলেছেন মোদি–শাহ। বিজেপির তিন নম্বর সমস্যা হল মোদি-নির্ভরতা। মোদি আপাতত বিজেপির সবখোল চাবি, লোকসভা, বিধানসভা, মিউনিসিপ্যালিটি বা পঞ্চায়েত নির্বাচনেও মোদিজিই মুখ। কখনও লম্বা দাড়ি, কখনও ছোট দাড়ি, কখনও গেরুয়া, কখনও মিলিটারি পোশাক, কিন্তু মুখ এক। একটা ক্লান্তি তো আছেই, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা হল এতদিন ধরে থাকার পরে তাঁর রিপ্লেসমেন্ট ভারি কঠিন। ২০১১তেও দেখেছি বাংলার সিপিএম সমর্থকরা জনসভায় জ্যোতিবাবুকে বক্তা হিসেবে চাইছেন, মানে রিপ্লেসমেন্ট নেই।
২০২৪-এ দেশ জুড়ে নির্বাচন, একটা রাজ্যের নয়, কত জায়গায় পৌঁছবেন প্রধানমন্ত্রী? সমস্যা আছে, কারণ বিরোধীদের আক্রমণের সমস্ত নিশানা কিন্তু ওই মোদিজির দিকেই থাকবে। এবং শেষ সমস্যা সংগঠনের, বৃদ্ধির সমস্যা, প্রবলেম অফ গ্রোথ। বিজেপি মানে আরএসএস-এর শাখা থেকে উঠে আসা শমীক ভট্টাচার্য, এরকমটা মনে করার কোনও কারণ নেই, এমনকী অমিত মালব্যও নয়। এক বিরাট তলার সারির ক্যাডার তৈরি হয়েছে যাঁরা প্রকাশ্যেই বলছেন গান্ধী দেশদ্রোহী, জওহরলাল মুসলমান, দেশকে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পরাধীন করে রেখেছে কংগ্রেস। মোদিজি স্বাধীনতা আনবেন, তারা প্রকাশ্যেই নাথুরাম গডসের কথা বলছেন, টিভি আলোচনাতেও এই অতি উৎসাহীরা সংবিধান ছুড়ে ফেলার কথা বলছেন। মুসলমানদের পাকিস্তানে যাওয়ার কথা বলছেন না হলে মাথা নিচু করে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন, সংখ্যালঘুদের পিটিয়ে মারছেন, কোথাও এতটুকু বিরোধিতাকে দেশদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। আর এইসব বিষয়গুলো মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। এমনকী বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে, নরেন্দ্র মোদির রথযাত্রার পরে নো ভোট টু বিজেপি এমন শব্দবন্ধ শুনেছিলেন? মানে যাকে খুশি দিন, ভয়ঙ্কর সিপিএম বিরোধী, কিন্তু কেরলে বিজেপি একটাও আসন পায়নি, তাতে খুশি, বিধানসভায় শূন্য, দলের অন্যতম নেতা কান্তি গাঙ্গুলি বিবৃতি দিয়েছেন, মানুষ বিজেপিকে ভোট দেয়নি, ক্ষমতায় আনেনি তার জন্য অভিনন্দন। শুনেছিলেন এরকম কথা অটলবিহারীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে? মানে এই নতুন উগ্র অশিক্ষিত, ভক্তদের কাজে এক বিরাট মানুষ আতঙ্কিত, সেই মানুষদের অনেকে বহু বছর ভোটের লাইনেও দাঁড়াতেন না, তাঁরা দাঁড়াচ্ছেন, এটা বিজেপির কাছে সুখবর নয়। কাজেই ২০২৪ বিজেপির কাছে কেকওয়াক, এরকম যাঁরা বলছেন তাঁরা আসলে বিজেপির হয়ে ক্যাম্পেন করছেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ অন্য কথা বলছে।