সেই জুন মাসে ইন্ডিয়া জোট তৈরি হয়েছিল, জোটের প্রথম উদ্যোক্তা পাল্টি কুমার নীতীশজি আপাতত এনডিএ-তে ফিরে গেছেন, সেই জোট হওয়ার পরে মহারাষ্ট্রে এনসিপি ভেঙে দু’ টুকরো, কংগ্রেসের বিরাট নেতা প্রয়াত এস বি চব্যনের পুত্র একদা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী অশোক চব্যন চলে গেছেন বিজেপিতে, কংগ্রেসের নেতা মিলিন্দ দেওরা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। শুরু থেকেই সিপিএম বলে এসেছে যে জোটই হোক না কেন, কেরালাতে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াই হবে। জোটের বহু আলোচনার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, এ রাজ্যে জোট হবে না, যে কংগ্রেস দলের রাজ্য নেতা রাজ্যে ৩৬৫ ধারা প্রয়োগ করার দাবি জানাচ্ছেন, সে রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট সম্ভব নয়। বহু আলোচনার পরে কেজরিওয়াল, আপ দল জানিয়ে দিয়েছে তারা একলাই লড়ছে। কাশ্মীরে ফারুক আবদুল্লা জানিয়েছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নয়, পিডিপির মেহবুবা মুফতি জানিয়েছেন কোনও নির্বাচনী সমঝোতা হচ্ছে না। এক বিরাট ঢাকঢোল বাজিয়ে রাহুল গান্ধী তাঁর দ্বিতীয় পদযাত্রা, ন্যায় যাত্রা শুরু করলেন, তাতে খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশি শোনা গেছে। সিপিএম ছাড়া ইন্ডিয়া জোটের কোনও শরিক দল সেই ন্যায় যাত্রাতে সামিল হয়নি। মাথায় রাখুন রাহুল গান্ধীর প্রথম ন্যায় যাত্রাতে কেরালায় সিপিএম সামিল হয়নি, আবার পিনারাই বিজয়নের ডাকা দিল্লি সমাবেশে কংগ্রেসের নেতারা হাজির হননি। সেই ইন্ডিয়া জোট তৈরি হওয়ার পরে রাজস্থান, ছত্তিশগড় হারিয়েছে কংগ্রেস, বিরাট পরাজয় মধ্যপ্রদেশে, তেলঙ্গানাতে মুখরক্ষা হয়েছে, সেটাও কতদিনের জানা নেই।
এরই মধ্যে অখিলেশ যাদব আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছেন, ১৫টা আসন নিলে নিন না হলে জোট হবে না, আর জোটই যদি না হয় তাহলে ন্যায় যাত্রাতেও আমরা থাকব না। ইউপিতে ইন্ডিয়া জোটের শরিক রাষ্ট্রীয় লোকদল আজ বা কাল এনডিএ-তে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করবে, মণীশ তেওয়ারি বা কমল নাথ আর তাঁর পুত্র নকুল নাথ কী করবেন তা নিয়ে সংশয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব। কমল নাথ, ইন্দিরা গান্ধী যাঁকে তাঁর তৃতীয় সন্তান বলতেন এই সেদিনও যিনি ছিলেন মধ্যপ্রদেশের ঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী চেহারা, তিনি পাল্টি খেলে মুখ পোড়ার আর বাকি থাকবে কী? ওদিকে কংগ্রেসের কাজকর্ম নিয়ে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে কী নিয়ে আলোচনা চলছে? এক, রাহুল গান্ধীর ন্যায় যাত্রা, কেবল রাহুল গান্ধীর মেক ওভারের এক অক্ষম প্রচেষ্টা। দুই, রাজস্থান থেকে অসুস্থ সোনিয়া গান্ধী রাজ্যসভার প্রার্থী হলেন। তিন রায়বেরিলি থেকে দাঁড়াচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, তিনিও নাকি দু’দিন হাসপাতালে ছিলেন। জয়রাম রমেশ, কে সি বেণুগোপাল, পবন খেরাদের দেখলে মনে হচ্ছে হেরে যাওয়া রাজার ক্লান্ত সৈনিক। সব মিলিয়ে এই মূহূর্তে ইন্ডিয়া জোট এক বিশুদ্ধ অশ্বডিম্ব। জুন মাসে তৈরি হয়েছে ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স, আজ অবধি একটা সম্মিলিত জনসভা? প্রত্যেক নেতা মঞ্চে বসে আছেন, দেশের নানান সমস্যা নিয়ে তাঁদের কথা বলছেন, মানুষ শুনছে, এরকম ছবি দেখেছেন? একবারের জন্যও নয়। অথচ আদত ছবিটা কীরকম? দক্ষিণ বিজেপির কবজার বাইরে, বিজেপিকে প্রাণপণ বিভিন্ন দল ভাঙার চেষ্টা করতে হচ্ছে। বাংলাতে তৃণমূল এক বড় প্রতিরোধ, ইডি, সিবিআই আর মিডিয়া দিয়েও সামলানো যাচ্ছে না, বিহারে নীতীশ এসে লাভ হল না ক্ষতি তা নিয়ে বিজেপির মধ্যেই দ্বিমত আছে, কেজরিওয়াল দিল্লি পঞ্জাবে দাঁত চেপে লড়ছেন। উত্তরপ্রদেশে আর কত ভালো হবে? উত্তর পূর্বাঞ্চলের আগুন নেভানো যাচ্ছে না, তার উপর কৃষকরা আবার রাস্তায়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | গণতন্ত্র বড্ড বেশি দামি
সব মিলিয়েই এটা যে বিজেপির খুব কেকওয়াক তাও নয়, তাই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে দাঁড়িয়ে মেঠো ভাষণ দিয়ে অব কি বার ৪০০ পার বলতে হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির হাল বদলায়নি বরং বেকারত্ব আরও বেড়েছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে, বৈষম্য বাড়ছে, একের পর এক পরিসংখ্যান আসছে যা সাফ জানিয়ে দিচ্ছে আচ্ছে দিন তো দূরের কথা যে দিন ছিল সেদিনও চলে গেছে, অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এমনকী নির্বাচনী সমীক্ষাতে ৩৫০ পার করে দেওয়া সংস্থার রিপোর্টে স্মল লেটারস খুব গোলমেলে। ক’দিন আগেই বলেছি, আবার এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, যেখানে বলা হচ্ছে, যাদের মোবাইল ফোন আছে তাদের ৪১ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দেয়, যাদের নেই তাদের ৩৫ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দেয়। তার মানে গরিব লোকজনেদের অন্তত ৬ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দেয় না, যে হিসেব এই সার্ভেতে এলই না। এর উপরে বলা হয়েছে, এই সার্ভে ৩ শতাংশ এদিক ওদিক হতে পারে। তার মানে বিজেপি ৪২ শতাংশ ভোট পাবে বলা হয়েছে সেটা ৩৯ শতাংশ হতেই পারে। কংগ্রেস ৩৭ শতাংশ ভোট পাবে বলেছে সেটা ৪০ শতাংশ হতেই পারে। সার্ভেতেই একথা বলা আছে, কিন্তু মানুষ তো সার্ভের এসব দেখেন না, মোট কে কত পেতে পারে ধরে নিয়েই পার্সেপশন তৈরি করেন। কাজেই এই সার্ভেও আসলে সেই সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ারের অঙ্গমাত্র। এবং মজা এখানেই শেষ নয়, এই সার্ভেতে মানুষের মতামত বহু বিষয়ে নেওয়া হয়েছে, সেখানে অর্থনীতির বহু প্রসঙ্গ আছে। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বেকারত্ব নিয়ে আপনারা কতটা চিন্তিত? ৫২ শতাংশ মানুষ অত্যন্ত চিন্তিত, ১৯ শতাংশ মানুষ চিন্তিত। মানে যাদের মধ্যে সার্ভে করা হল তাদের ৭১ শতাংশ বেকারত্ব নিয়ে চিন্তিত, তাদের মনে হয়েছে বেকারত্ব বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কী ভাবছেন? ৬২ শতাংশ মানুষ বলেছেন খুব খারাপ অবস্থা, সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। আপনার আর্থিক অবস্থার হাল কেমন? উত্তরে ৩৫ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন আগের থেকেও খারাপ, ২৯ শতাংশ বলছেন আগের মতোই আছে।
মানে ১০ বছর বিজেপি শাসনের পরে ৬৪ শতাংশ মানুষ মনে করছেন অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ বা আগের মতোই আছে। মাথায় রাখুন এর মধ্যে সেই গরিব অংশের মানুষ নেই যাঁদের একটা মোবাইল ফোনও নেই। তারপরে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আচ্ছা এই অবস্থা পাল্টাবে বলে কি আপনি মনে করেন? ৩০ শতাংশ মনে করেন আগের চেয়েও অবস্থা খারাপ হবে, ৩৬ শতাংশ মনে করেন যা ছিল তাই থাকবে। মানুষজনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আপনাদের কি মনে হয় আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে? ৪৫ শতাংশ বলেছেন হ্যাঁ বাড়ছে, মাত্র ৩৭ শতাংশ বলেছেন, না বাড়ছে না। প্রশ্ন, সরকারি নীতিতে কার লাভ? ৫২ শতাংশ মানুষ বলেছেন বড় ব্যবসায়ীদের এই জমানাতে লাভ হয়েছে। দুর্নীতি কমেছে? ৪৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন, না কমেনি। ৪৬ শতাংশ মানুষ বলেছেন কমেনি। আচ্ছা, যে দেশের মানুষ মনে করে বেকারত্ব বাড়ছে, মনে করে মূল্যবৃদ্ধি অসহ্য হয়ে উঠছে, মনে করে যে এই সরকার কেবল বড় ব্যবসায়ীদের জন্য কাজ করছে, মনে করে যে বৈষম্য বাড়ছে। অর্থাৎ এক মজার ধাঁধা, যেখানে মানুষ সরকারের উপরে ক্ষুব্ধ, মানুষ সরকারের কাজে খুশি নয়, কিন্তু তার সামনে কোনও বিকল্প নেই বা বিকল্প শক্তিরা নানা অংশে বিভক্ত। কারণ? কারণ কংগ্রেস নেতৃত্ব আর কংগ্রেসের সঙ্গে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সম্পর্কের পুরনো ইতিহাস। প্রথমে আসি নেতৃত্বের কথায়। যদি এমনই হয় যে গান্ধী পরিবার ছাড়া কংগ্রেসের উঠে দাঁড়ানোর আর কোনও পথ নেই তাহলে ন্যাকামি না করে, চালাকি না করে সামনে এসে রাহুল গান্ধী সেই পদে বসুন। দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে থাকতেন সোনিয়া গান্ধী, রাহুল দেশ জুড়ে ন্যায় যাত্রা করছেন, দ্বিতীয় নেতৃত্বের স্ট্রাগল চলছে, ট্রেনিং চলছে, অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন, ঠিক হত। কিন্তু কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে আর দলের সব রিসোর্স থেকে সেজো, মেজো, ছোট নেতা রাহুল গান্ধীর ইমেজ বিল্ডিংয়ের কাজে লেগে পড়েছেন। হয় নাকি? রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাইপো অভিষেক পরের নেতৃত্ব হিসেব রাজ্য জুড়ে পদযাত্রা, ট্রাক যাত্রা করছেন, বোঝা গেল। দলের সভাপতিকে বাদ দিয়েই কংগ্রেসের ন্যায় যাত্রা হয়ে উঠেছে রাহুল গান্ধীর ইমেজ বিল্ডিং ইভেন্ট।
আগামী কাল দেশে বড় কিছু হলে, মোদিজির কোনও বড়সড় ঘোষণার পরে কোন বোকা সাংবাদিক মল্লিকার্জুন খাড়্গের প্রতিক্রিয়া নিতে যাবেন? তাঁরা স্বাভাবিক কারণেই রাহুল গান্ধীর কাছেই আসবেন কারণ দুধুভাতু খেলাটা সকলেই বোঝে। আর ঠিক সেই কারণে মোদিজির সুবিধে, কারণ এ দলে কমল নাথও নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন, মিলিন্দ দেওরাও করেন। কমল নাথ জানেন এই সময়ে ছেলের ভবিষ্যতটা গুছিয়ে মানে মানে বানপ্রস্থে গেলেও ভালো। মোদিজি অনায়াসে হাত তুলে বলতেই পারেন এই দল গান্ধী পরিবারের, এই দলে শুরু এবং শেষ কথা গান্ধী পরিবার থেকেই আসে। এটা একটা বংশানুক্রমিক শাসন। মানুষ কেন বিশ্বাস করবে না? আর একথা কি কেবল মোদিজিই বলেছেন নাকি? ক’দিন আগে পর্যন্ত কমিউনিস্টরা বলেছে, ক’দিন আগেই এসব কথা এনসিপির শরদ পাওয়ার বলেছেন, সোশ্যালিস্টরা বলেছে, লালু যাদব বলেছেন, মুলায়ম সিং বলেছেন। আর এটাই তো নরেন্দ্র মোদির সুবিধে যে আজ যে যে কথাগুলো উনি কংগ্রেসকে বলছেন, সেই সব কথাই এই বিরোধী দলেরা সেই কবে থেকেই বলে আসছে। এসমা নাসার সময় মনে ছিল না যে এগুলো কালা কানুন? কে এনেছিল এসমা নাসা, প্রেস বিল থেকে জরুরি অবস্থা? কারা খুলেছিল রামমন্দিরের বন্ধ দরজা? কীসের জন্য? হিন্দু ভোটের জন্য তো? সেটা মোদিজিদের দিকে গেছে। আজ সেই অবিজেপি বিরোধী দলগুলোকে এক ছাতার তলায় আনার জন্য, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই কংগ্রেসকে অনেক বড় স্বার্থ ত্যাগ করে কাজ করতে হবে। কিন্তু সে বুদ্ধি আর চেষ্টার ছিটেফোঁটাও কি দেখতে পাচ্ছেন, অত্যন্ত আনাড়ি অ্যাপ্রেনটিসের মতো রাহুল গান্ধী কিছু ভালো ভালো কথা বলছেন। এসব নিয়ে উনি অনায়াসে চার্চের ফাদার হতে পারেন, কলেজের জনপ্রিয় অধ্যাপক হতে পারেন, শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্র গবেষকও হতেই পারেন কিন্তু আমাদের দেশের বিরোধী দলের নেতা হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে পারা তো দূরের কথা সামান্য বিশ্বাসযোগ্যতাও তৈরি করতে পারবেন না, পারছেন না। এবং এরকমটাই চলতে থাকলে, হারার আগেই হেরে বসে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই মমতা নিজের মাঠ বাঁচাবেন, সিপিএম কেরালা, স্তালিন তামিলনাড়ু, বিহার তেজস্বী বাঁচাবেন, অখিলেশ লড়বেন উত্তরপ্রদেশে, কেজরিওয়াল দিল্লি আর পঞ্জাব বাঁচাবেন, হেমন্ত সোরেন লড়ে যাবেন ঝাড়খণ্ডে। কংগ্রেস সত্যিই ৪০টা আসন পেতেও হিমশিম খাবে।