আমাদের আইন ব্যবস্থা খানিকটা গলফ খেলার মতো। বিশাল সবুজ গলফ মাঠ, হাঘরে গরিবদের প্রবেশ নিষেধ, আইনগুলো গলফ বলের মতো রাখা, সাইজ মতন স্টিক তুলে নিয়ে ধাঁই করে মারা। পয়সা থাকলে, ক্ষমতা থাকলে আইন নিয়ে যা খুশি করা যায়, যা খুশি। কেবল ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বছরের পর বছর কবি, সাহিত্যিক, উকিল, সমাজসেবী, সাংবাদিক, লেখককে জেলে ভরে দেওয়া যায়। চোখের সামনে খুন করে, ধর্ষণ করে জেল হওয়া খুনি অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া যায়। এক আইনজীবীই বলেছিলেন, আইন ঠোঁটে লিপস্টিক, গালে রুজ মেখে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বারাঙ্গনা যাকে ইচ্ছে করলেই পয়সা দিয়ে কেনা যায়। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ কিছু আশার আলো এসে বলে দেয়, সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনও কিছু বাকি আছে, লড়াই থামালে চলবে না। তেমনই এক খবর এল ২১ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশে। সুপ্রিম কোর্ট বাবা রামদেব এবং তাঁর পতঞ্জলিকে নির্দেশ দিলেন, মিথ্যে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করুন, না হলে আপনার প্রতিটি প্রডাক্টের ওপরে ১ কোটি টাকা করে ফাইন নেওয়া হবে। যদিও তাঁর গোটা ৮০-৯০টা প্রডাক্টের জন্য ৮০ বা ৯০ কোটি টাকা ফাইন করলেও তেনার কিচ্ছু যাবে আসবে না কারণ তাঁর ব্যবসার পরিমাণ ২৯০০০ কোটি টাকারও বেশি। কে এই বাবা রামদেব? যিনি ২০০৬-২০০৭ নাগাদ যোগশিক্ষার কথা বলতেন, তারপর আন্না হাজারে, কেজরিওয়াল ইত্যাদির সঙ্গে ইন্ডিয়া এগেইনস্ট করাপশন আন্দোলনে আসেন। দিল্লিতে জনসভা থেকে মহিলাদের পোশাক পরে পালানোর চেষ্টার পরে তাঁর সেই ছবি ভাইরালও হয়। ২০১০-১১-১২ থেকে তিনি পতঞ্জলির ব্যবসাতে মন দেন, বিভিন্ন জায়গায় শিবির করে কেবল অনুলোম বিলোম নয়, নিজের প্রডাক্ট বেচতে শুরু করেন।
এরপর থেকে তেনার মুখে করাপশান নিয়ে একটা কথাও শোনা যায়নি। যে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রচুর বাওয়াল দিয়েছিলেন, তা নিয়েও কথা বলেননি। নতুন বলতে তিনি এরপর থেকে অ্যালোপাথি যে কোনও বিজ্ঞানই না, অ্যালোপ্যাথি যে এক মানুষ মারার কল, সেটাই বুঝিয়ে গেছেন। যদিও এরমধ্যে তিনি বা তেনার গুণধর ভাই যখনই অসুস্থ হয়েছেন, তখনই পতঞ্জলির আমলার রস খাননি, গিয়ে ভর্তি হয়েছেন নামকরা হাসপাতালে, অ্যালোপ্যাথিক ট্রিটমেন্টই নিয়েছেন। মার্চ ২৫ -এ লকডাউন হলো করোনা আটকাতে, মানে আমাদের দেশ টের পেল যে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তিন মাসের মাথায় পতঞ্জলির বাবা রামদেব করোনার ওষুধ বের করে সাংবাদিক সম্মেলন করে ফেললেন। এমন একটা সময়ে যখন সারা পৃথিবীতে এক কোটির মতো আক্রান্ত, সারা ভারতে সাড়ে চার লাখের মতো আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। পৃথিবী জুড়ে যত বড় বড় বৈজ্ঞানিকরা আছেন, তাঁরা এই রোগের ওষুধ, ভ্যাক্সিন বার করার জন্য ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। অনেক জায়গাতেই প্রাথমিক কিছু সাফল্য পাওয়া গেছে, কিন্তু তাঁরা সাংবাদিক সম্মেলন করছেন না, কারণ একটা ওষুধকে বাজারে ছাড়ার আগে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়, তার বিভিন্ন ধাপ আছে, তারপর তাকে ওষুধ বলে ঘোষণা করা যায়। কিন্তু ওই যে পয়সা আর ক্ষমতা থাকলে আইনকে কলা দেখানো তো বাঁয়ে হাত কা খেল। তাই বাবা রামদেব সাংবাদিক ডেকে জানিয়ে দিলেন, তাঁরা ওষুধ বের করে ফেলেছেন, কেউ কেউ ৩ দিনে আর বাকিরা ৭ দিনে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক সম্মেলনে দেখালেন সেই ওষুধের প্যাকেট, করোনিল। খেলেই সেরে যাবে করোনা। লোকটাকে অ্যারেস্ট করা উচিত, এখনই জেলে পোরা উচিত, ওষুধ নিয়ে এই সময়ে এরকম বজ্জাতি করার জন্য। তা না করে আয়ুষ থেকে বলা হয়েছিল ক্লিনিকাল ট্রায়ালের রিপোর্ট পাঠান, বলা হয়েছিল এই ওষুধ এখন বিক্রি করতে পারবে না। তাতে বয়ে গেছে, বাজারে এসেছে, বিক্রি হয়েছে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে এই ওষুধ প্রাণ ফিরিয়ে দেবে, মৃত্যুভয়ে মানুষ কিনবে, মরলে মরবে, বাঁচলে জয় বাবা রামদেবের জয়।
আমাদের দেশে ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যাক্ট আছে আর আছে ম্যাজিক রিমেডিস অ্যাক্ট। আসছি সে কথায়, প্রথমে দেখে নিই আমাদের দেশে আইন অনুযায়ী ওষুধ বাজারে আনতে গেলে কী কী করতে হবে, মানে নিয়মটা কী।
আরও পড়ুন: ব্রাত্য বসুর চাকরি কি তাহলে থাকবে?
প্রথমে গবেষণার মাধ্যমে ওষুধটা তৈরি করতে হবে। ধরে নিলাম রামদেব সুপার ফাস্ট, তা হলেও মাসখানেক তো লাগবেই। এরপর আপনাকে বসতে হবে আলোচনায়, যাকে বলে pre submission consultation, তারপর আপনাকে ওষুধ, তার components details, তার কার্যকারিতা ইত্যাদির বিবরণ দিতে হবে। এবার তিনটে কাজ করতে হবে, এটা ধাপে ধাপে হয়, একসঙ্গেও করা যায়। প্রথম হল ক্লিনিক্যাল টেস্ট। এটার আবার চারটে ধাপ আছে, পরে সেটা বলছি। দুই হল, biomedical and health research, রুল ১৭ অনুযায়ী তার অনুমোদন নিতে হবে এথিক্স কমিটির কাছ থেকে। ওষুধ তৈরির আগে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের রিপোর্ট দিতে হবে। সেই ট্রায়ালের ফেজ জিরোতে ১০ থেকে ১৫ জনের উপর সেই ওষুধ প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে হবে। ফেজ জিরোর রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। এরপর ফেজ ওয়ান, ১৫ থেকে ৩০ জনকে এই ওষুধ দিতে হবে। একটা গ্রুপকে কম ডোজের একটা গ্রুপকে বেশি ডোজের ওষুধ দিয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখতে হবে। এই রিপোর্টের ফলাফল দেখার পর ফেজ টু। এবার এই ওষুধের ডোজ কত হবে তা নির্ধারণ করার পালা, এবার সংখ্যাটা আরও বাড়বে, আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা হবে। এর ফলাফল দেখে ফেজ থ্রিতে যেতে হবে। এবার দুটো গ্রুপ থাকবে, তাদের সিম্পটম একই হতে হবে। একটা গ্রুপকে সাধারণ বা পুরনো চিকিৎসাই করা হবে, অন্য গ্রুপকে নতুন ওষুধ দেওয়া হবে এবং তার রিপোর্ট তৈরি করা হবে। এই বিরাট লম্বা প্রক্রিয়ার কারণ হল যাতে ওষুধটার কার্যকারিতা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও বোঝা যায়। যার জন্য একটা ওষুধ আবিষ্কার করে তাকে বাজারে আনতে বছর কেটে যায়। খুব সাধারণভাবেও একটা নতুন ওষুধ আবিষ্কার আর বাজারে আনার মধ্যের সময় ৯ থেকে ১০ মাস। বাবা রামদেব বুলেট ট্রেনে বসে করোনার ওষুধ বার করে বাজারেও এনে ফেলেছেন, তার কথা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন করোনার আতঙ্ক থাকতে থাকতেই এই প্রডাক্টকে বাজারে আনতে হবে, এনেছিলেন, আজও দিব্যি বিক্রি হচ্ছে। আয়ুষ কেবল জানিয়েছে তাদের কাছে কোনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের রিপোর্ট নেই। তাতে কী? বাবা রামদেব সবার সামনে এই ওষুধে করোনা তিন দিন কি বড়জোর সাত দিনে সেরে যাবে বলে ঘোষণাও করেছেন। ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ অ্যাক্ট-এ যার জেলে থাকার কথা, তাঁকে সুপ্রিম কোর্ট থেকে এতদিনে একটা সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
তাহলে আসুন THE DRUGS AND MAGIC REMEDIES (OBJECTIONABLE ADVERTISEMENTS) ACT, 1954-এ কী বলা আছে দেখে নেওয়া যাক।
Subject to the provisions of this Act, no person shall take any part in the publication of any advertisement relating to a drug if the advertisement contains any matters which—
(a) directly or indirectly gives a false impression regarding the true character of the drug; or
(b) makes a false claim for the drug; or
(c) is otherwise false or misleading in any material particular.
কোনও রোগ সেরে যাবে এমন ওষুধের বিজ্ঞাপন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফাঁক আছে, তার সুযোগ বাবা রামদেব এতদিন নিয়েছেন। ইমিউনিটি বুস্টার, শরীরে রোগ আটকাতে চেষ্টা করে এরকম বলে হাজার একটা ওষুধ উনি বিক্রি করেন, যার গুণাগুণ কেউই জানে না। ঠাকুর দালানে চন্নোমেত্ত বা মাজারে জলপড়ার মতোই প্রমাণবিহীন ওষুধ। কিন্তু এতদিন সেগুলোকে ওষুধ বলা হয়নি, আমলা রস, খেলে চোখ ভালো হবে, কিন্তু আইন বাঁচিয়ে ওষুধ বলা হয়নি। কিন্তু করোনিল নিয়ে বাবা রামদেব সাংবাদিক সম্মেলনে পরিষ্কার বলেছেন এই ওষুধে করোনা সেরে যায়। আমি জানি বাবা রামদেবকে জেলে পোরা হবে না, গ্রেফতার করা হবে না। দেশসুদ্ধ মানুষের করোনা আতঙ্ককে ব্যবহার করে তিনি কোটি কোটি টাকা ব্যবসা করবেন। আইন তার কাছে গলফ বল, তিনি সপাটে মারবেন, তাঁর ইচ্ছেমতো। মানুষ মরলে মরবে, বাঁচলে বাঁচবে। ওনার উপার্জিত কোটি কোটি টাকার কিছু অংশ নিশ্চয়ই বিতরণ হবে, আইন পুজোর অঙ্গ হিসেবেই। যাঁর নিজের চোখ পিটপিট করা, যা সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তারও জানে স্নায়বিক দুর্বলতা, তার চিকিৎসা যিনি এতদিনেও করে উঠতে পারেননি। তাঁর দোকান থেকে সারা ভারতে হাজার একটা ওষুধ বের হচ্ছে, মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খোলা বাজারে তামাশা হচ্ছে, কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। আইন আদালত রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের মন্ত্রীসান্ত্রী পাত্রমিত্র অমাত্য মিলে দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন? যখন মানুষের পেটে ভাত নেই, মাথার উপরে ছাদ নেই, চাকরি নেই, যাদের ছিল, তাদেরও চলে যাচ্ছে। কোথায় ভগবান? কোথায় তিরুপতি, জগন্নাথ, সাঁইবাবা, কৃষ্ণ, শিব? তাঁরা কোথায়? যদি থাকেন, মানুষের এই চরম দুর্দিনে তাদের চোখে পড়ছে না কেন এই অবিচার? রাষ্ট্র তৈরিই হয় একদল মানুষকে অন্য আর একদল মানুষের ওপর অবাধ শোষণের, অত্যাচারের, সীমাহীন দারিদ্রের মধ্যে রেখে দেবার জন্য। তাই কিছু মানুষের হাতে জমা হয় সম্পদের ৯০ শতাংশ, অসীম ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা আর অর্থই ব্যবহার হয় তাদের সম্পদকে বাড়াতে, টিকিয়ে রাখতে। তারজন্যই বানানো হয় আইন কানুন। সে আইন ভুখা মানুষের জন্য নয়, সে আইন না খেতে পাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ায় না। তারা দাঁড়ায় কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়ী বাবা রামদেব কিংবা সেই সব মোহান্তদের পাশে, যারা আসলে রাসপুটিন, যারা এই শোষণের ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখতে চায়। ব্যবস্থাটাকে ভাঙতে হবে, এই কাঠামো টিকিয়ে রেখে খেটে খাওয়া মানুষ বড়জোর পেতে পারে তালি দেওয়া জামা, জল চুঁইয়ে পড়া ছাদ আর আধখানা রুটি। অস্বীকার করুন এই ব্যবস্থাকে, এই দ্রোহকালে এই রাসপুটিনদের চিহ্নিত করুন।