নির্বাচনের এই সিজনে কিছু কথা আপনিও শুনছেন, আমিও শুনছি। কান পচে গ্যালো এসব শুনতে শুনতে, দলিত পিছড়ে বর্গ, গরীব মজদুর কিসানের জন্য কাজ করতে চাই, তাদের পাশে থাকতে চাই, তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে চাই, কারা বলছেন? হরেক কিসিমের রাজনৈতিক দলের নেতারা, রাজনৈতিক দল ভাঙা কাঁসরের মত এই কথাই বলে চলেছেন, নির্বাচন এলেই এসব কথা বলেন, নিয়ম করে বলেন, আর সেই কারণেই নাকি তাঁরা কাউন্সিলর, এম এল এ, এম পি, মন্ত্রী হতে চান, কেবল মাত্র সেই কারণে রাজনৈতিক ডোলে যোগ দেন, দলবদল করেন, মাত্র কদিন আগেই যাঁকে নেতা বা নেত্রী বলেছেন, তাঁকে বা তাঁদেরকে রাবণ, পিশাচ, জনবিরোধী, দলিত আদিবাসী বিরোধী বলেন, কদিন আগেই যে সরকারে মন্ত্রী ছিলেন, পাঁচ বছর ধরে যে মন্ত্রীত্ব নিয়ে লাল গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, পুলিশ স্যালুট ঠুকেছে, সেই দলকে উৎখাত করার কথা বলেন। সর্বত্র এই ছবি, আমাদের বাংলাতেও আমরা দেখেছি।
বাপ এম পি, ভাই এম পি, নিজে মন্ত্রী, নির্বাচনের আগে অমিত শাহের পায়ে হাত দিয়ে তৃণমূল সরকার কে, যে সরকারের তিনি মন্ত্রী ছিলেন কদিন আগে, সেই সরকার কে উৎখাত করার কথা আমরা শুনেছি, এক অশিক্ষিত অভিনেতা, এক লাখ মাইনে নিয়েছেন, নীল বাতি লাগানো গাড়ি নিয়েছেন, এক দালাল সাংবাদিক, কেবল দালালি করে এম এল এ হয়েছেন, নির্বাচনের আগে তাঁরা দেশের মানুষের আরও সেবা করার জন্য, চার্টার্ড ফ্লাইটে দিল্লি গিয়ে মানুষের সেবা করার জন্য দল বদলেছে্ আবার হেরে গিয়ে বেসুরো গাইছেন, আবার মানুষের সেবা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন, এসব আমরা দেখেছি। হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখেছি, কেন কাঁদছেন? তাঁকে টিকিট দেওয়া হয় নি, আহারে টিকিট পেলে, তবে তো মানুষের সেবা করা যায়, তো সেই টিকিট দেওয়া হয় নি, তাই হাউ হাউ করে কাঁদছেন, নিজের জন্য নয়, তিনি সেবা না করলে, মানুষের কী হবে? দলিত, পিছড়ে বর্গ, গরীব মানুষের কী হবে? কেউ কেউ তো আরেক ধাপ এগিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছেন, কোথায়? ঘরে? রাতের বেলায় গলায় দড়ি দিয়ে? না না, প্রকাশ্যে, মানুষের সামনে, সমর্থকদের সামনে, যাতে আত্মহত্যা হবার আগেই তারা আটকে দিতে পারে, তিনি বলবেন মুঝে মরনে দো, সমর্থকরা বলবেন, নঁহি নেতাজী, আপ সংঘর্ষ করতে রহো, নৌটঙ্কির শেষে তিনি অন্য কোনও দলে যোগ দেবেন।
এসব চলছে। ৪৭ সাল থেকে হরেক রং এর, হরেক কিসিমের দল, নেতা মানুষের বিশেষ করে গরীব মানুষের সঙ্গে থাকার ওয়াদা করেছেন, তাদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের কথা বলেছেন, ফল কী? হাতে নাতে ফল ফলেছে, দেশের ৮৩% সাংসদ কোটি পতি, দেশের ৭৬% বিধায়ক কোটিপতি, কাউন্সিলরদের কথা বাদই দিন, প্রাক্তন মেয়র জলশোভন চট্টোপাধ্যায় হিসেব কসে দেখিয়েছিলেন, সাংসদ বা বিধায়ক হবার থেকে কাউন্সিলর হওয়া কেন ভাল, অবশ্য বলার দরকারই বা কি ছিল? এক সাধারণ রেলের কেরাণির ছেলে কেবল জনগণের সেবা করে কমবেশী ৮০/১০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, গ্যারাজে মার্সিডিজ, বি এম ডাবলিউ, রেঞ্জ রোভার আছে, বাথরুমে জাকুজি, বলার দরকার ছিল না, উন্নতি তো দেখলেই বোঝা যায়। অন্যদিকে দেশ? দেশের মানুষ? এ বছরের অক্সফ্যাম রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, মাত্র কদিন আগেই। রিপোর্ট বলছে দেশের ৮৪% মানুষের আয় কমেছে, কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই আরও ৪০ জন ১০০ কোটি ডলারের মালিক হয়ে গেছে, একই সময়ে আপনার চাকরি চলে যাচ্ছে, মাইনে কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে মেগা বড়লোক তৈরি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : ইউ পি মে কা বা?
ভারতের সবচেয়ে ধনী ১০০ জনের, হ্যাঁ মাত্র ১০০ জনের সম্পদের পরিমাণ ৫৭.৩ লক্ষ কোটি টাকা, যথা যায়গায় প্রণামী দেবার পরেই এটা সম্ভব, তাঁরা সে প্রণামী দিয়েওছে, যে ছেলেটি বন্ধ ফ্যাক্টরির তামার তার বিক্রি করে সিনেমার টিকিট কাটতো, সে নেতা হয়েছে, তার বাড়িতে ৯ টা গাড়ি, তার সম্পদ ৮০/১০০ কোটি টাকা, সে এখন ব্যালকনিতে বসে গান করে সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, চাঁদ উঠেছিল গগনে, আপনারা তা শেয়ার করেন, ভাইরাল হয় সেই প্রেম ভিডিও। ২০২০ র মার্চে আপনার যা মাইনে ছিল, এখন তা কমেছে না বেড়েছে আপনি হিসেব করুন, কিন্তু ঐ সময়েই দেশের ১০০ কোটি ডলার ক্লাবের সদস্যদের মোট সম্পদ ছিল ২৩.১৪ লক্ষ কোটি টাকা, আর এই নভেম্বরে? সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩.১৬ লক্ষ কোটি টাকা।
আপনার মাইনে বাড়ছে না বা কমে যাচ্ছে, ওনাদের সম্পদ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে কোন ম্যাজিকে? কাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায়? প্রতিটা নীতি, প্রতিটা পরিকল্পনা, প্রতিটা আইন তাদের বড় হতে, ফুলে ফেঁপে উঠতে সাহায্য করছে, অন্যদিকে গারীব নিরন্ন মানুষ কে কিছুটা চাল, ডাল, গম, তাদের বাড়ির মেয়েদের কটা টাকা বা সাইকেল দিলে টিভি চ্যানেলে, কলতলার বৈঠকে, ঐ যে সরকার ভিক্ষে দিচ্ছে, এ দিয়ে কি আসলে উন্নতি হয়? চিল চিৎকার হচ্ছে। কৃষকদের সামান্য ঋণ মুকুব করার কথা উঠলে ভারি চিন্তিত হয়ে উঠছেন অর্থনীতিবিদরা, আহারে দেশের সম্পদ এভাবে বিলানো যায়? ওদিকে সারা বিশ্বে ঐ ১০০ কোটি ডলার ক্লাবে সদস্যদের মধ্যে ভারতবর্ষ তিন নম্বরে, দেশের ৫০% মানুষের মোট সম্পদ, জাতীয় সম্পদের ৬% মাত্র। তুমি তো প্রহর গোণও,
ওরা মুদ্রা গোণে কোটি কোটি।
তবু আজো বিস্ময় আমার –
ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস
তাদের করেছ ক্ষমা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ ।
তোমার ক্ষেতের শস্য
চুরি ক’রে যারা গুপ্তকক্ষতে জমায়
তাদেরি দুপায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়;
লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে
তুমি যে পেতেছ হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে
অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিষ্ফল –
তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল ।
তুমি তো প্রহর গোনো,
তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি,
তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে –
কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফের দুর্বিপাকে ।
সাধারণ মানুষের দুর্বিপাকে ঘুরে ফেরাই কি তাহলে শেষ কথা? তা তো হতে পারে না, এ অন্যায় বৈষম্য তো চিরকালীন হতে পারে না। গৌতম আদানির ২০২০ তে সম্পদ ছিল ৮৯০ কোটি ডলার, এক বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০৫০ কোটি ডলারে, কোন ম্যাজিকে? মুকেশ আম্বানির ৩৬৮০ কোটি ডলার বেড়ে হয়েছে ৮৫৫০ কোটি ডলার, কোন যাদুবলে? কাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায়? অন্যদিকে এই অতিমারির ভেতরেই, দেশের স্বাস্থখাতে ব্যয় কমেছে ১০%, শিক্ষা খাতে ব্যয় কমেছে ৬%, সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় হচ্ছে মোট ব্যায়ের ০.৬% সম্পদ। কেন?
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : মিনি সাধারণ নির্বাচন
আর এগুলো করার জন্য কি আকুলি বিকুলি, ২৪ কোটি টাকার গাড়ি কিনে ফেলেছেন, প্রধানমন্ত্রী, যাদের জন্য তিনি ২৪ ঘন্টা কাজ করেন, তাদের কেউ যেন তাঁকে মেরে না ফেলে, তাঁর জন্য তাঁর সুরক্ষা খাতে প্রতিদিন ব্যয় হয় ১.৬৩ কোটি টাকা, সেই প্রধানমন্ত্রী গঙ্গাজলে ডুব দিয়ে মানুষের উপকার করার কথা বলছেন, এম এল এ এম পি রা টিকিট না পেয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে, আমরা দেখছি। দেশের মিডিয়া, দেশের প্রতিটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, দেশের আমলা, পুলিশ, প্রশাসন, দেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের মুখে একই কথা, দলিত পিছড়ে বর্গ, গরীব মানুষের উন্নয়ন, অথচ প্রতিটা বছরের শেষে সম্পদ গিয়ে জমা হচ্ছে তাদেরই ঘরে, তাদের ব্যাঙ্কে উপচে পড়ছে টাকা, এই বৈষম্যের শেষ কোথায়? আবার সেই ২১ বছরের কবির কবিতাই মাথায় ঘুরছে, যক্ষার বীজ যাঁকে কুরে কুরে খেয়েছিল, তবুও মরা আগে তিনি লিখেছিলেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন,
আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়,
দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়;
আজকের নৈঃশব্দ্য হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি ।
দু হাতে বাজাও প্রতিশোধের উন্মত্ত দামামা,
প্রার্থনা করো :
হে জীবন, হে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা-
আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি,
প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
তুষার-গলানো উত্তাপ ।
টুকরো টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার
অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনী ।
শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে
একত্রিত হোক আমাদের সংহতি ।
তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর;
তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি তো মানুষ নও-
গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও ।
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল
দেয় তোমার মুখেতে অন্ন, বহুতে বল
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই ॥