ভারতবর্ষের গণতন্ত্র নিয়ে, নির্বাচন নিয়ে হাজার ঠাট্টা, হাজার মস্করার পরেও, এখনও, অবশিষ্ট গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের গর্ব করার জায়গা আছে বৈ কি। এখনও আমাদের দেশের নির্বাচনে অনেক টাকার খেলা, কোটি কোটি টাকার খেলা, অনেক ক্ষমতাসীন দলের গাজোয়ারি, অনেক বিক্রি হয়ে যাওয়া মিডিয়ার লাগাতার মিথ্যে প্রচারের পরেও, মানুষ সরকার বদলে দিচ্ছেন৷ মানুষ দেশের সংবিধানকে মাথায় রেখেই, দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রাখার জন্যই ভোট দিচ্ছেন৷ সবটাই রসাতলে চলে যায়নি৷ না মোদি–যোগী– শাহের হাজার ইচ্ছে সত্ত্বেও হয়নি, আরএসএসের দীর্ঘ পরিকল্পনার পরেও হয়নি।
হয়নি মানে কি হবে না? হয়নি মানে কি হওয়ানোর চেষ্টা চলছে না? চলছে, কিন্তু এখনও আমাদের সংবিধানের ওজনের থেকে সেই শক্তি, তাদের ষড়যন্ত্রের ওজন কম, তারা এখনও সফল হয়নি। তাই নির্বাচন এলেই সবচেয়ে দুর্বল দল, এক ব্যক্তি, এক নির্দল প্রার্থীও তাঁর কথা বলেন, আর গোদি মিডিয়া, বিক্রি হয়ে যাওয়া মিডিয়া, মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার অবহেলা সত্ত্বেও, তাদের স্বর শোনা যাচ্ছে। বহু আগে কমিউনিস্টরা, বামপন্থীরা বলতেন, নির্বাচন কেবল জেতা বা লড়াই নয়, নির্বাচন মানুষের সামনে মূল জরুরি বিষয় গুলো তুলে ধরারও এক ঠিকঠাক সময়৷ কোন জরুরি ব্যাপার? সেই ৪৭ থেকে রোটি, কপড়া, মকানের কথা বলা হচ্ছিল, সেগুলোই। কারণ ক্ষমতাসীন দল বা বিরোধী দলগুলোও, মাঝে মধ্যেই সেই ইস্যুগুলো থেকে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যায়, তুলে ধরে অন্য ন্যারেটিভ, অন্য ইস্যু। আর এসব আরও বেশি জরুরি হয়ে ওঠে নির্বাচনের সময়৷ যেমনটা আজও হচ্ছে।
এসে গিয়েছে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন৷ সবাই জানেন যে এই নির্বাচন ২০২৪-এর নির্বাচনের আগেই, দেশের আগামী রাজনৈতিক ছবি, দেশের আগামী রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। ৫ রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারের দামামা বাজালেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী৷ বারাণসী গেলেন, গঙ্গায় ডুব দিলেন, ৫৫ টা ক্যামেরায় তেনার এই হিন্দুপনাকে তুলে ধরা হল৷ তিনি ওই খান থেকে শিবাজি আর ঔরঙ্গজেবের প্রসঙ্গ তুলে নির্বাচনের সুর বেঁধে দিতে চাইলেন৷ অন্তত চেষ্টা করলেন। এরপরে যোগীজি ৮০ আর ২০% এর প্রসঙ্গ তুললেন৷ খুব পরিষ্কার করে বলতে চাইলেন, বলার চেষ্টা করলেন নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করার। এমনিতে বিষয়টা খুব কঠিনও নয়৷ ৪০৩ খানা আসন, এর আগেরবারেও একজন মুসলমান প্রার্থী দেয়নি বিজেপি৷ এবারেও দেবে না, কেন? কারণ খুব পরিষ্কার৷ তারা চায় নির্বাচন ধর্মের ভিত্তিতেই হোক৷ তাদের হয়ে পালাগানে মেতেছে হিন্দু ধর্মসভা, মুসলিম জেনোসাইডের কথা বলছে, হিন্দু খতরে মে হ্যায়, হিন্দু ধর্মের এই বিপদের দিনে হিন্দুরা এগিয়ে আসুন, কল্পিত শত্রু তৈরি হয়ে গেল৷ এবার সেই সাম্প্রদায়িক প্রচারকে তুঙ্গে তোলা হবে।
কিন্তু জটিলতা এখানেই, ওনারাও, ওই মোদি–যোগী– শাহেরা জানেন এটাই যথেষ্ট নয়, আরেক মুখে বিকাশের কথাও বলতেই হবে, সেই বিকাশের কথা যে গিয়েছে গরু চরাতে, সেই কবেই। তাই মাঠে রবি কিসন, সাংসদ, ভোজপুরি গায়ক অভিনেতা। গোরখনাথ মন্দির, রামমন্দির, অযোধ্যা, নরেন্দ্র মোদির হাঁটা চলা, যোগীর পুজো পাঠ সব নিয়ে গান, ইউ পি মে সব বা, সেখানে ভারত মাতা সিংহবাহিনী। যে কব্বো না রহল ওহ সব বা, ইউ পি মে সব বা। যা কখনও ছিল না, এখন তাই হয়েছে, ইউপি তে সব কিছু হয়েছে, নল পানি, রাস্তা রেল, কারখানা সব হয়েছে, বেকারের চাকরি হয়েছে, স্কুলে পড়াশুনো হয়েছে, ইউ পি মে সব বা, ইউ পি মে সব বা। তিনি হাঁটছেন, গেরুয়া পরে, স্যুট বুট পড়ে, আর হিস হিস করে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ইউ পি মে সব বা। রাতে গগলস পরতে এর আগে দেখেছিলাম অঞ্জন দত্তকে, এবার দেখলাম রবি কিসনকে, পেছনে অযোধ্যার রাত, মন্দিরে আলো, তিনি সামনে, চোখে গগলস। এবং শ্রীরামচন্দ্রের সামনে জয় শ্রীরাম বলে মনে করিয়ে দিলেন ইউ পি মে সব বা, এক রাম রাজ্যের কথা।
তথ্য কী বলছে? দেশের শিক্ষা তালিকায় সবথেকে তলায় এই উত্তর প্রদেশ, যোগীর ভয়ে নাকি করোনা চলে গিয়েছে, রবি কিসন তো তাই বললেন, তথ্য কী বলছে? সব্বাই দেখেছে সেই নদীতে লাশ ভাসার ছবি। মাই বহন কে জীবন বদল গই, হাথরসে দলিত ধর্ষিতা নারীর দেহ জ্বালিয়েছে পুলিশ, মাঝরাতে। ইউ পি মে সব বা।
একদিন পরেই এল নেহা সিং রাঠোরের গান, ভাইরাল হয়ে গেছে সারা দেশে, ইউ পি মে কা বা? ইউ পি তে কী আছে? নেহা হাথরসের কথা বলছেন, বিকাশের নামে মানুষ ঠকানোর কথা বলছেন, শিক্ষা নেই, চাকরি নেই এর কথা বলছেন, বলছেন লখিমপুর খেড়িতে গাড়ির চাকার তলায় কৃষকদেরকে পিসে মারার কথা, শুনুন।
(নেহা সিং এর গান)
না তিনি সমাজ বাদী দলের কেউ, না তিনি কংগ্রেস দলের কেউ, এক নাগরিক হিসেবে নিজের ইউ টিউবে গান আপলোড করেছেন, এখন ফোনও ধরতে পারছেন না, ফোনে ধমকি দেওয়া হচ্ছে, ওনার সোশ্যাল মিডিয়া পেজে অশ্রাব্য গালি গালাজ করা হচ্ছে, তবুও উনি প্রশ্ন করছেন, ইউ পি মে কা বা?
তার মানে কিছুটা হলেও মূল ইস্যুগুলো সামনে আসছে, বিকাশের সেই কল্পিত ফানুস, মানুষের চোখের সামনেই ফুটো হয়ে যাচ্ছে, উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে ঠিক এই কারণেই যোগী – মোদিকে নার্ভাস দেখাচ্ছে৷ এই আচমকা ইস্যু বদল তাঁদের কাছে বেশ অস্বস্তিকর। ৫ বছর রাজত্বের শেষে, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ সরকারের কাজকর্মের ওপর ভোট দেবে৷ ৫ বছরের কাজের খতিয়ান নিয়ে শাসক দল মাঠে নামবেন৷ কিন্তু ৫ বছরের বহু আগেই মোদি – যোগী বুঝেছেন, তাহলে ভরাডুবি নিশ্চিত, গোদের ওপর বিষফোঁড়া কৃষক আন্দোলন আর করোনার ভয়াবহ ছবি, তাই ক’দিন বিকাশ বিকাশ চেল্লানোর পরেই চেনা ছকে নেমে পড়েছেন তাঁরা৷ ভাবতেই পারেননি, যে তাঁদের সেট করা এজেন্ডা ক্রমশ তলিয়ে গিয়ে প্রবলভাবে সামনে এসে দাঁড়াবে ৫ বছরের হিসেব৷
এখন স্বয়ং যোগীজিও সেফ সিটের খোঁজে গোরখপুর রওনা দিয়েছেন, অযোধ্যা ছেড়ে। কিন্তু গোরখপুর কি সেফ সিট? সাধারণভাবে বলাই যায় গোরখপুর বিজেপির সেফ সিট, সাংসদ তাদের, আদিত্যনাথ যোগী ওই আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, একবার নয় তিন বার, তাঁর আগে ঐ গোরখপুর মঠের সন্ত অবৈদ্যনাথ সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, গোরখপুর মঠের ওই অঞ্চলে বিরাট প্রভাব প্রতিপত্তি আছে, যদি কোনও দিন গোরখনাথ মন্দিরে যান তাহলে দেখবেন, মন্দির চত্ত্বরে বিরাট লাইট অ্যান্ড সাউন্ড এর ব্যবস্থা আছে, গোরখনাথের কাহিনী, এবং সেই লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শেষ হয়, আদিত্যনাথ যোগীর ছবি দিয়ে, শিব বা গোরখনাথের ছবি ডিসল্ভ হয়ে আদিত্যনাথ যোগীর ছবি ভেসে ওঠে, মানুষ হাত জোড় করে প্রণাম করেন, কাজেই মনে হতেই পারে গোরখপুর সেফ সিট, কিন্তু, হ্যাঁ এখানে কিন্তু আছে।
২০১৭তে যোগীজী ভোটে দাঁড়াননি৷ প্রচারের মুখও ছিলেন না, তখন রাজ্য রাজনীতিতে মুখ রাজনাথ সিং, কেশব প্রসাদ মৌর্য্য, উমা ভারতী। নির্বাচনের পরে, হঠাৎ করেই এই হিন্দুত্বের পোস্টার বয়কে তুলে আনা হয়, তিনি সাংসদ পদ থেকে পদত্যাগ করে এম এল সি থেকে নির্বাচিত হন, মুখ্যমন্ত্রী হন। ঠিক এর পরেই গোরখপুরে তাঁর ছেড়ে দেওয়া সাংসদ আসনে বাই ইলেকশন হয়, সেখানে বিজেপি হারে, জিতে আসেন সমাজ বাদী পার্টির প্রবীণ কুমার নিষাধ, মানে মঠ ছিল, যোগীজী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তারপরেও সেখানে হারতে হয়েছিল। এই একবারই নয়, এর আগেও ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে।
ত্রিভুবন নারায়ণ সিং, কংগ্রেসের বড় নেতা ছিলেন, ইনি চন্দৌলি থেকে রাম মনোহর লোহিয়াকে হারিয়েছিলেন, বহু পরে এই বাংলার রাজ্যপালও হয়েছিলেন, ৭০ এ যখন কংগ্রেস ভাগ হল উনি ছিলেন আদি কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে, সেই সময় উত্তরপ্রদেশে জনসঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা, আদি কংগ্রেস মিলে ১৯৭০ এ সংযুক্ত বিধান পার্টি তৈরি হয়, ত্রিভুবন নারায়ন সিং হন মুখ্যমন্ত্রী। তিনিই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি এম এল এ বা এম এল সি ছিলেন না, তো তাঁকে ৬ মাসের মধ্যে হয় এম এল এ বা এম এল সি হতেই হত, তাঁর জন্য সেফ সিট খোঁজা শুরু হল, সেই সময় গোরখপুর মঠের প্রধান অবৈদ্যনাথ, গোরখপুরেরই মনিরাম বিধানসভার সদস্য ছিলেন, হিন্দু মহাসভার সদস্য, তিনি তাঁর আসন থেকে পদত্যাগ করে, সেই আসনে টি এন সিংকে ছেড়ে দিলেন, সেফ সিট। ১৯৭২ এ বাই ইলেকশনে কংগ্রেস থেকে দাঁড়ালেন আর কে দ্বিবেদী, এবং সম্ভবত এই প্রথম বাই ইলেকশনে প্রচারে এলেন প্রধানমন্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী। নেহরু বেঁচে থাকতে বাই ইলেকশনে প্রচার করেন নি, অন্যদিকে গোরখপুর মঠ দাঁড়িয়েছিল টি এন সিং এর পেছনে, সে যাই হোক, মুখোমুখি দুই নেতা, দুজনেই আবার সাংবাদিকও বটে। মুখ্যমন্ত্রী ত্রিভুবন নারায়ণ সিং হেরেছিলেন, বিরাট ভোটেই হেরেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগও করতে হয়েছিল, মানে গোরখপুর যোগীজির সেফ সিট, এটা হলফ করে বলা যাবে না।
তার ওপর আপাতত সমস্যা তিনি যে গোরখপুর সদর আসনে লড়ছেন, সেখানে আগের বিজেপি বিধায়ক রাধামোহন দাস অগ্রওয়াল টিকিট পাননি৷ অখিলেশ যাদব বলেই দিয়েছেন, উনি সমাজবাদী দলে আসলে, তাঁকেই ওই আসনে দাঁড় করানো হবে, কাজেই সে এক সমস্যা। তারপর আছে ডঃ কাফিল খান বৃত্তান্ত, আপনারা সব্বাই জানেন, নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে, শিশুদের জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করার পর যোগী সরকার তাঁকে জেলে পুরছিল, সেই এপিসোড মানুষ ভোলেনি, এবং পাঁচ বছর রাজত্বের পরে, ইউ পির মানুষজনের প্রশ্ন তো আছেই, প্রশ্ন করছেনও, ইউ পি মে কা বা? জিন্দেগী ঝন্ড বা, ফিরভি ঘমন্ড বা?