বিজেপির মনেই হয়েছিল তারা বাংলা দখলের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তারা তাদের সবক’টা তাস সামনে ফেলে দিয়েছিল, সবচেয়ে বড় তাস ছিল দলবদল। টালিগঞ্জের কচিকাঁচা থেকে শুভেন্দু অধিকারী পর্যন্ত শিবির পাল্টে জয় শ্রীরাম। সে এক সময়, বাংলার রাজনীতিবিদদের তেমন সুখের দিন তো কোনওদিনও ছিল না, রাজনীতিতে নামার আগেই বা সদ্য নেমেই চার্টার্ড প্লেনে চেপে দিল্লি, তাও আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মোলাকাত। এদিকে কিছু নির্বাচনী পণ্ডিতের দল সেই স্বপ্ন স্বপ্ন খেলাতে আরও ঘি ঢাললেন, বিজেপি ২০০ তো পাবেই, বাম কংগ্রেস ৫০-৬০ তো বটেই, থাকল কী পড়ে? ব্যস, লাল পড়তে থাকা আগ্রাসী ধান্দাবাজের দল কোন মন্ত্রিত্ব পাবে তাই নিয়েই আলোচনায় মত্ত, পেলে কাকে কাকে কড়কে দেবে তারও লিস্ট তৈরি হয়েছিল। হ্যাঁ, বিজেপির কাছে সবথেকে বড় তাস ছিল দলত্যাগ, আর দু’ নম্বরে বিপুল পয়সা, তিন নম্বরে সংগঠিত প্রচার বাহিনী। সেদিনের লড়াই জিতে আজকের বাংলার শাসকদল তাদের স্ট্রাটেজি ঠিক করেই ফেলেছিল, দলত্যাগ করার মতো অবস্থা আর তৈরি হবে না এবং ওই প্রচার খরচে যেন কমতি না পড়ে। হ্যাঁ, তৃণমূল বিজেপির পরে অন্যতম বড় দল যারা বিরাট কর্পোরেট ডোনেশন পেয়েছে। এবং প্রচারের জন্য আই প্যাক, রাজ্য জুড়ে শ’ পাঁচেক ছেলেমেয়ে ঘুরছে প্রতি নিয়ত রাজনৈতিক প্রত্যেকটা ইকুয়েশন সামাল দেওয়ার জন্য, খবর পৌঁছে যাচ্ছে উপরতলায়, এক গোষ্ঠীর খবর নয়, বিশ্বাসযোগ্য ইনপুট। এর উপরে তৃণমূলের আছে বাঙালি আইডেন্টিটি, বাংলার মেয়ে মমতা, কেন্দ্রের বঞ্চনা, রাজ্য জুড়ে বিরাট ডায়রেক্ট বেনিফিসিয়ারির সমর্থন। এবং যত লোকসভার ভোট এগিয়ে আসছে, ততই বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি এই বাংলা থেকে আসন বেশি পাওয়া তো দূরস্থান, চার পাঁচটা পাবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, এই বাংলায় ২০২৪-এর নির্বাচনে বিজেপি ক্রমশ পিছচ্ছে।
ধূপগুড়ির চেহারা দেখুন, সেখানে ঠিক করে প্রচারেই নামতে পারেনি বিজেপি, কেন? কারণ বিজেপির স্থানীয় নেতৃত্ব প্রার্থী নিয়েই সন্তুষ্ট নয়। আমাদের রাজ্যে দেশপ্রেমটা নেতাজিকে দেখে, সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, বিনয়-বাদল-দীনেশকে দেখে জাগে, জংলা পোশাক পরা মিলিটারিকে দেখে নয়। পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচলপ্রদেশ, রাজস্থানে শহীদ সেনার বিধবা স্ত্রী যে আবেগ তৈরি করে তা আমাদের এখানে করে না, এটা বাস্তব। ধূপগুড়িতে শহীদ সেনার প্রার্থী কলকাতায় দলের অফিসে বসে তাঁর প্রয়াত স্বামী কোথায় মারা গিয়েছিলেন তাও বলতে পারলেন না। স্থানীয় নেতারা বলছেন, এঁকে নিয়ে মানুষের সামনে যাব কী করে? উনি তো কথাও বলছেন না। অন্যদিকে স্থানীয় নেতাদের দু’ একজনের টিকিটের দিকে চোখ ছিল বইকী, তাঁরা তলায় তলায় কাজ শুরু করে দিয়েছেন। যা চলছে তাতে এই উপনির্বাচনে বিজেপি ১৮-২০ হাজার মার্জিনে হারলেও অবাক হব না। এবং এটাই দেখিয়ে দেয় যে উত্তরবঙ্গে বিজেপির জমিতে কতটা ধস নেমেছে।
অনন্ত মহারাজ পার করে দেবেন? এ কি ভোলেবাবা নাকি? পার করেগা বললেই পার করেগা? বিজেপি রাজবংশী ভোট পাওয়ার জন্য আজ নয়, বহুদিন ধরেই এই মহারাজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, তাতে কি পঞ্চায়েত ভোটে কোনও সুবিধে হয়েছে? এবং উত্তরবঙ্গের আদিবাসী মানুষজন মুখ ফিরিয়েছেন বিজেপির দিক থেকে, কেবল আলিপুরদুয়ারের ভোট দেখলেই সেটা বোঝা যায়। সেখান থেকে তেমন কোনও রিগিং ইত্যাদির খবর তো আসেনি। কিন্তু দুটি পাতা একটি কুঁড়ির বাসিন্দারা, চা বাগানের আদিবাসীরা ঢেলে ভোট দিয়েছে তৃণমূলকে। রইল বাকি মধ্যবঙ্গ, সেখানে যেটুকু লড়াই তা আর বিজেপির সঙ্গে নয়, কংগ্রেসের সঙ্গে আর সেই জন্যেই ইন্ডিয়া জোট নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১০০ শতাংশ কমিটেড। উনি জানেন এই জোট গড়ে উঠলে তিনি তার অন্যতম শরিক হবেন, তাঁর বিজেপি বিরোধিতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকবে না, কাজেই মুসলমান ভোটের যেটুকু ক্ষয় তা আটকানো যাবে। আর যদি তাঁর শর্তে বাংলায় কংগ্রেস তৃণমূল জোট হয় তাহলে তো আরও ভালো, দু’ একপিস কৌস্তভ বাগচী কী বলল তা নিয়ে কংগ্রেসের কোনও মাথাব্যথা আজ নেই, কোনওদিনও ছিল না। এমন প্রতিবাদীরা হয় বিজেপিতে যাবে না হলে হাইকমান্ডের কথা গিলে লক্ষ্মীছেলে হয়ে বসে থাকবে। তাই ক’দিন আগে ওপিনিয়ন পোলে যেমনটা বলা হল যে তৃণমূল ২৮টা বিজেপি ১৪টা আসন পাবে, তেমনটা নয়। আমাদের মাটির খবর বলছে তৃণমূল ৩১-৩২টা আসন পাবে, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হলে কংগ্রেস গোটা তিন, তৃণমূল ৩৪, বিজেপি বড়জোর পাঁচটা আসন পাবে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ বাংলাতে তৃণমূল আর কংগ্রেস জোট হলে ২০২৪-এ ৪২টা আসনের মধ্যে কতগুলো আসন তৃণমূল, কতগুলো আসন বিজেপি পাবে বলে আপনাদের মনে হয়? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
হ্যাঁ, হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের স্লোগান দেওয়া বিজেপির সঙ্গে লড়তেই মমতা পুরোহিত মোয়াজ্জেমদের ভাতা বাড়াচ্ছেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে সরাসরি লাভবান হচ্ছেন প্রান্তিক মানুষজন, স্বাস্থ্যসাথীর কোনও অনিয়ম দেখলে মুখ্যমন্ত্রী নিজে হস্তক্ষেপ করছেন আর এসবের সঙ্গেই বাংলার আইডেনন্টিটি পলিটিক্সে নতুন করে বাংলা দিবস হবে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাংলার নাগরিকদের এক বাঙালি আইডেন্টিটি দেওয়ার আর এক প্রচেষ্টা। সব মিলিয়ে ২০২৪ বিজেপির কাছে ক্রমশ দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে।