প্রসঙ্গ ২০২৪ এর আজ তৃতীয় এবং আপাতত শেষ পর্ব, তার আগে গত দু’দিন যা বলেছি, তা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। তিনটে প্রশ্ন, এক, মোদিজি কি অপরাজেয়? প্রশ্ন দুই, কিভাবে তাঁকে হারানো যাবে? বা তিনি কিভাবে হারবেন? প্রশ্ন তিন, কে হবেন পরের মুখ, কার নেতৃত্বে তাঁকে হারানো যাবে? উত্তর এক, আপাত গণতন্ত্রও যে দেশে আছে, সেখানে কোনও দল, কোনও নেতা অপরাজেয় নন। তাহলে বাকি দুটো উত্তর নিয়েই আমরা আলোচনাটা এগিয়ে নিয়ে যাব, তার প্রথমেই আমরা বলেছি, এখনও হাতে ২০% ভোট থেকে যাওয়া কংগ্রেস দলকে বিরাট ভূমিকা নিতে হবে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের সে ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বিজেপির মধ্যে ভাঙন, তাদের সংগঠনে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে, মোদি – শাহের উত্থান এক পতনের বীজ বপন করেছে।
অন্যদিকে আরও তীব্র হিন্দুত্বের ঝান্ডা নিয়ে হাজির, আদিত্যনাথ যোগী, ক্রমশ হয়ে উঠছেন পালটা মুখ, অন্য এক ক্ষমতার ভর কেন্দ্র, যার জন্যই আর ৮ জন মুখ্যমন্ত্রীকে অনায়াসে সরিয়ে, হঠাৎই নতুন আনকোরা মুখ এনে হাজির করতে পারলেও যোগীজিকে সরানোর কথা ভাবলেও, মোদি অমিত শাহ শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে এখন বাড়াবাড়ি রকমের যোগী প্রশংসায় নেমেছেন, ফলে দলের মধ্যে মোদি – অমিত শাহ বিরোধী, এক নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ যদুবংশের মত ধ্বংসের বীজ লুকিয়ে আছে, বিজেপির মধ্যেই। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়, আরও কিছু আছে যা বিজেপির পতনকে সুনিশ্চিত করবে। তার প্রথমটা হল, আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক চেহারা। দ্বিতীয় হল, ক্রমশ শরিক দল এবং তাদের সমর্থন কমে যাওয়া। তৃতীয় হল, অত্যন্ত সংগঠিত শক্তি হিসেবে উঠে আসছে রিজিওনাল দলগুলো, তৃণমূল, আরজেডি, সমাজবাদী দল, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, ডিএমকে, শিবসেনা, আপ, বিজু জনতা দল, এনসিপি, ঝাড়খন্ড পার্টি ইত্যাদি। চতুর্থ হল, বিজেপির বিপুল অর্থবল।
কেবল মুসলমান ভোট নয়, একদা বিজেপির সঙ্গে ছিল না দলিত, ওবিসি ভোট। ২০১৪ এবং পরে ২০১৯ এর ভোটিং প্যাটার্নের দিকে যদি তাকান, তাহলে দেখবেন, বিজেপি বানিয়া ঠাকুরদের দল, এই বদনাম কাটিয়ে দলিত, ওবিসি ভোটের এক বিরাট অংশে থাবা বসিয়েছে। এটাই ছিল বিজেপির বিরাট জয়ের কারণ। এই দলিত ওবিসি ভোট না পেলে ৩০৩ কেন? ২৫০ আসনও জেতা অসম্ভব ছিল মোদিজির। এরা এল কেন? এই বিপুল ভোটের শিফটের কারণ কী? কোন সময় এই ভোট শিফট হল? আসলে কংগ্রেস দলিত আর আদিবাসী ভোটকে তাদের সম্পত্তি বলে মনে করেছে চিরটাকাল, ও তো আমাদেরই ভোট দেবে। মণ্ডল কমিশন বা সংরক্ষণ আন্দোলন এসে চুরমার করে দিল সেই ধারণা, হঠাৎই দলিত আদিবাসী, ওবিসি ভোট হয়ে উঠল প্রত্যেক দলের কাছে অমূল্য সম্পদ, গোল্ড রাশ। কিছু দলিত, ওবিসি নেতা গজিয়ে উঠলেন, দিকে দিকে, রাজ্যে রাজ্যে, কেউ কেউ ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেন, তাদের ছত্রছায়ায় কিছু ওবিসি, দলিত মানুষ তাদের হাতে ক্ষমতা পাবার কথা দশমুখে জাহির করতে লাগলেন, একধরণের ক্ষমতায়ন হল, হম ভি কম নঁহি। কিন্তু অচিরেই ওই বিপুল সংখ্যক দলিত ওবিসি মানুষজন বুঝতে পারলেন, তাদের সামনে রেখে কামিয়ে নিচ্ছে কিছু নেতা। ইতিমধ্যে তাঁদের ঘরের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে দলিত ওবিসি সমাজে বোধবুদ্ধি বেড়েছে, ঠিক সেরকম সময়ে তাঁদের কাছে এল পার্টি উইথ অ্যা ডিফারেন্স, বিজেপির আহ্বান, মোদিজির আহ্বান, এক চায়ওলার আহ্বান।
লালু যাদব গরু দুইয়ে দেখাতেন, দেহাতি ভাষায় কথা বলতেন, জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, নরেন্দ্র মোদি তিনটে অস্ত্র নিয়ে নামলেন, প্রথম হল, আপনারাও হিন্দু, দুসাধ, বাল্মিকী, নিষাদ, পাশোয়ান হলেও আপনারা হিন্দু, এক হিন্দু সম্মেলনের প্রশ্ন। দ্বিতীয় হল, আমি চায়ওয়ালা, চা বিক্রি করেছি, আমি তোমাদেরই লোক। তৃতীয় হল, আকন্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা সেই রাজনৈতিক পরিকাঠামোতে, ন খায়েঙ্গে, না খানে দেঙ্গের শ্লোগান, মোদ্দা কথা অচ্ছে দিন। দলিত, ওবিসি মানুষজন লুফে নিলেন, ঝোলা ভরে ভোট দিলেন মোদিজিকে, শ্লোগান উঠল, মোদি হ্যায়, তো মুমকিন হ্যায়। খানিকটা আমাদের মুম্বইয়ের স্বপ্ন ফেরি করা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মত। মোদিজি তখন স্বপ্ন ফেরি করছেন, আর কে না জানে স্বপ্নের পোলাওতে কেউ ঘি কম দেয় না, কারণ তাতে খরচ নেই। সাল মে দো করোড় কা নোকরি, সবকে হাত মে পন্দরা পন্দরা লাখ রূপেয়া, ফাইভ ট্রিলিয়ন ইকোনমি, কালা ধন ওয়াপস লায়েঙ্গে, লোহা গরম ছিল, হাথৌড়া মারা মোদিজি, ফুল্টস বলে ছক্কা। তারপর? চাকরি দেওয়া দূরস্থান, গত ৪০ বছরে রেকর্ড বেকারত্ব, পেট্রোল ডিজেল থেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে তার ছিটেফোঁটা গরীব মানুষের হাতে দিলেও, ততদিনে মূল্যবৃদ্ধি, হাতে পাওয়া সেই পয়সাকে বোঝারও সময় দিচ্ছে না। উজ্জ্বলা যোজনা ঢাক পিটিয়ে শুরু করার পর এখন খোঁড়াচ্ছে, ব্যয় বরাদ্দই কমানো হচ্ছে, শিল্পে মন্দা, এমএসএমই সেক্টর ধুঁকছে, ছাঁটাই লে অফ চলছে। সেই যারা অচ্ছে দিনের কথা শুনে এসেছিলেন, তাঁরা হতভম্ব, তাঁরা ক্ষুব্ধ, তাঁদেরই বিরাট অংশ লকডাউনে অনাহার দেখেছেন, মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেছেন, ছেলে চাকরি করছিল, চাকরি গেছে, তাঁদের বাড়ির লোকজনের শবদেহ ভাসাতে হয়েছে নদীর জলে। তাঁদের এক বিরাট অংশ কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন, তাঁদের বোকা বানানো হয়েছে, অচ্ছে দিন তো দূরস্থান, আগের সুখটুকুও গেছে, এই সংখ্যাটা কম নয়, এদের ভোট কম নয়।
অন্যদিকে মুসলিম ভোট, কংগ্রেসের কাছ থেকে তো গেলো, এলো কোথায়? বিজেপিতে তো নয়। দেশজোড়া মুসলিম ভোট শত ভাগে ভাগ হয়ে বিভিন্ন বিরোধী দলের কাছে গিয়েছিল, বিজেপির তীব্র বিষ, তাদের হুঁস ফিরিয়েছে, তাঁরা পরিস্কার বুঝতে পেরেছেন, যেখানে যে বিজেপিকে হারাবে, সেখানে তাঁদের বাক্সে ভোট দিতে হবে। প্রমাণ? বাংলায় মুসলিম ভোট সিপিএম বা কংগ্রসে যায়নি, সাব্বাস আব্বাস বলে কমরেড সেলিম সাহেব এক মুসলমান পিরজাদাকে হাজির করলেও মুসলমান ভোট কংগ্রেস বা সিপিএমের ঝোলায় যায়নি, স্ট্রাটেজিক ভোট, ডিএমকে পেয়েছে মুসলিম ভোট, দিল্লিতে আপ পেয়েছে, অন্ধ্রে জগন রেড্ডি, তেলেঙ্গানাতে টিআরএস পেয়েছে, যদি ইউপিতে সপা এগিয়ে থাকে তাহলে তারাই এই মুসলিম ভোট পাবে, বিএসপি’র ভোট আরও কমবে, বাংলার নির্বাচনের শিক্ষা। অন্যদিকে, দেশের কৃষক রাস্তায়, লক্ষ লক্ষ কৃষক, ওদিকে বিভিন্ন সেক্টরের অর্গানাইজড শ্রমিক, আনর্গানাইজড শ্রমিক ফুঁসছে, তার প্রভাব ভোটবাক্সে পড়বে বৈকি। দ্বিতীয় কারণ যা বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব ফেলবে তা হল শরিক দলদের সরে যাওয়া, কেবল শিবসেনা বা আকালি দল নয়, বিজেপির শরিক দল কমতে কমতে নীতীশের জেডিইউ, ইউপিতে অপনা দলে এসে ঠেকেছে। এনডিএ’র সেই অর্থে কোনও অস্তিত্বই নেই, যে শরিক দলের কাঁধে ভর দিয়ে মোদিজি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই শরিকদল আজ তাঁর বিরোধী, তাঁদের জাত, গোষ্ঠির ভোট ব্যাঙ্ক বিজেপির হাতের বাইরে।
তৃতীয় হল আঞ্চলিক দলের ক্ষমতা বেড়ে যাওয়া, বাংলায় ২০২৪ এ বিজেপির টার্গেট ৪২ নয়, ছ’টা কি সাতটা আসন, তাও নিশ্চিত নয়, উত্তর প্রদেশে যা ২০১৯ এ পেয়েছে, তার অর্ধেক পেলেও বিজেপি খুশি হবে, মহারাষ্ট্রে মহারাষ্ট্র আগাড়ির সঙ্গে লড়াইয়ে অনেক অনেক পিছিয়ে বিজেপি। দিল্লিতে একটা আসন পেলেও যথেষ্ট, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, ঝাড়খন্ডেও তাই, তামিলনাড়ুতে স্তালিন ক্রমশ ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। বিহার, গুজরাটে প্রায় সমান সমান, কেরালায় কোনও প্রশ্ন নেই, ত্রিপুরা হাতের বাইরে চলে গেছে বললে কম বলা হয়। ওড়িশায় বিজেডিই সিংহভাগ পাবে এবং বিজেপি ২২০ র তলায় গেলে নবীন পট্টনায়ক সেকুলার সরকারের কথা বলবেন, ওটা ওড়িশার রাজনীতি। ছত্তিশগড়, রাজস্থান, হরিয়ানাতে কংগ্রেস ভাল ফল করবে, পঞ্জাবে হয় আপ না হলে কংগ্রেস, গুজরাটে কংগ্রেস আগের থেকে ভাল ফল করবে। কেবল গুজরাট বিজেপির দলের মধ্যে ঝগড়ার ফলেই বেশ কিছু আসন হারাবে বিজেপি। কর্ণাটকে লিঙ্গায়েত ভোট পুরোটাই বোম্মাইয়ের সঙ্গে থাকবে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই, মধ্যপ্রদেশে কাঁটে কা টক্কর, সব মিলিয়ে বেশিরভাগ বড় রাজ্যে হয় রিজিওনাল দল, না হলে কংগ্রেস এগিয়েই থাকবে, এবং এখানেই লুকিয়ে আছে, বিজেপির বিপদ। মানে আমাদের দেশের ফেডারেল স্ট্রাকচার, এবার অন্য নির্বাচনের চেহারা নিয়ে হাজির হবে, নির্বাচনটা কোনও কেন্দ্রীয় শ্লোগান, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে হবে না, এটা নিশ্চিত। মোদিজিকে বাংলায় মমতার সঙ্গে লড়তে হবে, বিহারে আরজেডির সঙ্গে, দিল্লিতে আপের সঙ্গে, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা-কং-এনসিপি জোটের সঙ্গে, তামিলনাড়ুতে ডিএমকের সঙ্গে, উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের সঙ্গে, অন্ধ্রে জগন রেড্ডির সঙ্গে, তেলেঙ্গানায় টিআরএসের সঙ্গে লড়তে হবে। প্রত্যেকটা লড়াই কঠিন হয়ে উঠছে ক্রমশ, আর সেটাই বিরোধী দলের যে কোনও আলোচনায় উঠে আসছে। যে যার রাজ্যে বিজেপিকে হারান, পরে বাকি হিসেব বুঝে নেওয়া যাবে।
এবার চতুর্থ বিষয়, বিজেপির অর্থবল। কেন এত পয়সা আসে বিজেপির কাছে? কারা দেয়? উত্তর শিল্পপতিরা দেয়, সবার জানা। এই শিল্পপতিরা কি বিজেপির আদর্শে বিশ্বাস করে টাকা দেয়? এক্কেবারেই না, এমন কি আদানি, আম্বানিও টাকা দেয়, তাঁদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য। তাঁরা যে যেখানে ক্ষমতায় থাকে তাঁকেই টাকা দেয়, এটাই দস্তুর। কেন্দ্রে আছে বিজেপি সরকার, তারা টাকা পাবে, তাদের জয়রথ ছুটছিল সারা দেশ জুড়ে, যা এখন আটকে গেছে বাংলায়, তামিলনাড়ুতে, দিল্লিতে। তাহলে বিরোধী শাসিত এই রাজ্যের দলগুলো টাকা পাবে না? দেশের শিল্পপতিরা কি জানে না, হলেও হতে পারে পরিবর্তন? তাঁরা সেই হিসেব করেই এবার টাকা দেবে, বিজেপির কাছে টাকা যাবে নিশ্চিত, কিন্তু বিরোধীদের কাছেও যাবে এটাও হলফ করে বলা যায়, আগের থেকে অনেক বেশিই যাবে, কাজেই এবার লড়াই হবে। ভারতবর্ষের ফেডারেল স্ট্রাকচারের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, বিজেপির পতনের কারণ। কেবল দেখার সেই পতনের মাত্রা কতখানি, যত দিন যাবে, আমি নিশ্চিত, সেই পতনের চেহারা আরও স্পষ্ট হবে।