মধ্য ষাট থেকে আমাদের দেশে রাজনৈতিক জোটের সংস্কৃতির শুরুয়াত। কেন জোট? উত্তরে নানান আদর্শ, দর্শনের কথা বললেও এটা সেদিন বা আজও পরিষ্কার, জোট করে ভোট বাড়ানোই হল লক্ষ্য। ধরুন সেই কবে ১৯৬৭-এ বিভিন্ন দলের বিধায়করা জোট বাঁধলেন। কেন? কেন আবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে? কংগ্রেসকে সরিয়ে সরকার তৈরি করবেন বলে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭, আবার জোট, এবারে ইন্দিরা হটাও। ইন্দিরা তো হটে গেল, কিন্তু মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখেছে, প্রধানমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রীপদ নিয়ে কী নোংরা খাওয়াখাওয়ি। মানুষ দেখেছে এবং বুঝেছে বলেই তিন বছরের মধ্যে আবার ইন্দিরার প্রত্যাবর্তন। তারপর রাজীবের বিরুদ্ধে আবার জোট, এবার জোটের একদিকে বিজেপি, অন্যদিকে কমিউনিস্টরা। বুঝতেই পারছেন কী অসামান্য নির্লজ্জ রাজনৈতিক সুবিধাবাদের ছবি। এবং ভিপি সিংহের সরকার ৩৪৩ দিনের, মানে একবছরও নয়, চন্দ্রশেখরের সরকার ২২৩ দিনের। এরপর আবার মিলিজুলি অকংগ্রেসি, অবিজেপি সরকার প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া ৩২৪ দিনের সরকার, ওনার পরে আইকে গুজরাল ৩৩২ দিনের। এরপরেও জোট সরকার হয়েছে কিন্তু সেখানে মূল দল ছিল হয় কংগ্রেস না হলে বিজেপি। ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে ছবিটা এক্কেবারে আলাদা। ২০১৯-এর ৩০৩ বিজেপি সাংসদ নিয়ে নরেন্দ্র মোদির আবার ক্ষমতায় আসার পরে যেভাবে বিরোধী দল বা নেতাদের পেছনে ঘুরছে সিবিআই, ইডি, ভিজিলেন্স, তাতে বিরোধীরা বুঝেছেন জোট বেঁধে মোদিকে না সরালে অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি হবেন তাঁরা। কাজেই আবার জোট আর তা নিয়েই বিষয় আজকে, আবার জোট, জোটের ভোট।
তো নীতীশ কুমার এলেন, দেখা করলেন, খুব কম সময়ের জন্য বৈঠক, সঙ্গে তেজস্বী যাদব। মমতা এবং নীতীশ সাংবাদিকদের মুখোমুখিও হলেন। আবার জোট, এবার জয়প্রকাশ ধাঁচের, বললেন মমতা, শুরু হোক বিহার থেকে, তাও বললেন। তার মানে আগামী কিছুদিনের মধ্যে বিরোধী দলের নেতাদের বিহারের রামলীলা ময়দানে দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু জয়প্রকাশ? একজন নেতা যিনি কোনওদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপস করেননি, ক্ষমতার জন্য আপসের প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর সঙ্গে তুলনা নীতীশ কুমারের? যিনি বিহারে আপাতত পাল্টিকুমার নামে পরিচিত? বাংলার মানুষরা কি ভুলেই গেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগের পরে নীতীশ রেলমন্ত্রী হয়ে বেশ কিছু বাংলার প্রকল্প বাতিল করেছিলেন? তা নিয়ে সংসদে মমতা নীতীশ দ্বৈরথ ভুলেছি আমরা? আজ সেসব অতীত। আপাতত জোট। পরস্পর বিরোধী দলের জোট। কেরলে কংগ্রেস সিপিএম লড়াই, বাংলায় বাম-কং জোটের সঙ্গে তৃণমূলের লড়াই, দিল্লিতে আপ-কং লড়াই, পঞ্জাবে আপ-কং, তেলঙ্গনায় বিআরএস-কং লড়াই কিন্তু তাঁরাই জাতীয় রাজনীতিতে জোট বাঁধবেন।
আরও পড়ুন: Aajke | নবজোয়ারের গল্প
সিপিএম নেতা সুজন আজই বললেন, নীতীশ এ রাজ্যে এলেন জেনে নিতে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা? তিনি বিজেপির হয়ে কাজ করছেন না তো? এই একই অভিযোগ এ রাজ্যের কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ রাজ্যে কংগ্রেস সিপিএম আর বিজেপিকে জগাই মাধাই আর গদাই বলেন, তাও আমরা জানি। কিন্তু এরপরেও যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে মমতা নীতীশ জানালেন জোট হবে, হারাতেই হবে বিজেপিকে। জানালেন দুজনেরই কোনও ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, মানে এই দুজনেই প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার নয়, বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হাটানোর জন্যই তাঁরা একমঞ্চে আসতে চান। ওনারা যা বললেন, তা মানুষ বিশ্বাস করেন? আচ্ছা মানুষ কী মনে করেন? আবার বিরোধী জোটের কথা বলা হচ্ছে, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? মমতা নীতীশ কি এক ঐক্যবদ্ধ বিরোধী জোট গঠন করতে পারবেন?
একবার ১৯৭৭-এ একবার ১৯৮৯-এ মানুষ বিরোধী জোটকে ভোট দিয়েছিল, এই জন্য নয় যে বিরোধী দলেরা একমঞ্চে এসে হাত ধরাধরি করে হাজির হয়েছিলেন, এই জন্যও নয় যে বিরোধীরা জোট করলেই মানুষ তাঁদের ভোট দেবেন। আসলে ১৯৭৭-এ মানুষ ভোট দিয়েছিল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, স্লোগান উঠেছিল, হিটলারশাহি নহি চলি যব ইন্দিরাশাহি নহি চলেগি। জরুরি অবস্থা জারি না হলে, দিল্লির তুর্কমান গেটে গরিব মানুষদের জুগগি ঝোপড়ি ভাঙা না হলে, পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে জোর জবরদস্তি না করা হলে ইন্দিরা হারতেন না। ঠিক সেই রকম ১৯৮৯-এ মানুষ মনে করেছিল যে বোফর্স চুক্তিকে ঘিরে এক দুর্নীতি হয়েছে, সে দুর্নীতির জন্য রাজীব গান্ধী দায়ী, কাজেই ৪০৩ সাংসদ পাওয়া রাজীব গান্ধী বা কংগ্রেস হেরেছিল বিরোধী ঐক্যের জন্যই নয়, দুর্নীতির ইস্যুটাকে বিরোধীরা মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পেরেছিল। হ্যাঁ, সেদিন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির জয়প্রকাশ ছিলেন নেতৃত্বে বা ছিলেন ভিপি সিংয়ের মতো নেতা, কিন্তু সেটাই সব নয়, আসল বিষয় ছিল ইস্যু। আজও সেটাই বিষয়। নীতীশ মমতা কেজরিওয়াল তেজস্বী স্তালিন এক হলেন আর বিজেপি হেরে যাবে তা নয়, বিজেপি যদি হারে তা হলে হারবে জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবিতে, যদি বিজেপি হারে তাহলে হারবে দেশের কোটি কোটি বেকার যুবকের চাকরির দাবিতে, যদি বিজেপি হারে তাহলে জানবেন মানুষ তাদের ধর্মের ভিত্তিতে ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। তাহলে নীতীশের কি কোনও ভূমিকাই নেই? আছে বইকী, বিরোধীদের মধ্যে উনিই একমাত্র নেতা যাঁর নামে আজকেও মোদি-শাহ একটা সিবিআই বা ইডির কেস দিতে পারেননি। অর্থাৎ পাল্টিকুমার বা সুশাসনবাবু যাইবলুন নীতীশকে, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ছাপ নেই। মোদিজি বলার চেষ্টা করবেন যে সব দুর্নীতিবাজরা একজোট হচ্ছে, বলবেন, কিন্তু নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে সে অস্ত্র কাজ করবে না। সেই জন্যেই কি নীতীশ অ্যাডভানটেজ?