কোকো লে গয়া, রাকেশ টিকায়েত বললেন, বিজেপি কা ভোট কোকো লে গয়া। আমাদের ছোটবেলায় আমরা এই কথা কমবেশি সকলেই শুনেছি, হয়তো চানের সময় হয়ে গেছে, হয় তো খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, আমি তখনও খেলছি, আমার হাতে পুতুল, মা বা রাঙা কাকা, ছোটকা ঐ পুতুলটা হাতে নিয়ে হাতটা ঘোরাতেন, ব্যস, পুতুল হাওয়া, পুতুল আর নেই, কাকে নিয়ে চলে গেছে, সেই অদৃশ্য কাককে দেখা যেত না, কিন্তু জেনে যেতাম, সেই বদমাশ কাক আমার পুতুল নিয়ে চলে গেছে।
একই গল্প উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে, সেখানে জাঠ মানুষজন বাচ্চাদের বলে, ওহ তো কোকো লে গয়া। সেই কথাই প্রথম পর্বের ভোটের শেষে বললেন রাকেশ টিকায়েত, বললেন বিজেপি কা ভোট তো কোকো লে গয়া, সেই অদৃশ্য কাকের গল্প। তো আসুন উত্তর প্রদেশ ভোটের প্রথম পর্ব নিয়ে কিছু কথা বলা যাক,
আসলে একটা সময় গেছে, বিজেপি যা করেছে, রাজনৈতিক প্রত্যেক ঘটনা, বালাকোট থেকে সার্জিকাল স্ট্রাইক, এমন কি ডিমনিটাইজেশন, সবটাই বিজেপির ফেভারে গেছে, বিজেপির লাভ হয়েছে। বিজেপির নতুন নতুন ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে, না জি এসটি নিয়ে, না ৩৭০ ধারা নিয়ে বিরোধীরা সেভাবে কিছু বলতে পেরেছে, বলতে তো পারেই নি, উলটে মানুষজনের এক বিরাট অংশ বিজেপির তৈরি ন্যারেটিভ, তাদের বক্তব্যকে সমর্থন করেছে।
ধরুন ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া, দেশের সাধারণ মানুষকে বলা হল, কেন একটা রাজ্যে বিশেষ আইন থাকবে? কেন সেখানে আলাদা পতাকা থাকবে? এক দেশে এক আইন তো স্বাভাবিক। মানুষকে বিরোধীরা বোঝাতেই পারলেন না, এরকম আইন কেবল কাশ্মীরেই নেই, সারা দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই আছে, উত্তর পূর্বাঞ্চলে ৩৭১ ধারা আছে, উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় যেতে গেলে পারমিট নিতে হয়, উত্তর পূর্বাঞ্চল সমেত দেশের আদিবাসী অঞ্চলে জমি কেনা যায় না, এগুলো যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণেই করা হয়েছে। বিজেপি মানুষকে বোঝালো, কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য এই আইন, যার ফলে আপনারা, মানে হিন্দুরা কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবেন না, বিরাট সংখ্যক হিন্দু তা বুঝলেন।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : মিনি সাধারণ নির্বাচন
এরকমটাই চলছিল, আর এস এস – বিজেপির এইসব ন্যারেটিভ বিনা দ্বিধায় মানুষের এক বিরাট অংশ মেনে নিচ্ছিল, বিজেপির সেটা ছিল স্বর্ণ যুগ। কিন্তু হঠাৎ সেই স্বর্ণযুগের অবসান, বা বলা যাক স্বর্ণযুগ থেকে বিজেপি নামতে শুরু করেছে, যা করছে সবটাই তাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। বিজেপি ২০১৭তে উত্তর প্রদেশে, বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসেছিল, ৩১২ জন বিধায়ক, ভাবা যায়? সবে ডিমনিটাইজেশন হয়েছে, গরীব গুর্বো মানুষ বলছে, এবার বড়লোকেদের টাইট দেওয়া হচ্ছে, রাম মন্দির হচ্ছে, রাম রাজ্য হবে। এবার চাকরি হবে, শিল্প হবে, জিনিষ পত্রের দাম কমবে, সুশাসন আসবে, গুড গভর্নেন্স।
সেই সময়ে সব থেকে বড় ভুল করলো বিজেপি, এক হিন্দু পোস্টার বয়, যে নাম কারোর বিবেচনাতেই ছিল না, সেই আদিত্যনাথ যোগীকে মুখ্যমন্ত্রী করা হল, তিনি মুখ্যমন্ত্রী ভবন কে আগে মন্ত্র পড়ে, যজ্ঞ করে শুদ্ধ করলেন, তারপর ঢুকলেন, পরণে গেরুয়া, প্রায় মোদিজীর মত, নিজের পরিবার নেই, দেশের অন্যতম শৈব মঠের পিঠাধীশ। আদতে রাজপুত, অজয় মোহন বিস্ট ওরফে যোগী আদিত্যনাথ সন্ন্যাস জীবনে এসেও তাঁর জাত্যাভিমান ছেড়ে ফেলেন নি, নিজেকে রাজপুত বলতে তাঁর দ্বিধাও নেই। যে উত্তরপ্রদেশে দলিত ২০ % এর বেশি, আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্টের লোকজন ৪০% এর কাছাকাছি, সেখানে ৪% রাজপুতদের একজন হলেন মুখ্যমন্ত্রী, সেদিনই ভবিষ্যত নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল। হত না, যদি যোগী আদিত্যনাথ ধর্ম, জাতের ওপরে গিয়ে গুড গভর্নেন্সের দিকে নজর দিতেন, যদি সত্যি বিকাশের দিকে নজর দিতেন, সে সবের কথা বললেন, ভান করলেন কিন্তু চরম মুসলমান বিরোধী কথাবার্তা, ভয়ঙ্কর মনুবাদী আচরণ, দলিত ওবিসিদের পাত্তাও না দেওয়া, রাজ্য প্রশাসনের মাথায় রাজপুত দের বসানো, এমনকি ব্রাহ্মণদেরও মনে হল যে যোগিজী তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী নন।
আসলে যোগিজী ভেবেছিলেন, আপার কাস্ট আর যাবে কোথায়? তাঁর ভরসা ছিল অযোধ্যার মন্দির নির্মাণের ওপরে, তিনি হিন্দু কনসোলিডেশনের কথা ভাবছিলেন এবং তাঁর পাঁচ বছরের রাজত্বকালে মুসলমান তো বটেই, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্টের কাছেও অপছন্দের মানুষ হয়ে উঠছিলেন, বিজেপি কি বোঝেনি?
আর এস এস – বিজেপির কাছে নির্বাচনের ৬/৭ মাস আগেই খবর ছিল, জাহাজ ডুবতে পারে, কিন্তু তাদের করার কিছু ছিল না, উত্তরপ্রদেশে তো বটেই, সারা দেশের কট্টর বিজেপি সমর্থকদের কাছে ততদিনে যোগিজী হিন্দুত্বের আইকন, তিনি কেরালা, বাংলা, অসমেও নিমন্ত্রিত হচ্ছেন ভাষণ দেবার জন্য, এক ফায়ার ব্রান্ড হিন্দু ইমেজ, যিনি অবলীলায় বলতে পারেন, আনে দো মার্চ মাহিনা, সব গর্মি, সব চর্বি উতার দেঙ্গে।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : নো ভোট টু বিজেপি
একধারে যখন এই ভুল হয়েই গেছে, যা শুধরানোর কোনও তারিকা জানা নেই, সেই সময়ে কৃষক আন্দোলন। নরেন্দ্র মোদী ভেবেছিলেন, বড় কৃষকরা তাঁর এই কানুন দেখে হাততালি দেবেন, হল কী? তাঁরা পথে নামলেন। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান আর উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল হয়ে উঠল হটবেড। যে পশ্চিম থেকে বিজেপির জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানেই কৃষক আন্দোলনের আগুন ছড়ালো, মুজফফরনগরের দাঙ্গার পরে যে হিন্দু জাঠেরা মুসলমানদের মুখ দেখতেন না, ২০১৭তে যে জাঠেদের ৭০% ভোট পড়েছিল বিজেপির দিকে, ২০১৯ এ যে জাঠেদের ৯১% ভোট পড়েছিল বিজেপির দিকে তারাই এবার বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, কেবল এটাই নয়, এই আন্দোলনের পথেই জাঠ আর মুসলমানেরা হাতে হাত ধরল, ১৯৮৯/৯০ এর শ্লোগান, হর হর মহাদেও এর পালটা আল্লা হু আকবর শোনা গ্যালো, প্রতি মহাপঞ্চায়েতে জাঠেরা বসছেন মুসলমান কৃষকদের নিয়ে, ২০১৩ র মুজফফরনগরের দাঙ্গার ক্ষত ঢেকে গ্যালো আন্দোলনের প্রবাহে, প্রথমদফার ভোটে তারই প্রভাব আমরা দেখলাম, যে পশ্চিম দ্বার খুলে দিয়েছিল বিজেপির, তা আজ অবরুদ্ধ।
বিজেপি এই প্রথম তাদের ন্যারেটিভ, তাদের সুচিন্তিত বক্তব্য, ওয়ান লাইনার তৈরি করতে গিয়ে নড়বড় করছে, প্রথমে বিকাশ, তারপর হিন্দু মুসলিম, তারপর নারী সুরক্ষা, শেষে লাভার্থী, ৫ কিলো আনাজ দেবার কথা মনে করাচ্ছেন। বেনিফিসিয়ারির রাজনীতি কাজ করে বৈকি, সারা দেশে কাজ করছে, এই বাংলাতেও করেছে, কিন্তু ইউ পি তে মূলত দুটো কারণে করছে না।
এক) দরিদ্রতম মানুষেরা এই লাভার্থীর দলে পড়েন, তাদের বিরাট অংশ গরীব মুসলমানেরা, বিরাট অংশ দলিত মানুষজন, কারণ তারাই সমাজের সবথেকে পিছিয়ে পড়া মানুষ। এখানেই সমস্যা, দরিদ্র মুসলমানেরা বিজেপিকে ভোট দেবে? দলিতদের একটা অংশ দেবে, বিরাট অংশ দেবে? হ্যাঁ তারা লাভ পেয়েছে, কিন্তু ভোট? কেবল মুসলমান বলে দেশ জুড়ে, তাদের অনেককে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে, এটা কি তারা ভুলে যাবে? বাবরি মসজিদ ভাঙার কথা? বিজেপির দাঙ্গার কথা? এসব ভুলে যাবে?
এবার আসি দলিত প্রসঙ্গে, তারা তাদের নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলে যাবে? তারা বি এস পির সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ভুলে যাবে? ধরুন মতুয়া ভোট, তারাও মমতা সরকারের দেওয়া রেশন পেয়েছে, কন্যাশ্রী পেয়েছে, সবুজ সাথী পেয়েছে। তো? তারা ভোট দিল মমতাকে? তৃণমূল কে? আবার এই মতুয়ারাই যদি, তাদের নেতারা যদি তৃণমূলে আসে, তাহলে যারা গতকাল বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল, তারাই তৃণমূলকে ভোট দেবে। কেবল ডোল দিলেই হবে না, কেবল ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি তৈরি করলেই হবে না, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বও দিতে হবে, যা এই মূহুর্তে অন্তত পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বিজেপির হাতে নেই, জাঠেরা সরে গেছে, যাদের ৯১% ভোট বিজেপি পেয়েছিল ২০১৯ এ, এবার সেই জাঠ ভোটের ১৫%ও তারা পাবে না, মুসলমান ভোট আগে ভাগ হয়েছে, এবার ওবেইসিও হালে পানি পাচ্ছেন না, তারা বিজেপিকে হারাতে ভোট দিচ্ছে, গুজ্জর ভোট, সাইনিদের ভোট, কুর্মিদের ভোট ভাগ হচ্ছে আর জাঠ দলিত ভোট বি এস পিই ধরে রাখছে, এমনটাই গ্রাউন্ড রিপোর্ট.
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: কুমিরের কান্না
তা যদি হয় তাহলে বিজেপির কপালে দুঃখ আছে, কারণ উত্তর প্রদেশে সূর্য তো পুব দিকেই ওঠে, কিন্তু রাজনৈতিক সূর্য পশ্চিম দিক থেকেই ওঠে, এই পশ্চিমাঞ্চল যাদের হাতে থাকে, তারাই লক্ষ্ণৌ এর গদিতে বসে। কতটা খারাপ? একটা উদাহরণ দিই, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি নির্ভর করে আখ চাষের ওপর, আখ এর জন্য মন্ত্রীও আছেন, গন্না মন্ত্রী, সুরেশ রাণা, এবার শামলি জেলা থেকে দাঁড়িয়েছিলেন, প্রথম পর্যায়ের ভোট শেষ হবার পরেই তিনি নিজের এলাকার ৪০ টা বুথে আবার নির্বাচনের দাবি করেছেন, ভাবুন, রাজ্য সরকারে বিজেপি, কেন্দ্র সরকারে বিজেপি, যাকে বলে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার, তিনি রিপোল চাইছেন। সোমবার দ্বিতীয় পর্বের ভোটও হয়ে গ্যালো, ৫৫ টা আসনের ফয়সালা, ৯ টা জেলার ৭ টা জেলাতে ৩৭% – ৩৮% মুসলমান ভোট, গতবারের খুব খারাপ ফলেও এই খানে সমাজবাদী দল পেয়েছিল ১৫ টা, এবারে? জমিন থেকে খবর আসুক, কাল তা নিয়েই বলবো। মোদ্দা কথা হল কদিন আগে যে নির্বাচন যোগিজীর কেক ওয়াক মনে হচ্ছিল, সেই নির্বাচন বিরোধীদের গর্মি উতার দেঙ্গে বলার পর, নিজের গর্মি নেমে গেছে, কুল কুল করে ঠান্ডা ঘাম বইছে, এটুকু তো বলাই যায়।