এক মহিলা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে চটি ছুঁড়েছেন৷প্রতিদিন দিন আনি দিন খাই মানুষের চোখের সামনে এই কোটি কোটি টাকার স্তুপ এক অশ্লীল আয়োজন, তাই ঘৃণা জন্মেছে, পবিত্র ঘৃণা। চটি ছুঁড়েছেন। রাগ আর ঘেন্নার বর্হিপ্রকাশ। বেশ করেছেন। এবং হঠাৎই ফেবু আর সোশ্যাল মিডিয়ায়, যেখানে এখনও কিছু বিপ্লবী বেঁচে আছেন, বিপ্লবী মশাল জ্বেলে রেখেছেন, তাঁরা রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের আগে নেভা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা অরোরা জাহাজের কামান গর্জনের মতো এক বিপ্লবী ইসারা পেয়েছেন, এক সাহিত্যিক, পিচ রাস্তায় দামামা বেজেছে, শুনেছেন। ভালো। অন্যদিকে বিজেপি এবং তাদের আইটি সেল যারপরনাই খুশি, এইতো চাই, মানুষের ক্রোধের বর্হিপ্রকাশ ইত্যাদি ইত্যাদি বলছেন, খিল্লি জারি হ্যায়। তো এই চটি ছোঁড়া, মুখে কালি লাগানো, ইত্যাদি নতুন নয়। যে যাকে ছুঁড়েছে, তার বিরোধীরা মোগাম্বো খুশ হুয়া, সমর্থকরা বলেছে এ ঘোর অন্যায়। এই ভাবেই চটি গিয়েছে ট্রাম্পের দিকে, বুশের দিকে, চিদাম্বরমের দিকে, নওয়াজ শরিফের দিকে, কম্বোডিয়ান প্রেসিডেন্ট হান সেনের দিকে, সেই বিরাট লিস্টে যোগ হল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম৷ তাঁর সন্মান বাড়লো না কমলো, জামিনে বের হওয়ার পর জিজ্ঞেস করা যাবে।
কালি মাখানোও হয়েছে বহুবার, আরএসএস বিজেপি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা কর্মীরা শিল্পী হুসেইনের মুখে কালি মাখিয়েছে, শিল্পী যতীন দাসের মুখে মাখিয়েছে, কিছুদিন আগেই রাকেশ টিকায়েতের মুখে কালি মাখিয়েছে। কাজেই এসব নতুন কিছু নয়, এই চটি ছোঁড়া, কালি মাখানো, থাপ্পড় মারা এসব রাগের বর্হিপ্রকাশ, পরিকল্পিত হ্যাটা করার ঘটনা। এ দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র বা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব কোনওটাই হবে না। তবে এটাও সত্যি আমার যদি মনে হয় বেশ হয়েছে, তাহলে হাততালি দেব, সোশ্যাল মিডিয়াতে খিল্লি করবো। যদি মনে হয় ঠিক হয়নি তাহলে বিরোধিতা করবো। ইংরেজদের কাছে যারা ঘোষিত দেশদ্রোহী ছিল, তারা ভারতীয়দের কাছে দেশপ্রেমিক, সাধারণ সূত্র। কিন্তু অসাধারণটা কী? বিশ্ব জুড়ে এই কালি মাখানো, থাপ্পড় মারা বা চটি ছোঁড়ার ঘটনাকে যদি বিদেশ আর স্বদেশে ভাগ করি, তাহলে দেখব, বিদেশে এই প্রতিবাদের মাত্রা, ডায়ামেনশন অনেক বড়। কাকে চটি ছুঁড়লো? বুশকে। কাকে থাপ্পড় মারার চেষ্টা করলো? ট্রাম্পকে। কাকে চটি ছুঁড়ল এবং লাগলো? নওয়াজ শরিফকে, রাষ্ট্রপতি হান সেনকে। আমাদের দেশে সর্বোচ্চ নাম চিদাম্বরম, তিনি তখন হোম মিনিস্টার, সিবিআই দিল্লি দাঙ্গার অভিযুক্ত জগদীশ টাইটলারকে ক্লিন চিট দিয়েছিল, তাই চিদাম্বরমের দিকে চটি ছোঁড়া হয়েছিল৷ অধীর চৌধুরি আজ যাকে ক্রোধের বর্হিপ্রকাশ বলেছেন, সেদিন সেই একই ঘটনাকে ঘৃণ্য নিন্দনীয় ইত্যাদি বলেছিলেন।
আগামীকালই যদি ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় অভিযুক্ত রাহুল গান্ধী বা সোনিয়া গান্ধীর গায়ে বা মাথায় কেউ চটি ছুঁড়ে মারে, তখন ওই একই মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসের অধীর চৌধুরি তীব্র প্রতিবাদ করবেন, বাংলায় করলে সাফ বোঝা যাবে, অন্য কোনও ভাষায় করলে বোঝা যাবে না বা অন্য মানে বের হবে এই যা। আমাদের দেশে চটি ছোঁড়ার ঘটনা এরকমই নিচু তলার দিকে, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি এখনও সেই আওতায় আসেননি। আসলে এসবই হল প্রতীকী প্রতিবাদ, যা যুগে যুগে হয়েছে, হবেও। কিন্তু আসল জায়গায় হয় না, হবেও না। তারওপর আবার বাঙালির হজম শক্তি বড্ড কম, এক আম বাঙালির পক্ষে প্রায় ৫০ কোটি টাকার তছরুপ হজম করা বড্ড কঠিন, কাজেই স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ, বিচলিত। কিন্তু সারা ভারতের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, মোদি জামানার শুরুতেই বিজয় মালিয়া দেশ ছেড়ে পালাল, কত টাকার ঘাপলা? ৭৫০৫ কোটি টাকা, লন্ডনে আছেন, ক্রিকেট খেলা দেখতে যান, লোকজন জানিয়েছে সকালে রেস্তঁরায় ফিস এন চিপস খেতে দেখা যায় ওনাকে, রাতে অভিজাত বার এন্ড রেস্তঁরায়।
এরপর মোদিজীর মেহুল ভাই, মেহুল চোকসি, ৭০৮০ কোটি টাকার ঘাপলা, আপাতত আন্টিগুয়ায়, পাইন অ্যাপেল জুস দিয়ে মালেব্যু খাচ্ছেন, পাশে বান্ধবীরা। এরপর যতীন মেহেতা, ঘাপলা ৬৫৮০ কোটি টাকার, আপাতত ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিজ দ্বীপপুঞ্জে বিশাল বাংলোবাড়িতে অবসর জীবনযাপন করছেন৷ খবরে প্রকাশ, কিছুদিন আগে এক বলিউড অভিনেত্রী সেখানে দিন ১৫ হলিডে কাটিয়ে এসেছেন। পরের জন নীরব মোদি, মোদিজীর সুপরিচিত, ঘাপলা ৬৪৯৮ কোটি টাকার, আপাতত লন্ডনে, গায়ে ২৩ লক্ষ টাকার জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নীতীন সন্দসেরা, চেতন সন্দসেরা, দুজনের ঘাপলার পরিমাণ ৫৩৮৩ টাকা, নাইজিরিয়া তে আছেন, দিব্য আছেন, তাঁদের টাকা এদেশেও খাটছে বলে খবর। উমেশ পারেখ, কমলেশ পারেখ, নীলেশ পারেখ শ্রী গণেশ জুয়েলারি হাউসের মালিক, ঘাপলা ২৬৭২ কোটি টাকা, তিনজনের দুজন দুবাই, একজন কেনিয়াতে আছেন, বুঝতেই পারছেন, বহাল তবিয়তে আছেন।
ললিত মোদি, আই পি এল খ্যাত এই মোদিজীর ঘাপলা ১৭০০ কোটি টাকার, বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ বিদেশমন্ত্রী থাকাকালীন ইনি পাসপোর্ট বার করে বিদেশে চলে যান, তারপর থেকে ইউনাইটেড কিংডমেই থাকেন, বেড়াতে যান মালদ্বীপ, সুইজারল্যান্ড, কে আটকাচ্ছে? রীতেশ জৈন, ঘাপলা ১৪২১ কোটি টাকার, কোথায় আছে, উইকিপিডিয়াও জানে না, ইডি ও জানে না। রাজিভ গয়াল, অলকা গয়াল, সুর্য ফার্মাসিউটিক্যাল এর ঘাপলার পরিমাণ ৭৭৮ কোটি, এনারাও কোথায় আছেন কেউ জানে না। আশিস জোবানপুত্র, ৭৭০ কোটি টাকার তছরুপ, লুকিয়েয়াছেন কোথায়, কেউ জানে না, কিন্তু দেশে নেই এটা সবাই জানে। দেশে আছেন, জেলে আছেন, বেলে আছেন, বা কিছুদিনের মধ্যেই বেল পাবেন, সেরকম কিছু মহারথীদের দেখা যাক, এবজে শিপ ইয়ার্ডের মালিক ঋষি আগরওয়াল, সান্তনম মুথুস্বামী, অশ্বিনী কুমার, তছরুপের পরিমাণ? ২২৮৪২ কোটি টাকা, হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন, ২২৮৪২ কোটি টাকা। গুজরাতের দহেজ আর সুরাতে এই কোম্পানির ব্যবসা। ২০১২ থেকে ঘাপলা চলছে, সিবিআই চার্জশিট দিয়েছে এই ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে। ২৮ টা ব্যাঙ্কের টাকা তছরুপ করা অভিযোগ এনাদের বিরুদ্ধে, না, এঁরা কেউ জেলে নেই, বাইরেই আছেন। আইসিআইসি আই – ভিডিওকন মামলা, ১৮৭৫ কোটি টাকার তছরুপের অভিযোগ চন্দ্রা কোছর, তাঁর স্বামী দীপক কোছরের বিরুদ্ধে, দুজনেই জেল হাজতে ছিলেন, এখন জামিনে আছেন। ইয়েস ব্যাঙ্ক – ডিএইচএফএল মামলা, ২২০৩ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ, অভিযুক্ত ইয়েস ব্যাঙ্কের সিইও রানা কাপুরের বিরুদ্ধে, এই মামলায় তিনি জামিন পেয়ে গেছেন, অন্য একটা মামলা ঝুলে আছে, সেটাতে জামিন পেলেই ফ্ল্যামবয়েন্ট রানা কাপুরকে আবার মুম্বাই এর নৈশ পার্টিতে দেখা যাবে।
আমেরিকার ফিনান্সিয়াল ক্রাইম এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক, সংক্ষেপে ফিন সেন, জানিয়েছে ঠিক এই মূহুর্তে ভারতের ৪৪ টা ব্যাঙ্কের প্রায় ২০০০ লেনদেন সন্দেহজনক, যার পরিমাণ এক বিলিয়ন আমেরিকান ডলার, ৭৯৪৩ কোটি টাকার লেনদেন সন্দেহজনক, আগামী দিনে এরাও ধরা পড়বীএ, জেল হবে জামিন পাবে বা পালিয়ে যাবে ইউকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা কেনিয়ায়। পার্থর ৫০ কোটি, রাগ হয়েছে, চটি ছুঁড়েছেন, বেশ করেছেন, এবার আসুন, এই কোটি কোটি টাকার ঘাপলা যারা করল, যাদের সাহায্য নিয়ে করল, যাদের সাহায্য নিয়ে তারা বিদেশে ফূর্তি করে বেড়াচ্ছে, বান্ধবী যাচ্ছে এদেশ থেকে, নৈশ পার্টিতে বয়ে যাচ্ছে দামি সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি, যে প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য এই লুঠেরারা দেশ ছেড়ে পালাল, যে রাজনৈতিক নেতারা এদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আনার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এবার তাদের জন্য চটি জোগাড় করুন, চটি জমা করুন, তারপর হোক না চটি ছোঁড়া। যারা ১০ হাজার কোটি টাকা, ২১ হাজার কোটি টাকা মেরে চলে গেল, তারা গায়ে ফুঁ দিয়ে ফূর্তি করে বেড়াবে, যারা তদের সাহায্য করল বেড়ে উঠতে তারা সেই টাকার ভাগ বাটোয়ারা করে দিব্য জীবন কাটাবে, তা তো হয় না, তাদের জন্যও বরাদ্দ হোক চটি।