আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকে আমরা কোথায় এগিয়ে? অন্তত একটা বিষয় তো আমরা গর্ব করে বলতে পারি৷ আমাদের দেশের সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীর প্রধানেরা, কখনও কোনওদিনও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলায়নি৷ তাদেরকে দেশের ভেতরে, কাশ্মীরে, বস্তারে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু জায়গায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা তা পালন করার চেষ্টা করেছেন৷ কতখানি ঠিকঠাকভাবে? তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু দেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী নাক গলায়নি, দেশের রাজনেতাদের দায় তারা নিজেদের কাঁধে নেয়নি, কিন্তু সেই ধারাবাহিকতায় কী ছেদ পড়তে চলেছে?
সৈন্যবাহিনীর বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি, প্রতিরক্ষা দফতর তাদের নিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ রাজনাথ সিং নিজে বসে ঘোষণা করেছেন অগ্নিপথ স্কিমের, যা যা বলার বলেছেন। এবার যখন নিয়োগ শুরু হবে, তখন সেনাবাহিনীর কর্তারা সেই নিয়োগ করবেন, প্রশিক্ষণ দেবেন, সেই অগ্নিবীরেদের ঝাড়াই বাছাই করবেন। কিন্তু সরকারের নিয়োগ নীতি নিয়ে সারা দেশে বিক্ষোভ চলছে, ছাত্র যুবকরা পথে, একেবারেই কাম্য নয়, কিন্তু ঘটছে হিংসা, বাস, ট্রেন জ্বালানো হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের বয়ান দিচ্ছেন, প্রেস তাদের মত বলছে, সরকার আমতা আমতা করে কিছু ছাড় ইত্যাদির কথা বলছে, এর সবটাই গণতান্ত্রিক দেশে হয়ে থাকে, এখানেও হচ্ছে। সেনাবাহিনী বড়জোর অগ্নিপথ স্কিম নিয়ে আরও বিশদে কিছু বলতেই পারে, কিন্তু সেনাবাহিনীর কর্তারা আজ কার্যত হুমকি দিলেন, বললেন যারা যারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, তাদের অগ্নিবীরের চার বছরের চাকরি দেওয়া হবে না৷ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যা বললেন, তা আমরা এর আগে অমিত শাহ, আদিত্য যোগীর গলায় শুনেছি৷ যারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, সে ছিল রাজনৈতিক বক্তব্য, আজ সেনাবাহিনীর কর্তারা সেই হুমকি দিলেন, দেওয়া যায়? দেশের মধ্যে কে কোথায় বিক্ষোভ দেখাবে, কেন দেখাবে, বিক্ষোভ দেখানো উচিত কি না, সেটা সেনাবাহিনীর কর্তারা ঠিক করে দেবেন? এ এক ভয়ংকর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল৷ চূড়ান্ত হতাশ কিছু যুবক, যাদের অনেকেই গত দু, তিন কি চার বছর ধরে এই সেনবাহিনীতে চাকরির জন্য খাটছে, সকালে দৌড়চ্ছে, বিকেলে ব্যায়াম করছে, বিভিন্ন সেনা ভর্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১২/১৫/১৮ হাজার টাকা ফিজ দিয়ে ভর্তি হয়েছে, তারা হঠাৎ জানলো, তাদের চাকরি পার্মানেন্ট নয়, তাদের চাকরি চার বছর পরে না থাকার সম্ভাবনা বেশি, তাদের চাকরির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত নয়, তারা রাস্তায় নেমেছে, কারোর কারোর হতাশা আরও বেশি৷ তারা বাসে, ট্রেনে আগুন দিয়েছে, সেই সব বেকার ছেলেমেয়েদের হতাশার পালটা জবাব হুমকি?
যারা রাস্তায় নামবে, তাদের এই চাকরিও জুটবে না, এটা বলা যায়? তাও বলছে কে? সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তারা, আমরা কি গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করছি? গরীব সাধারণ ঘরের ছেলে মেয়েরা, সাধারণ মানের ছেলেমেয়েরা, কোথায় চাকরি পাবে? সরকারি চাকরি মানে রেল, ডাক, তার, এর গ্রুপ ডি চাকরি, আর সেনাবাহিনীর জওয়ান, এরমধ্যে অবশ্যই সেনাবাহিনীর জওয়ান এর চাকরি ছিল লুক্রেটিভ, সব অর্থে লোভনীয়, সেনাতে কাজ করছি, দেশের জন্য কাজ করছি, এক ধরনের গৌরব, অন্যদিকে ভাল পে স্কেল, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধে, র্যাশন থেকে চিকিৎসা। এবং ১৫/১৭/১৯/২১ বছর পরে অবসর নেওয়ার সময় মোটা অংকের গ্রাচুইটি, পেনশন, চিকিৎসার সুযোগ এবং বিভিন্ন সরকারি কোটায় চাকরির সংরক্ষণ। কারা আসছিল এই চাকরিতে? বিক্ষোভের জায়গাগুলো দেখলেই বুঝবেন, যে রাজ্য, যে জায়গা থেকে লাখে লাখে মাইগ্রেন্ট লেবার যায় অন্য রাজ্যে, সেই জায়গা, বিহার, ইউপি, এম পি, রাজস্থান, কিছুটা এই বাংলা। যোগ্যতা? ১০ পাস, টুয়েলভ পাস, বড়জোর সাধারণ গ্রাজুয়েট। এর পরের স্তরের চাকরি সরকারি শিক্ষকের, রেল ডাক তার ইত্যাদির গ্রুপ সি কর্মচারীর, রজ্য পুলিশ, প্যারা মেডিকেল ইত্যাদির চাকরি, যা রোজ কমছে, যেখানে রিক্রুটমেন্ট বন্ধ।
এরপর হল ইউপিএসসি, আইএএস, আইপিএস ইত্যাদি, রাজ্যের সিভিল সার্ভিস, সে আর কত? আর আছে বেসরকারি চাকরি, সেখানে কোথায় শুরু কোথায় শেষ, তার কোনও ঠিক নেই। চুড়ান্ত শোষণ, সীমাহীন কাজের চাপ, অনিশ্চয়তা সর্বত্র। এই বেসরকারি চাকরি, সে বড়বাজারের গদিতে খাতা লেখা বা কর্পোরেট হাউসে দুলাখ কি তিন লাখের চাকরি, যাই হোক না কেন, কোথাও নিশ্চয়তা নেই, হঠাৎ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে, কোথাও বা ডেকে বলা হবে, আপনি অসাধারণ কাজ করেছেন, অমূল্য আপনার যোগদান, এবার আসুন, রিজাইন করুন, নাহলে ছাঁটাই করবো, ছাঁটাই এর কালো দাগ ক্যারিয়ারের লাগানোর চেয়ে, রিজাইন করাই ভাল, অতএব যা খানিক দিচ্ছে তাই নিয়ে সোনামুখ করে বড়ি ফিরে এসো। সেই কর্পোরেট কালচার নিয়ে চলবে সেনা বাহিনী? যুক্তি কী? সেনা বাহিনীকে ইয়ং করতে হবে, ইউথফুল করতে হবে, প্রাণবন্ত করতে হবে। যারা বলছেন, তাঁদের মাথার প্রত্যেকটা চুল সাদা, দেশের আইন সভার সাংসদদের গড় বয়স ৬৩, মন্ত্রীদের আরও বেশি ৬৯/৭০, তাঁরা বলছেন কেবল সৈন্যবাহিনীকে প্রাণবন্ত করতে হবে, এম পি এম এল এ রা বৃদ্ধ থেকে বৃদ্ধতর হতে থাকবেন, সেখানে প্রাণ মন কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না, শুরু হোক না ওপর থেকে, অশীতিপর বৃদ্ধ, ৭০ এর চলার ক্ষমতা হারানো, কাঁধে ভর দেওয়া রাজনৈতিক নেতাদের বাদ দিয়ে ভাবনা চিন্তা হবে? আচ্ছা, এই অগ্নিপথ স্কিম আসার আগে, সেনাবাহিনীতে ভর্তির বয়স কত ছিল? ১৭ থেকে ২৫, এখন কত হল, পার্মানেন্ট ইউনিট, মানে চার বছর পর অগ্নিবীরেরা, যখন মূল সেনাবাহিনীতে ১৫ বছরের চাকরিতে যোগ দেবেন, তখন তাদের বয়স কত? ২১ থেকে ২৫। গত দু বছর ধরে কোনও রিক্রুট্মেন্ট হয়নি৷ মানে কেবল দু বছরেই ১ লক্ষ নিয়োগ করা হয়নি, তার বদলে এবার ৪৬ হাজার নিয়োগ হবে, জুন থেকে ২০২৩ এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে, এবং সেনাবাহিনীর বড় কর্তারা বলছেন, এরপর নাকি এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়বে৷ এক সময় নাকি দেড় লক্ষও হতে পারে, দু বছর নিয়োগ না হওয়ার পরে তৃতীয় বছরে ৪৬ হাজার নিয়োগ করা হচ্ছে, যখন প্রতি বছর নিয়োগ করা হবে, তখন নিয়োগ বাড়বে? কোন অংকে? ৫ বছর এমপি বা এমএলএ বা এমএলসি থাকার পরে, রাজনৈতিক নেতারা পেনশন পাবেন, এক্সচেকারে আনন্দের হাওয়া বইবে, লাগে টাকা, আছে তো গৌরি সেনের পকেট, আম আদমি টাকা যোগাবে, কিন্তু ৪ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করার পরে অগ্নিবীরেরা পেনশন পাবে না, এম পি এম এল এ রা সারা জীবন চিকিৎসার সুযোগ পাবেন, যাতায়াতের ফ্রি টিকিট পাবেন, কিন্তু অগ্নিবীরেরা পাবে না।
বলা হচ্ছে ৪ বছর পরে যারা স্থায়ী চাকরি পাবে না, তাদের জন্য বিভিন্ন সংরক্ষণ থাকবে, আরে বাবা চাকরিটা কোথায়? কোন চাকরি? কৈলাশ বিজয়বর্গিয় খানিকটা হিন্টস দিয়েছেন, হ্যাঁ তারা নিযুক্ত হবে, বিজেপির বিভিন্ন দপ্তরে সিকিউরিটি দেখার কাজে, কেবল মাইনে কত দেবেন, সেটা আর জানাননি। দেশের চৌকিদারের সিকিউরিটির জন্য দিনে ১.৪৩ কোটি টাকা খরচ হবে, দেশের অগ্নিবীরেরা চৌকিদারি করবে, বিজেপি অফিসে। রেল ডাক তার, রাষ্ট্রায়ত্ত সেক্টরে চাকরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে না, বরং তার এক বিরাট অংশকে প্রাইভেট সেক্টরের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, নাহলে পুরোটাই বেচে দেওয়া হচ্ছে, বিমান বন্দর, জাহাজ বন্দর বেচে দেওয়া হচ্ছে, সবটাই কনট্রাক্ট সার্ভিস, এসব শুরু হয়েছিল বেশ কিছু বছর ধরে, এবার সৈন্যবাহিনীতেও সেটা লাগু করার সিদ্ধান্ত নিল সরকার, এরপর আসবে পুলিস, আই এ এস, আই পি এস দের পালা, সেখানেও প্রাণবন্ত টিম তৈরি করার কথা বলা হবে, সেখানেও ৩/৪/৫ বছরের কন্ট্রাক্ট, আবার রিনিউয়াল, কন্ট্রাকচুয়াল লেবার রা, চুক্তিবধ শ্রমিকরা প্রতিবাদ করতে পারে না, করলে ছাঁটাই হতে হবে। এ এক নরক গুলজার শুরু হয়েছে, তাকিয়ে দেখুন দেশের সর্বত্র বিক্ষোভ, বিক্ষোভে আমাদের কিশোর, যুবক, তরুণ প্রজন্ম, আমাদের আত্মীয় স্বজনেরা, যারা মূল্যবৃদ্ধির জন্য বাজারে আগুন দেয়নি, পেট্রলের দাম বাড়ানোর বিরোধিতায় পেট্রল পাম্প জ্বালায়নি, করোনা কালে অক্সিজেন, ওষুধ, ডাক্তার ছাড়াই মরেছে বা বেঁচে রয়েছে, যারা কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে ঘরে ফিরেছে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্ভট সিদ্ধান্তের জন্য, মুখ বুজে সহ্য করেছে সব, আজ তারাই রাজপথে, হতাশার আগুন, সেই আগুনের বর্ণমালা আসলে তাদের প্রতিবাদ, তাদের স্বপ্ন কেড়ে নেবার প্রতিবাদ, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মৌন, একটা কথাও বলছেন না, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র যেন অথবা অসংবেদনশীল, ৭০০/৮০০ মৃত্যুর আগে ওনার ঘুম ভাঙবে না।