কীর্তি আজাদ কথাটা শুরুই করলেন এভাবে: ‘আজ তিরাশির দলটাই যে ভেঙে গেল। আমাদের সেই দলের সবচেয়ে ফিট লোকটাই এভাবে চলে গেলো!’
সেই ‘কপিল’স ডেয়ার ডেভিলস’ টিম। ১৯৮৩-র সালের সেই অবিশ্বাস্য সাফল্য। আর সেই তাক লাগানো বিশ্ব সেরা দলের দ্বিতীয় হায়েস্ট রান স্কোরার ছিলেন যশপাল। কপিল ছিলেন পয়লা নম্বরে। মোট ২৪০ রান আর গড় ছিল: ৩৪.২৮। ক্রিকইনফো ঘেঁটে মিলল, ৪২টি ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনাল খেলে করেছিলেন ৮৮৩ রান। দেশে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন প্রায় ১৬০ টি ম্যাচ। করেছিলেন ৮৯৩৩ রান। খেলেছিলেন পঞ্জাব, হরিয়ানা আর রেলওয়ের হয়ে।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩-ভারতীয় দলের মিডল অর্ডারে সবচেয়ে মারকুটে ব্যাটসম্যান ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর জাতীয় নির্বাচক হয়েছিলেন একাধিকবার। শেষবার দায়িত্বে ছিলেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারিং করেছেন। ম্যাচ রেফারিও ছিলেন। এমনকি উত্তরপ্রদেশের রঞ্জি দলের কোচের দায়িত্বও নিয়েছিলেন। বিভিন্ন টিভি শো-তে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হয়ে বসতেন। সেখানেও আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলতেন। নিজের ব্যাটিং স্টাইলের মতন।
মাত্র ৬৬ বছরেই চলে গেলেন যশ। রোজকার মত সকালে হাঁটতে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেশি ঘাম হচ্ছে বুঝে বাড়ি ফিরে আসেন। তারপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। জ্ঞান হারান। ছেলে আর আরও অনেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায়, তিনি নেই। মারাত্মক এক হৃদরোগ হঠাৎই কেড়ে নিল এই মনের মানুষটিকে।
দিল্লির কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, যশপাল শর্মাকে সকলে মনের মানুষ বলেন। নিজের মেয়ের বিয়েতে এইসব সাংবাদিকদের অনেকেই নিমন্ত্রিত ছিল। সকলে একই সুরে বলে চল্লেন-এতো আন্তরিকতা দিয়ে সকলকে অভ্যর্থনা জানানো, মনের মানুষ না হলে পারা যায় না।
এবছরে ২৫ মার্চ। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলের একটি রিউনিয়ন অনুষ্ঠানে সকলে একসঙ্গে হয়েছিলেন। ‘কর্নেল’ দীলিপ বেঙ্গসরকার সেইদিনের কথা মনে করে বললেন, ‘সেদিনও আমরা সকলে যশকে বলেছিলাম, সে-ই আমাদের টিমে এখনও সব চেয়ে ফিট। ১৯৮৩ তেও বিশ্বকাজয়ী দলেও সে ছিল সবচেয়ে ফিট। কিন্তু এই মানুষটা তিন মাস পর এভাবে চলে যাবে! ভাবাই যায় না।’
এখনও দারুণ ফিটনেস সচেতন ছিলেন যশপাল। বেশ কয়েকমাস ধরে নাকি ডিনারই করতেন না। রাত আটটার মধ্যে সামান্য কিছু খেয়ে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়া ছিল তাঁর ডেইলি রুটিন। আর ছিল, সকাল সকাল উঠে হাঁটতে যাওয়া। এই ‘ফিটনেস ফানাটিক’ থাকতে থাকতেই যে চলে গেলেন!
লুধিয়ানাতে জন্ম নিয়েছিলেন। পঞ্জাবের হয়ে খেলতেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের হয়ে খেলতে নামেন প্রথমবার পাকিস্তানের সিয়ালকটে। সেই ম্যাচে ২৬ বলে ১১ রান করেছিলেন। ভারত ৮ উইকেটে হেরে যায় ম্যাচটি।
লর্ডসে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তাঁর ১৯৭৯ সালে। ইংল্যান্ড তাঁর পয়মন্ত এক দেশ। ১৯৮৩ বিশ্বকাপও হয়েছিল সেখানে। সেবার বিশ্বকাপ জয়ের হ্যাটট্রিক করার দোরগোড়ায় পৌঁছে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্লাইভ লয়েডের দলটি যে হারতে পারে, তা গ্রুপ লিগের ম্যাচে করে দেখায় ভারত। ভারতের প্রথম ম্যাচ ছিল। ম্যানচেষ্টারে সেই ম্যাচে যশপাল দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন। ১২০ বলে ৮৯ রান করেন। ভারতীয় দল তুলেছিল: ২৬২/৮। আর কপিলের দল ম্যাচ জিতেছিল, ৩৪ রানে।
কয়েকদিন আগেই যশপাল শর্মা, একটি ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করেছিলেন। যা ছিল, ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচ । প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। সেদিনও ব্যাট হতে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন যশ। লং অফের উপর দিয়ে পল অ্যালটের উড়িয়ে দিয়ে ছক্কা মেরেছিলেন। আর পরেরটা বব উইলিসের বলে। তা মাঠের বাইরে ফেলেছিলেন, ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ার লেগ অঞ্চল দিয়ে। এখনকার ভারতীয় দলের এইসব ব্যাটিং দাপট দেখে মনে হয়, যশপাল কমতি কোথাও ছিলেন না। প্রথম ম্যাচেই ভারতীয় দলের মনে এই বিশ্বাসটা গেঁথে যায়-‘আমরাও পারি’। এবং তা পারেও ভারত। শেষবার যশপাল দেশের হয়ে খেলেছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে-১৯৮৫ সালে।
আরও পড়ুন – সৌরভের বায়োপিকে রণবীর
টুইট করে সচিন,সেহয়াগ,যুবরাজ,ভিভিএস,কুম্বলে এবং আরও অনেকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি,কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী-কেউ বাকি নেই। সকলের একই হাহাকার-বড্ড তাড়াতাড়ি কেন?
সত্যি তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। সিনেমা পরিচালক কবীর খান বানিয়ে ফেলেছেন ‘৮৩’। করোনা হানায় পিছিয়ে গেছে এই সিনেমাটির রিলিজ ডেট। যশ দেখে যেতে পেলেন না। কিন্তু তাঁর চরিত্রে যিনি সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন, সেই যতীন সারনা – নিজের ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে আবেগ মেশানো শব্দে লিখেছেন: ‘স্যার, এটা ঠিক হল না। ভগবান তুমিও এটা ঠিক করলে না। যশপাল স্যার, বিশ্বাস করতে পারছি না। এতো আগে ছেড়ে যেতে পারেন না।’ আসলে এই সিনেমা তৈরির জন্য সকলকে ট্রেনিং দিয়েছিলেন, কাপিলদেব-বলবিন্দর সান্ধু আর যশপাল। যতীনের ইচ্ছে ছিল, যশপালের পাশে বসে সিনেমাটা দেখবেন। আর লক্ষ্য রাখবেন, যশের মুখের দিকে। নাহ, সেই সুযোগটাই হাতছাড়া হয়ে গেল!