নুতন নায়কের একটা টিভি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। শুনছিলাম। অলিম্পিক্স অ্যাথলেটিকসে ভারতের হয়ে নজির গড়ে দিয়েছেন নীরজ চোপড়া। প্রথমবার দেশের এক অ্যাথলিট হয়ে সোনার পদক জিতে দেশে ফিরছেন। সেই তিনি বলছিলেন, গেমস ভিলেজে হাজির হওয়ার পর থেকে ভালো করে একটা রাতও ঘুমোতে পারেন নি।
বড় মঞ্চে দেশের হয়ে খেলতে নেমে রাতে ঘুম হয় না! এ তো চেনা আরেক চ্যাম্পিয়নের কথা! সচিন তেন্ডুলকর। তিনিও বলতেন, যখনই দেশের হয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলতে নামতেন – ম্যাচের আগের রাতে ঘুমোতে পারতেন না। পরে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বসে শুনেছি, অন্যসব অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খেলতে নামার আগেও এটা হত। সব চ্যাম্পিয়নদেরই কী এমন ‘সাকসেস প্রেসার’ওনাদের কি বাড়তি মোটিভেশন দেয়?
নীরজ রাজ:
সচিনের জন্য এটা সত্যি ছিল। নীরাজের জন্য হয়তো একটু অন্য রকম। কেমন তা? নীরজ জানিয়েছেন সেই কথা:’আমি সরাসরি সুইডেন থেকে টোকিয়ো এসে গেমস ভিলেজে ঢুকি। ওখানকার আর জাপানের মধ্যে সময়ের ফারাক ছিল। তাই চেয়েছিলাম, ভালো করে একটা ঘুম। কিন্তু সময়ের ব্যালান্স করতে সময় লাগলো। দেরীতে ঘুম আসত। চাইতাম একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে। কিন্তু এত বড় আসরের সিস্টেম তা হতে দেয়নি। কখনো সকাল সকাল ডোপিং কন্ট্রোল অফিসারের ডাক এসেছে। ভোর পৌনে ছ’টা থেকে ছ’টার মধ্যে উঠে যেতে হয়েছে ইভেন্টের দুই দিন আগে থেকে।’
কোয়ালিফাইং রাউন্ড থেকে ফাইনাল রাউন্ড – ভালো করে ঘুমই হল না! স্পোর্টস মেডিসিনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা নাকি আবার ‘পারফরম্যান্স অ্যাংজাইটি’। গ্রেট পারফর্মারদের বেশি হয়। সচিনের হত। জানলাম নীরজেরও হয়। আর সোনার পদক জিতে বিশ্বসেরা হয়ে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসছেন। ঘুম এখনও হয়েছে কিনা জানি না। দেশে ফিরে হবে নিশ্চয়ই।
ভারত-পাক কানেকশন!
ভারত – পাকিস্তান সম্পর্ক এখন এত টেনশনের তাতে আজ খেলার মঞ্চ বাদ যাচ্ছে না। কিন্তু শুনলে অবাক হতাম, যখন সচিনের সঙ্গে আলাদা করে সময় কাটাতে চাইতেন এক ঝাঁক পাক ক্রিকেটার। আর নীরজ ! শুনলাম সেই পাক কানেকশন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ছিল এই সাফল্যের সময়।
অলিম্পিক্স ভিলেজ থেকে প্রতিযোগীদের নিয়ে টোকিয়ো ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে বাসে করে যেতে হয়েছে। শনিবারও গিয়েছিলেন। পাশেই বসেছিলেন পাকিস্তানের প্রতিযোগী আরশাদ নাদিম। পাক খেলোয়াড়টি নিজের মোবাইলে তোলা কিছু ছবি ঘাঁটছিলেন। একটা ছবি স্ক্রিনে আসতেই নাকি নীরজকে দেখান। ছবিটি দুজনের। এশিয়ান গেমসের সময়কার। নাদিম নাকি ছবিটা দেখিয়ে ভারতীয় বন্ধুকে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে নীরজের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখে পাকিস্তানের সকলে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, আব্দুল খালিক আর মিলখা সিং! সুবেদার আব্দুল খালিক স্প্রিন্টার ছিলেন। পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ৩৬ টি সোনা, ১৫ টি রূপো আর ১২ টি ব্রোঞ্জ পদক জিতেছিলেন।
জেনে অবাক হয়েছি, এই পাক প্রতিযোগীর সেই যাত্রা পথে মিলখা সিংয়ের নামটা আবারও নীরজের মনে উসকে দিয়েছিলেন। ২৩ বছরের যুবক নীরজ মনে মনে গুরু মানেন প্রয়াত মিলখা সিংকে। মিলখা সিংয়ের না পূরণ হওয়া ইচ্ছে কে বাস্তব করে ওনার হাতে পদক তুলে দেবেন ভেবেছিলেন নীরজ। ওনার চলে যাওয়ার ৫০ দিন পর সেটাই করে উঠলেন হরিয়ানা পুত্তর।
মিলখা আর ঊষা :
এতো বছর পর, মিলখা বা পি টি ঊষার চেষ্টাকে পরিপূর্ণ করে ফেলেছেন নীরজ। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে এই প্রথম অলিম্পিক্স থেকে সোনার পদক এল। পদক তালিকায় বেজিং অলিম্পিক্সে সোনার একটি পদক ছিল। অভিনব বিন্দ্রা শুটিংয়ের লড়াই জিতেছিলেন। নীরাজ তাই সোনার পদকটি উৎসর্গ করেন প্রয়াত মিলখা সিংকে। আর পি টি ঊষাকে। এই সফল নায়ককে বলতে শুনলাম,’মিলখা সিং-জী চলে যেতে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম এই আসরের পদক নিয়ে ওনার সঙ্গে দেখা করবো। এই পদকই তো ওনার স্বপ্ন ছিল। খুব কষ্টের, আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আমি জানি, উনি উপর থেকে সব দেখেছেন। আর এই সোনার পদকের জন্য খুশিও হচ্ছেন।’ আর বলেছেন,’এমনকি পি টি ঊষা, যিনি কয়েক সেন্টিমিটারের জন্য পদক পাননি-আমার বিশ্বাস ওনারা সকলে এখন খুশি।’
অস্বীকার করে লাভ নেই, আমিও খোঁজ রাখতাম না, জাঠ এই যুবকের। আজ কত কিছু খোঁজ পাচ্ছি! যেমন জানতে পারলাম, শেষ রাউন্ডের আগেও তাঁর হৃদযন্ত্রের ওঠা নামা বেড়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, বাকিরা সব বড় সাফল্যের অধিকারী। একটা দারুণ থ্রো সব চেষ্টা ভেঙে ছারখার করে দিতে পারে। সব ধরনের সম্ভবনা নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু জানতেন, বিশেষ কিছু তিনি করবেনই।
করলেনও। রাউন্ড শেষ হতেই দেখছি,ট্র্যাকে হাঁটু মুড়ে বসে তাতে কৃতজ্ঞার চুম্বন এঁকে দিয়েছেন। অমন ‘টারজান’ গোছের চেহারায় দেশের তেরঙা জাতীয় পতাকা ঢেকে স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করছিলেন। মুখে অনাবিল সুখের আবেশ।
নাহ্,একবারও আনন্দসিক্ত বারিধারা ওঁর দুই চোখ বেয়ে নামেনি। বরঞ্চ বলতে শুনলাম : ‘এতদিনের সব কঠিন লড়াই, সব চোট – আঘাত শেষ পাঁচটি বছরের যত যন্ত্রণা সব উবে গিয়েছিল, পোডিয়ামের দাড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠতেই। তখন মনে হচ্ছিল, এমন দিনটির জন্যই তো এত কিছু।’ অনেকে এই পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে অনেকে চোখের জল আটকে রাখতে পারেন না। নীরজ অন্য জাতের চ্যাম্পিয়ন। চোখের জল ফেলতে চাননি। কিন্তু পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত বাজতেই, শরীরে বিদ্যুতের ঝলক অনুভব করেছিলেন।
नीरज ने जैवेलिन को पहुंचाया सूरज तक!
India shines brighter today because of you, Neeraj.
Your javelin carried the tricolour 🇮🇳 all the way and made it flutter with the pride of every Indian.
What a moment for Indian sport!#Olympics #Tokyo2020 #Athletics #Gold pic.twitter.com/FZ52Ti6EZc
— Sachin Tendulkar (@sachin_rt) August 7, 2021
বিশ্ব ক্রিকেটের ‘আধুনিক ডন ব্র্যাডম্যান’ সচিন তেন্ডুলকর এমনই একটা অনুভতির জন্য ১৯৯৮ সালের কমনওয়েলথ গেমসে ভারতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে খেলতে যেতে চেয়েছিলেন। অজয় জাদেজা অধিনায়ক ছিলেন। কুম্বলে ছিলেন সহ অধিনায়ক। মার্চপাস্টে বুক চিতিয়ে হেঁটেছিলেন। কিন্তু সেবার পোডিয়ামে ওঠা হয়নি। সচিনের এতো সাফল্যের মধ্যে এটা ব্যর্থতা। একাধিকবার বলেছেন। তাই দেশের হয়ে এমন সব মঞ্চে কোনও ভারতীয় সফল হলেই, অভিনন্দনের ফুল দেন এস এম এস বা হালের সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে।
চ্যাম্পিয়নদের মধ্যে কিছু না কিছু মিল থেকেই।
ছবি: সৌ – টুইটার