আইসিসির সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সদস্য দেশের নাম কী? এখন চট করে এক নিঃশ্বাসে যে কেউ বলে দেবে – ভারত। প্রমাণ? আজই দেখুন আইসিসির ঘোষণায় কী মিললো! আইপিএল পার্ট টু ১৫ অক্টোবর ফাইনাল। আর দুদিন পরই শুরু হবে একই দেশে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আয়োজক – বিসিসিআই।
মে মাসের প্রথমেই থমকে গেছে, আইপিএল ২০২১। অতিমারি করোনার দ্বিতীয় হানায় গোটা দেশ বেসামাল। এমনকি বায়ো বাবল ভেদ করে ভাইরাস ছোবল মারে ক্রিকেটারদের শিবিরে। বোর্ড বাধ্য হয়, আইপিএল সেখানেই থামাতে। কিন্তু সেইদিন থেকেই ভাবনা শুরু হয়, এই টুর্নামেন্ট শেষ করা যায় কিভাবে।
এখন তো করোনায় এশিয়ার মাটিতে ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়ার একটাই ঠিকানা। আরব আমির শাহি। আবু ধাবি , দুবাই আর শারজা – তিনটি স্টেডিয়াম। আগের বছর গোটা আইপিএল হয়েছিল সেখানে। বেশ নিশ্চিন্তে। বিনা বাধায়। এবার পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডও মাঝপথেই দেশে থামিয়ে দিয়েছিল – পাকিস্তান সুপার লিগ। কারণ সেই করোনা। আর এই দুদিন আগেই বাকিটা শেষ করে নিল, এই মরু শহরে।
আরও পড়ুন – ভারতের তত্বাবধানে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপও মরু শহরে
বিসিসিআই বড়কর্তা সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় স্বয়ং নিজে দলবল নিয়ে কয়েকদিন ছিলেন – ওই মরু শহরেই। সেখানে দুবেলা একটার পর একটা মিটিং করে ছিলেন। প্রথমে ছিল আইপিএলটাকে শেষ করার ছক সাজিয়ে ফেলা। তারপরই অক্টোবরে আইসিসির টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে প্ল্যান এ আর প্ল্যান বি নিয়ে আলোচনা সেরে ফেরেন কলকাতায়। তারপর মুম্বইয়ে এক – দুদিন গেলেও, ইংল্যান্ড আর যাননি। শুনেছিলাম, সেখানে ১২ দিনের কোয়ারানটাইনে থাকতে হবে আর চাননি। কিন্তু ম্যাচের ফল জানার পর মনে হচ্ছে না গিয়ে ভালোই করেছেন। শাস্ত্রী – কোহলি কাহিনীতে তিনি জড়াননি।
আরও পড়ুন – পাকিস্তান ক্রিকেট নিয়ে বেটিং অন্ধ্রে !
যাক সে সব। কিন্তু আইসিসি এভাবে ভারতীয় বোর্ডের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে গেল! আইসিসির নাকি নিয়ম আছে, আন্তর্জাতিক ম্যাচ হওয়ার প্রায় ১৫ দিন আগে থেকে মাঠ পরিচর্চার জন্য খালি রাখতে হয়। খালি মানে, কোনও ম্যাচ হবেনা। কিন্তু ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট আইপিএল ফাইনাল হবে আরব আমির শাহিতে ১৫ অক্টোবর। আর আইসিসির টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরু হয়ে যাবে – ১৭ অক্টোবর। দুদিনের ব্যবধানে! আইসিসি’র নিয়ম নীতি?
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে দেখছিলাম, ম্যাচটির স্পনসর সব কটি কোম্পানির ব্যবসার বাজার ভারত। অধিকাংশ কোম্পানি ভারতের। এটাতে স্পষ্ট, ভারতীয় ক্রিকেটের বাজার এত্তো বড় যে আইসিসি নামটাও তার পাশে নস্যি।
ঘোষণার পর থেকেই দেখলাম, সোশ্যাল মিডিয়ায় পাকিস্তানের ক্রিকেপ্রেমীদের লম্ফঝম্ফ চলছে। যুক্তি হল, এই করোনা কালে ভারতে ক্রিকেট হতে পারে না – এটাই নাকি পাক বোর্ড বলছিল। তাই নাকি ভারত থেকে বিশ্বকাপ সরে এল আইসিসির সদর দপ্তর শহরে। আর পাক ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে আরব দুনিয়া নাকি তাদের দ্বিতীয় হোম। আর এই দেশে পাক দলের সীমিত ওভারের ম্যাচের পরিসংখ্যান যথেষ্ট ভালো। মনের চাপ সরিয়ে ক্রিকেটাররা নাকি এখানে খেলতে পারবে। পাক বোর্ড কর্তারা মনে করেন, ভারতের জন্য ২০২১ এর এশিয়া কাপ তারা করতে পারছে না। তা পিছিয়ে চলে গেছে ২০২৩ সালে। তাই ভারত থেকে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সরে আসায় তারা মনে করছে- বদলা নেওয়া গেল। এটুকু বলতে পারি, ভুল ভাবনা। ভারত আজ বিশ্ব ক্রিকেটের পাওয়ার সেন্টার। তা অর্থের বিচারে। জনপ্রিয়তার বিচারেও।
কোনও বিশ্বকাপ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পর আবার একটি নিরপেক্ষ দেশে হতে চলেছে। নিউজিল্যান্ড প্রথমবার বিশ্বসেরা হয়েছে। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ৮ টি বড় দলের মধ্যে ৭টি দেশ এর আগে বিশ্ব সেরার কোনও না কোনও বার খেতাব জিতেছে। বাকি কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা। এবার তাহলে….
এবার আসা যাক টিম ইন্ডিয়ার শিবিরে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আগে ভারতীয় দল কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই খেলতে গিয়েছিল। আইপিএল থেমে যাওয়ার পর। বাধা না পড়লে টি টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলতেন বিরাট কোহলিরা। হরেদরে তাই হলো। বিনা প্রস্তুতিতে খেলা। ইংল্যান্ডের মাটিতে চূড়ান্ত ব্যাটিং বিপর্যয়ে পরাজয় মানতে হলো আইসিসির একটি টুর্নামেন্টে।
আরও পড়ুন – আইপিএল পার্ট টু: বিদেশীরা না খেললে কাটা যাবে অর্থ
টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগেও তাই হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন দলের হয়ে ভারতীয় ক্রিকেটাররা একই ধরনের ক্রিকেট খেলবে। আর বাকি দলগুলির চলবে বিশেষ প্রস্তুতি। বেশ কিছু দলের বেশ কিছু ক্রিকেটার হয়তো আইপিএল খেলবেন। তাতে মূল দলের প্রস্তুতি মনে হয় না ভেস্তে যাবে।
আরও একটা বাড়তি ঝুঁকি থাকছে এমন পিঠোপিঠি টুর্নামেন্ট হওয়ার। অনেক নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটার চোটের কবলে পরে হয়তো বিশ্বকাপে খেলতেই পারবেন না। তবুও আইপিএল হবে। আর ঠিক তারপরই-টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপও হবে। নিন্দুকরা আজ যদি বলে, বিসিসিআই শুধু অর্থ বোঝে। দেশের সাফল্যের জন্য কোনও সঠিক পদক্ষেপ করে না-খুব কি ভুল বলবে?
উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু বোর্ড কর্তা দের সঙ্গে কথা বলতে হল। তাতে বুঝলাম, আইপিএল এখন বোর্ডের কাছে সোনার ডিম পারা এক রাজহাঁস। সেই দিনের সাইজ দিনকে দিন বড় হচ্ছে। যুক্তি হল: দেশের ক্রিকেট পরিকাঠামো আজ বদলে গেছে আইপিএলের জন্য। দেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাররা বছরে কোটি টাকার মাহিনা পায় এই টুর্নামেন্টের জন্য। দেশের কয়েকশো প্রাক্তন ক্রিকেটার পেনশন পান এই আইপিএলের থেকে পাওয়া টাকার দৌলতে। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে বছরে ১২-১৬ লাখ টাকা পান অধিকাংশ ক্রিকেটাররা। তাঁরা পেশাদার ক্রিকেটারের তকমা নিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়না। মেয়েরাও আজ বোর্ডের চুক্তির অধীনে এসে লাখ টাকা উপার্জন করে। একজন আম্পায়ার হয়ে পরিবার টানার ভরসা পায়। একজন স্কোরার একটাকে ভালো চাকরি ভাবতে পারে – পরিবার টানছে।
এই সব সত্যি। কিন্তু বাস্তব সত্যিটা হল, বোর্ড বাবুরা অলিম্পিকের প্রস্তুতির জন্য যত তাড়াতাড়ি ৭ কোটি টাকা দিয়ে দেন, সেই তৎপরতায় ঘরোয়া ক্রিকেটারদের বকেয়া বা অনুদান দেন না। আবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও করোনা কালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের অনুদান দেয়নি বিসিসিআই।এবার জানলাম, কমিটি গড়া হয়েছে-এই অনুদান বণ্টনের। প্রশ্ন একটাই, শরদ পাওয়ার বোর্ড সভাপতি থাকতে প্রথমবার অন্য স্পোর্টসকে আর্থিক সাহায্য করেছিল বিসিসিআই। তখন পাওয়ারের বন্ধু ছিল কেন্দ্র সরকার। আর এবার ? কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহের ছেলে জয় শাহ এখন বোর্ড সচিব। ভুলে গেলে চলবে না, কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের ভাই এখন বোর্ডের কোষাধক্ষ্য। বোর্ড সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়,এটা যে ভুলতে পারছিনা। চাইও না ভুলতে।
ছবি:সৌ-টুইটার