বাংলা ভাষার কী অপূর্ব ক্ষমতা! ইংরেজিতে আপনি ‘টাকসেস’ বলে কোনও শব্দ পাবেন না। ভিক্টরি পাবেন, ‘ফিক্টরি’ বলে কিছু নেই। কিন্তু বাংলায় আপনি হেসে-খেলে সাফল্য-টাফল্য লিখতে পারেন। জয়-টয় লিখতে পারেন। ভোট-ফোট বলতে পারেন।
কলকাতা পুরসভার ভোট হয়ে গেল। গত বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেস যে সাফল্য পেয়েছিল, তা ধরে রেখেছে পুরভোটে। তখন কলকাতায় তাদের জয় ছিল ১৩২ ওয়ার্ডে, এবারে হল ১৩৪। সাম্প্রতিক কয়েকটি উপনির্বাচনে এবং দু’টি বিধানসভার বিলম্বিত নির্বাচনে বিজেপির যে পতন দেখা যাচ্ছিল, তা বহাল থেকেছে কলকাতা পুরভোটের ফলে। অনেক দূরে, দিগন্ত রেখায় বামেদের একটু একটু নাড়া-চাড়া দেখা যাচ্ছে। সেটা শুভ ইঙ্গিত।
কিন্তু আরও আছে। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত? তিন লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। সূর্যের দূরত্ব? ১৪৭০ লক্ষ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। কলকাতা পুরভোটে কয়েকটি ফলের প্রথম এবং দ্বিতীয়ের মধ্যে ব্যবধান দেখে যদি এই চাঁদ-সূর্যের দূরত্বের সংখ্যাগুলো আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন আপনার মনে হতেই পারে, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরাট এই সাফল্যের পাশে এই সব টাফল্যও আছে। এই চোখ ধাঁধানো জয়ের পাশে বড়ো বড়ো টয়-ও আছে।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের কর্মীদের সতর্ক করেছিলেন ভোটের আগেই। তিনি নিশ্চয়ই এই সব টাফল্য এবং টয় নিয়ে ভাববেন। ব্যবস্থা নেবেন। যাতে সামনের হাওড়া, বিধাননগর এবং অন্যান্য নির্বাচনকে লোকজন ভোটই বলেন। ভোট-ফোট না-বলেন।
আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল ‘মুসলিম ধর্ম প্রচারকেরা’
কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেননি। মুসলিম ধর্ম প্রচারকেরা আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকা। ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর এই দাবি করেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচিপ তাইপএর্দোয়ান। ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকার মুসলিম নেতাদের এক সভায় এর্দোয়ান বলেছিলেন, কলম্বাস স্পেন থেকে জাহাজে আমেরিকা পৌঁছেছিলেন ১৪৯২ সালে। তারও ৩১৪ বছর আগে ১১৭৮ সালে মুসলিম ধর্ম প্রচারকেরা আমেরিকায় গিয়েছিলেন। কলম্বাস তাঁর ডায়রিতে লিখে রেখে গিয়েছিলেন, তিনি ওখানে পৌঁছে একটা মসজিদ দেখতে পেয়েছিলেন। পরের দিন অনুগত সংবাদপত্রে এই খবর বেশ ফলাও করে প্রচারও হয়েছিল। পৃথিবীর সবাই জানেন, প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান নিজেও জানেন, এটা মিথ্যা। তবু তিনি এই যে শিক্ষিতেরা হাসবে জেনেও, প্রকাশ্যে একটা এত বড়ো মিথ্যা বললেন, কারণ তিনি জানেন তাঁর অনুগামীদের একটা বড়ো অংশ এই কথা বিশ্বাস করবেন। সেটাই তাঁর রাজনৈতিক ফয়দা।
আরও পড়ুন-ডুবে ডুবে জল…
আরও একটা দৃষ্টান্ত। এর্দোয়ানের ‘এ কে পি’ পার্টির যুবদের মুখপত্রে লেখা হল পৃথিবীর আকার গোলাকার নয়, প্লেটের মতো চ্যাপ্টা। এটা ২০১৭ সালের ঘটনা। পৃথিবী গোল, এই মিথ্যা প্রচার আসলে খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্র। পরের দিন সেদেশের গোদি মিডিয়ায় পৃথিবী যে চ্যাপ্টা তার পক্ষে নানা যুক্তি সাজিয়ে অনুগত নামী অধ্যাপকেরা বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখলেন। দার্শনিক ব্যাখ্যাও দিলেন কেউ কেউ তাঁদের কথার সমর্থনে। কেউ কেউ বললেন সত্য একটা নয়, বহু। তার মধ্যে বিজ্ঞান একটা সত্য। তার বাইরেও সত্য আছে। সেখানে পৃথিবী গোল না-ই থাকতে পারে। এই হল বিকল্প সত্য। ভিন্নতর সত্য। পোস্ট ট্রুথ। যাঁরা প্রতিবাদ করলেন তাঁদের ট্রোল করে থামিয়ে দেওয়া হল। এর্দোয়ান কি জানেন না এই কথা গুলো মিথ্যা? জানেন। জেনেও তিনি এই ধরনের কথা বলে জনতাকে সম্মোহন করেন। হ্যামলিনের বাঁশীওয়ালার মতো জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখেন এই ধরনের নেতারা।
চলে আসুন ভারতে। উত্তরপ্রদেশে সামনে ভোট। করোনার সময় এই রাজ্যে গঙ্গায় ভেসেছে অসংখ্য লাশ। দারিদ্র, নারী নির্যাতন, দলিত-মুসলিমদের উপর অত্যাচার, এনকাউন্টারে মৃত্যুর সংখ্যায় এই রাজ্য একেবারে সামনের সারিতে। সেই রাজ্যে ভোটের প্রচারে দেখা গেল পুরাণ-ইতিহাসকে নিজের মনের মতো করে ব্যাখ্যা করছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
ইতিহাসের তথ্য, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পরে তাঁর সেনাপতি সেলুকাসকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। গত ১৩ নভেম্বর ভোটের প্রচারে গিয়ে এক জনসভায় যোগী বললেন, এতদিন ধরে বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হয়েছে। এই ইতিহাস যারা লিখেছেন তাঁরা চন্দ্রগুপ্তকে মহান বলেন না। তাঁরা আলেকজান্ডারকরকে মহান বলেন। সেই ভাবেই লেখা হয়েছে ইতিহাস। অথচ আলেকজান্ডার চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
প্রকৃত তথ্য হল আলেকজান্ডার যখন ভারত থেকে বহু দূরে মারা গিয়েছিলেন, সেই সময় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন নাবালক। যোগী কি জানেন না, তিনি ঠিক কথা বলছেন না? জানেন। জেনেও তথাকথিত বিকল্প সত্য তুলে ধরছেন জনতার সামনে। হাততালিও পাচ্ছেন। যুথবদ্ধ ভাবে এক বিরাট জনতা গর্ববোধ করছে। ‘কালেকটিভ নার্সিসিজম’ বলা যেতে পারে একে। এই পোস্ট ট্রুথ জনতাকে খুশি করে। তার মধ্যে অহঙ্কারের জন্ম দেয়। বেকারি বেড়ে চলে, মুদ্রাস্ফীতি আকাশ ছোঁয়, কখনও অনাবৃষ্টি, কখনও বন্যা, করোনার ভয়, এই সব নিয়ে যখন আম জনতা জেরবার, তখন দেশে দেশে এই ধরনের বিকল্প সত্য হয়ে ওঠে রাজনীতির নতুন হাতিয়ার।
পার্লামেন্টের গান্ধী
গান্ধীর মূর্তি যদি ধ্যানমগ্ন হয়, সেখানে প্রতিবাদও নীরবে হতে পারে!
সম্প্রতি গান্ধীকে নিয়ে নতুন একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম, ‘দ্য মার্ডার, দ্য মনার্ক অ্যান্ড দ্য ফকির, আ নিউ ইনভেস্টিগেশন অফ মহাত্মা গান্ধী’জ অ্যাসাসিনেশন । লেখক আপ্পু এসথোসে সুরেশ এবং প্রিয়ঙ্কা কোটামরাজু। মূল বিষয়ে প্রবেশের আগে, সেই বইয়ে গান্ধী সম্পর্কে লেখা একটি নতুন তথ্য পাঠকদের জানাতে চাই। ১৯১৩ সাল। সুশীলকুমার রুদ্র তখন দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ, আর ভাইস প্রিন্সিপাল দীনবন্ধু এন্ড্রুজ। দু’জনে মিলে ঠিক করলেন গান্ধীকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে আনতে হবে। এন্ড্রুজ এই কাজের ভার নিয়ে চলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। টানা ছ’মাস ধরে গান্ধীকে বোঝালেন কেন ভারতে আসা তাঁর দরকার। অবশেষে গান্ধী রাজি হলেন। যখন এলেন ভারতে, প্রথমে বেশ কিছু সময় দিল্লিতে তিনি থাকলেন সুশীলকুমার রুদ্রের বাড়িতেই। তার পর তো সবটাই ইতিহাস। গান্ধী এখনও আমাদের প্রতিবাদের প্রতীক। কলকাতায় যেমন প্রতিবাদ মানেই গান্ধীমূর্তির পাদদেশ, সংসদেও তাই।
সংসদের শীতকালীন অধিবেশন চলছে। আমরা প্রতিদিনই শুনি ১২ জন বিরোধী সাংসদের গান্ধীমূর্তির কাছে বসে প্রতিবাদ করছেন। অন্য বিরোধী সাংসদেরাও সেখানে আসছেন। স্লোগান হচ্ছে। বিরোধীরা তাঁদের অধিকারের দাবিতে এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে আমরা যেমন লাঠি হাতে গান্ধীকে দেখতে অভ্যস্থ, সংসদের এই গান্ধী মূর্তি সেরকম নয়। অনেকটা বুদ্ধের আদলে, ধ্যানমগ্ন গান্ধী।
সংসদকে কী ভাবে সাজানো যায় তা স্থির করতে ১৯৫১ সালে তৎকালীন স্পিকার গণেশ বাসুদেব মভলঙ্কর একটি কমিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে রিপোর্ট জমা পড়ল। তার ভিত্তিতে সংসদে ভারতীয়দের মূর্তি বসানো শুরু হল। প্রথমে এল ১২ফুটের মতিলাল নেহরুর স্ট্যাচু। তার পর ১৯৬৬ তে গোপালকৃষ্ণ গোখলের আবক্ষ মূর্তি। তার পর বাবা সাহেব আম্বেদকার, লালা লাজপত রায়, শ্রীঅরবিন্দ ।এইভাবে ১৯৯৩-এ এল গান্ধীমূর্তি। নরসীমা রাও তখন প্রধানমন্ত্রী। ইলোরা গুহায় রেস্টোরেশন কাজ যিনি করেছিলেন সেই রাম ভানজি সুতারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই গান্ধীমূর্তি তৈরির (দীর্ঘতম প্যাটেল মূর্তিও তাঁর হাতে গড়া)। সুতার পরে অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই এই ধ্যানমগ্ন গান্ধীমূর্তী গড়া তাঁর কাছে ছিল একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।
সংসদে ধ্যানমগ্ন গান্ধীর কাছে যে সাংসদরা প্রতিবাদ জানাতে নিয়মিত অবস্থান করেন, সেই অবস্থান কি নীরব হতে পারে না? মৌন প্রতিবাদও তো প্রতিবাদ! ধ্যানমগ্ন গান্ধীর কীএই টুকু নীরবতা প্রাপ্য নয়!
কেন ১২ বছর?
বাম আমলে পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলদায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর ক্যাম্পে মাওবাদী হামলার পর সন্দেহের বসে জঙ্গলমহলের গরিব যুবক ধৃতিকান্ত মাহাতোকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তখন ধৃতি সবে তিন মাস হল বিয়ে করেছেন। সেই থেকে টানা ১২ বছর ধরে ধৃতি বন্দি বিনা বিচারে। স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। পুলিশ অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। অবশেষেজামিন পেলেন ধৃতিকান্ত। যে আইনজীবী তাঁর হয়ে আদালতে লড়েছিলেন সেই অরিজিৎভূষণ বাগচীকে ধন্যবাদ। পশ্চিমবঙ্গের কারাগারে এরকম কত জন ধৃতিকান্ত বিনা বিচারে আটক আছেন আমরা জানি না। কারামন্ত্রী সেই তথ্য প্রকাশ করুন। দ্রুত যাতে বিচার শেষ হয় সেটা দেখা সরকারের দায়িত্ব। নির্দোষদের মুক্তি দেওয়াও সরকারের ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে পরে। অর্ণব গোস্বামীর জামিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হলে অন্তত ২৪ মাসে জামিন হোক ধৃতিকান্তদের।