আর একটা ২৬ জুন এগিয়ে আসছে। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের একটা কালো দিন হয়ে রয়েছে ওই ২৬ জুন তারিখটি। দেশের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৫-২৬ জুন মধ্যরাতে জরুরি অবস্থা জারি করলেন। রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের এক কলমের খোঁচায় দেশে জারি হয়ে গেল জরুরি অবস্থা। সব রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হল। খর্ব করা হল বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ স্তব্ধ করে দেওয়া হল। অবশ্য ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী দেশের মানুষের কাছ থেকে তার প্রতিদানও পেয়েছিলেন। ওই বছর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কাছে দেশে পর্যুদস্ত হয়েছিল কংগ্রেস। লোকসভা ভোটে জিতল জনতা দল। তিন দশক বাদে বিদায় নিতে হল কংগ্রেস সরকারকে। এই পালা বদলে বিশেষ ভূমিকায় ছিল জয়প্রকাশ নারায়ণ।
দেশে জরুরি অবস্থা জারির ৪৬ তম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে আজকে ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে কিছু প্রশ্ন। দেশে মোদী-শাহ জুটির রাজত্বে গণতন্ত্র কতটা সুরক্ষিত, সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। যে ভাবে দেশে প্রতিবাদ করা, মত প্রকাশ করার অধিকারকে খর্ব করার প্রচেষ্টা চলছে, তাকে অনেকেই অঘোষিত জরুরি অবস্থা বলে মনে করছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বললে, কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করলে সন্ত্রাসবাদী বা রাষ্ট্রদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নাগরিকত্ব আইন, কৃষি আইন ইত্যাদির বিরুদ্ধে সকল প্রতিবাদী আন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহীর ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে। গত এক দেড় বছরে একের পর এক আন্দোলনকারীকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে মামলা করা হয়েছে, যাতে তাঁরা সহজে ছাড়া না পান। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় এখনও অনেক বুদ্ধিজীবী জেলের ঘানি টানছেন। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বিরোধী মনোভাবাপন্ন ছাত্রনেতাদের সরকারি রোষানলে পড়তে হয়েছে। সম্প্রতি দিল্লি আদালত গত বছরের মে মাসে গ্রেফতার হওয়া ৩ ছাত্রনেতাকে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দিলেও তা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অবশেষে আদালতের হস্তক্ষেপেই দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়াল এবং আসিফ ইকবাল তানহা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেতে জেলের বাইরে বেরোতে পেরেছেন। এই ৩ জনকেই ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। দিল্লি হাইকোর্টের ২ বিচারপতি ওই ৩ ছাত্রনেতার জামিনের নির্দেশ দিতে গিয়ে রাষ্ট্রকে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, সরকার প্রতিবাদ আর সন্ত্রাসবাদকে গুলিয়ে ফেলছে। এই দুইয়ের পার্থক্য সরকারের চোখে কোথাও যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এই মানসিকতা আগামী দিনে গণতন্ত্রের পক্ষে দুঃখের দিন হয়ে থাকবে। তাতেও অবশ্য সরকারের লজ্জা হয়নি। দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে।
আরও পড়ুন : কেউ কথা বোল না, কেউ শব্দ কোর না
বিজেপি জমানায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও ভূলুণ্ঠিত। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লেখা বা সম্প্রচার হলেই সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচার নামিয়ে আনা হচ্ছে। ইউএপিএ আইনে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকার মুখে বলছে, আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে। এখানে মানুষের প্রশ্ন তোলার অধিকার আছে। কিন্তু সরকারের কাজে তার বিপরীত দিকটাই ধরা পড়ছে। সদ্য সমাপ্ত জি ৭ সামিটে ভার্চুয়াল ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি যখন এই কথা বলছেন, তখনই আদালত রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রতিবাদ আর সন্ত্রাসবাদ এক নয়। এবার সরকার ট্যুইটারে কর্তৃপক্ষের পিছনে লেগেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গত কারণেই বলেছেন, কেন্দ্র ট্যুইটারকে কন্ট্রোল করতে পারছে না বলে তাকে ধ্বংস করতে চায়। আমাকে কন্ট্রোল করতে পারে না। তাই আমাকে আর আমার দলকে বুলডোজ করতে চায়। ওরা সাংবাদিকদের কন্ট্রোল করতে পারছে না বলে খুন করছে।
সত্যিই তাই। যে কোনও উপায়ে পার, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ কর। বিরোধীদের খতম কর। এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপি সরকারের একমাত্র এজেন্ডা। তবু তো বিরোধীদের দমন করা যাচ্ছে না। দেশ জুড়ে কৃষক আন্দোলনের ৭ মাস পূর্ণ হতে চলেছে। সরকার দমনপীড়ন চালিয়েও তা ভাঙতে পারেনি। সরকারকে মনে রাখতে হবে, শেষ কথা কিন্তু জনগণই বলবে। ২৬ জুন আসছে। জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। পরে মানুষের চাপে তা প্রত্যাহার করতে হয়। মানুষের রায়ে কংগ্রেস সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। সরকারের বোঝা উচিৎ, শত দমনপীড়ন চালিয়েও মানুষকে চুপ করানো যাবে না। ১৯৭৭ সাল দেশকে সেই শিক্ষাই দিয়েছিল।