একেবারে নরক গুলজার। যা খুশি, তাই হচ্ছে দেশে। কিন্তু কথা বলা যাবে না। টুঁ শব্দটি করা যাবে না। তা হলেই পেয়াদা এসে পাকড়ে ধরবে। শুধু দেখে যাও আর শুনে যাও। মুখ বুজে থাক। ভগবান যে গোলযোগ সইতে পারেন না। তিনি নিদ্রা গিয়েছেন। তাই কথা বলা যাবে না, শব্দ করা যাবে না।
এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি দেশের। এই মুহূর্তে করোনা নিয়ে তোলপাড় চলছে দেশে। এই সেদিনও অক্সিজেনের অভাবে কত লোক মারা গেল। হাসপাতালে বেড নেই। বেডের অভাবে কত করোনা রোগীকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হল। খোলা মাঠে, গাছতলায় পড়ে থাকতে হল কত রোগীকে। কিন্তু কিছু বলা যাবে না। কত শত করোনা রোগীর মৃতদেহ কত নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হল। কত লাশ নদীর চরে বালিতে পুঁতে দেওয়া হল। শীর্ষ আদালত কত ভর্ৎসনা করল। কিন্তু সরকার বাহাদুরের কোনও হেলদোল নেই। দেশ জুড়ে করোনার প্রতিষেধক টিকার চরম অভাব। ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে দেওয়া হল, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়স্কদের ১ মে থেকে টিকাকরণ শুরু হবে। কিন্তু কোথায় টিকা? সবাই হন্যে হয়ে টিকা খুঁজে বেড়াচ্ছে। সরকার ঘোষণা করে দিয়েই খালাস। সরকারি তথ্যই বলছে, দেশে মাত্র ৩.১ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছে। ১৩০ কোটি মানুষের দেশে টিকাকরণের এই হার? তা হলে ১৩০ কোটির টিকা পেতে তো বছরের পর বছর গড়িয়ে যাবে! এর বিরুদ্ধে কে কথা বলবে? কার এত সাহস? তিনি তো আত্মনির্ভরশীল ভারতের স্লোগান দিয়েই খালাস। এই যে টিকার হাহাকার, অক্সিজেনের হাহাকার, হাসপাতালে বেডের হাহাকার, এই সমস্যা মেটাতে কোন দাওয়াই আছে সরকারের? দেখে তো মনে হয় না, দেশে কোনও সরকার আছে।
এই কিছুদিন আগে করোনা নিয়ে মুখ খুললে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের এক বিজেপি বিধায়ক। এখন তো সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হচ্ছে। বিরোধী কন্ঠস্বর রুদ্ধ করার এ এক ঘৃণ্য চেষ্টা। বলতে গেলে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে দেশে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আজও ১৬ জন জেল খাটছেন। সেই জেলবন্দিদের মধ্যে আছেন সংস্কৃতি জগতের মানুষ, আছেন শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মী। তাঁরা নাকি সব মাওবাদী? প্রধানমন্ত্রীকে নাকি হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল! বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে (ইউএপিএ) তাঁদের আটকে রাখা হয়েছে। এ এমন এক আইন, যার বলে সরকার কাউকে যতদিন খুশি আটকে রাখতে পারে। জম্মু কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদের আগে সেখানকার বিরোধী নেতাদের গৃহবন্দি করে রাখা হল, যাতে তাঁরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে না পারেন।
সংবাদমাধ্যমের মুখ তো প্রায় বন্ধই করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পারতপক্ষে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন না। ২০১৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তিনি ক’টা সাংবাদিক বৈঠক করেছেন, কেউ জানে না। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে এখন কিছু নেই। এই প্রেক্ষিতেই দেশের শীর্ষ আদালত রাষ্ট্রদ্রোহের সীমা নির্ধারণের কথা বলেছে ৩১ মে। অন্ধ্রপ্রদেশের জগনমোহন রেড্ডির সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে শাসক দলেরই বিদ্রোহী সাংসদকে রঘু রামকৃষ্ণ রাজুকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশ। মেডিক্যাল রিপোর্টের ভিত্তিতে তিনি জামিন পেয়েছেন। ওই সাংসদের বক্তব্য সম্প্রচার করায় রাজ্য সরকার দুটি চ্যানেলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ করে। সঙ্গে আরও নানা অভিযোগ আনা হয়। চ্যানেল দুটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায়। বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সোমবার বলেন, চ্যানেলের মুখ বন্ধ করার জন্যই সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছে। সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ বলে, রাষ্ট্রদ্রোহের সীমা নির্ধারণের সময় এসেছে। সংবাদমাধ্যমের খবর বা তথ্য প্রকাশের অধিকারের জন্যই রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত আইনের ধারার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এর আগেও সুপ্রিম বলেছিল, সরকারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশই রাষ্ট্রদ্রোহ হতে পারে না।
শীর্ষ আদালতের এই পর্যবেক্ষণের পরেও সরকারের ঘুম ভাঙবে কি না, জানা নেই। দেশের মানুষকে আর কতকাল কথা না বলে, শব্দ না করে থাকতে হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।