কলকাতা: সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মনোমালিন্য হলেই পকসো আইন দিয়ে নিরাপরাধ ব্যক্তিকে অপরাধী সাজানো হচ্ছে। বারবার বিভিন্ন মামলায় বিচার করতে গিয়ে এই ধরনের ছবি সামনে আসছে। শুধুমাত্র নির্ভায়া কাণ্ডকে সামনে রেখে এই আইনকে দেখলে চলবে না। আইনের অপব্যবহারকে মাথায় রেখে অবিলম্বে এই আইন সংশোধনের প্রয়োজন। বুধবার এই মন্তব্য করে কলকাতা হাইকোর্ট৷
আরও পড়ুন- বুমরা, শার্দুল এবং সামিদের বিধ্বংসী বোলিং, প্রথম দিনের শেষে ফ্রন্টফুটে ভারত
শুধু পকসো আইন নয়, সামাজিক কোনও বিবাদ হলে অযথা নিরপরাধ ব্যক্তিকে ডাকাতির মামলা দিয়ে অভিযুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। আইন সমাজের মানুষকে রক্ষা করার জন্য। সেই আইনকে অপব্যবহার করে একে-অপরের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উদ্যত হলে পুলিশকে সচেতন হতে হবে। কলকাতা হাইকোর্টে সাজাপ্রাপ্ত এক অভিযুক্তের আবেদনের বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন এই মন্তব্য বিচারপতি শিবকান্ত প্রসাদের।
আরও পড়ুন- মহরম,দুর্গাপুজোতেও করোনার বিধিনিষেধ থাকবে, রাজ্যগুলিকে চিঠি কেন্দ্রের
মুর্শিদাবাদের কান্দি থানার গোকর্ণ গ্রামের বাসিন্দা শীর্ষেন্দু ঘোষ(পরিবর্তিত নাম)৷ তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা রয়েছে। ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর তাঁর ৭ বছরের কন্যা গোকর্ণের বাড়ি সংলগ্ন নবীন ঘোষের(পরিবর্তিত নাম) মোবাইলের দোকানে ক্যাশ কার্ড কিনতে যায়। এরপরই শীর্ষেন্দুবাবু কয়েক জনকে সাক্ষী করে কান্দি থানায় ওই দোকানদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে তিনি বলেন, ওই দোকানদার তাঁর মেয়েকে দোকানের দোতলায় নিয়ে গিয়ে শ্লীলতাহানি করেছে৷ শারীরিকভাবে নিগ্রহও করা হয়েছে। শীর্ষেন্দুবাবুর অভিযোগের ভিত্তিতে দোকানদার নবীনকে গ্রেফতার করে পকসো আইনে মামলা রুজু করে কান্দি থানার পুলিশ। পরে কান্দি আদালতে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। কান্দি আদালত দোকানদার নবীনকে বেকসুর খালাস করে দেন। মামলা চলাকালীন অভিযোগকারী শীর্ষেন্দুকে কান্দি আদালত শোকজ করেন। শোকজের জবাব দিতে গিয়ে শীর্ষেন্দু স্বীকার করে তিনি নবীনের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। তাঁর মেয়ের সঙ্গে নবীন নিগ্রহ করেন নি। মেয়ে দোকানে মোবাইলের ক্যাশ কার্ড কিনতে নবীনের বচসা হয়। নবীন তার মেয়েকে বকাবকি করে। সেই রাগেই তিনি নবীনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছেন।
আরও পড়ুন- চতুর্থ স্তম্ভ: পেগাসাস, পাপড়ি চাট
এরপরই কান্দি আদালত পকসো আইন অপব্যবহারের অভিযোগে পকসো আইনের ২২(১) ধারায় পাল্টা শীর্ষেন্দুকে দোষী সাব্যস্ত করে। তাঁকে চার মাসের জেল ও ২ হাজার টাকা জরিমানা নির্দেশ দেওয়া হয়। আইন অনুযায়ী নিম্ন আদালত এই রায় দিলেও শীর্ষেন্দু জামিনে থাকেন। হাইকোর্ট থেকে এই সাজার অনুমোদন নিতে হয়। সেই মোতাবেক নিম্ন আদালতের রায়কে খারিজের আবেদন নিয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানায় শীর্ষেন্দু।
শীর্ষেন্দুর আইনজীবী প্রদীপ কুমার চট্টোপাধ্যায় আদালতে বলেন, শীর্ষেন্দু ভুল করে ফেলেছে। স্বীকারও করেছে সে। তাঁর মেয়ের বর্তমান বয়স দশ বছর৷ এই অবস্থায় তাঁকে জেল খাটতে হলে ভবিষ্যতে তাঁর মেয়ের বিয়ে নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই আদালত মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিম্ন আদালতের রায়কে খারিজ করুন।
আরও পড়ুন- পুলিশেরই জমি গায়েব, জমি পুনরুদ্ধারে নেমে নাজেহাল উর্দিধারীরাই
সরকারি আইনজীবী ফারিয়া হোসেন এই আবেদনের বিরোধিতা করে আদালতে বলেন, আবেদনকারী শুধুমাত্র নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আবেদন করছেন। তিনি কি ভেবে দেখেছেন নবীনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করায় তাকে জেল খাটতে হয়েছে। শীর্ষেন্দুকে সাজা থেকে মুক্তি দেওয়া হলে সমাজের বুকে অন্য বার্তা যাবে। আইনের অপব্যবহার করে নির্দোষ ব্যক্তিকে সাজা দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে।
আরও পড়ুন- অবহেলার মধ্যেই মহারাজ নন্দকুমারের স্মৃতি বিজড়িত ফাঁসির স্থান
সরকারি আইনজীবী সওয়ালের সমর্থনে বিচারপতি শিবকান্ত প্রসাদের মন্তব্য, এটা ঠিক কথাই৷ এই ধরনের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে নির্দোষ ব্যক্তিকে জেল খাটানো হচ্ছে। আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে আইনের অপব্যবহার করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনকে সর্তক হতে হবে। পাশাপাশি পোকসো আইনের সংশোধন অবিলম্বে প্রয়োজন।
আরও পড়ুন- বন্যায় মৃতদের পরিবারকে দুই লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য ঘোষণা কেন্দ্রের
রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি প্রসাদ মন্তব্য করেন, আমি যদি মেয়েটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শীর্ষেন্দুর নিম্ন আদালতের সাজা খারিজ করি, তাহলে সমাজের বুকে অন্য বার্তা যাবে। তাই কন্যা সন্তানের কথা ভেবে আমি শীর্ষেন্দু সাজা চার মাস থেকে কমিয়ে এক মাসের জেল ও ২ হাজার টাকা জরিমানা বহাল রাখছি৷