১৪ অগস্টের রাত। সাল ১৯৪৭। ঘড়িতে সবেমাত্র ১২টা বেজেছে, অর্থাৎ নতুন দিনের শুরু। কিন্তু চারপাশ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, রাত ১২টা বেজে গেছে। বাজি ফাটছে, তুবড়ি জ্বলছে। সর্বত্র যেন দীপাবলির উৎযাপন চলছে। তবে দীপাবলি নয়, তার থেকেও অনেক বড়, অনেক কষ্টের ফল, স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন চলছে। চারপাশের এই হই হই রব দেখে জওহরলাল নেহেরুর বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। ”The stroke of the midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom”।
এক নয়, দুই নয়। টানা ২০০ বছর সময় লেগেছে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করতে। শেষ পর্যন্ত যখন স্বাধীন হচ্ছে দেশ, তখন কি আর ঘরে বসে থাকা যায়। রাত পোহালেই ১৫ অগস্ট। ভারতকে স্বাধীন দেশ বলে ঘোষণা করা হবে। কিন্তু সকাল পর্যন্ত যে আর উত্তেজনাকে চেপে রাখা যাচ্ছে না। পাড়ার সকলে তখন উৎসবে মেতেছে। শুধু পাড়া কেন বলছি ? এই মুহূর্তে গোটা দেশই উৎসবে মেতেছে। ৮ থেকে ৮০, মুক্তির স্বাদ পেয়েছে সকলেই। তাই আর একটা ঘন্টাও ঘুমিয়ে নয়। চল, সবাই মিলে এক নতুন দেশ গড়ার কাজে হাত লাগাই। মাঝে তো শুধু একটা রাত। বোম পড়ার আওয়াজ, পুলিশের গাড়ির আওয়াজ, বন্দুকের শব্দ, বিপ্লবীদের আর্তনাদের শব্দ, এমন অনেক শব্দেই তো কত রাত ঘুমহীন কেটেছে। আর একটা দিন যদি বন্দীশালার শিকল ভাঙার শব্দে ঘুম না আসে, তাহলে ক্ষতি কী ?
আরও পড়ুন : স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে সকল পড়ুয়াকে, নির্দেশ ইউজিসির
ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর হাতে ভারতের দ্বায়িত্ব হস্তান্তর করে দিয়ে নিজের দেশে ফিরেছেন।
১৫ অগস্ট, ১৯৪৭। বহু প্রতীক্ষার মুহূর্ত শেষ হবে আজ। বহু বিপ্লবীদের রক্তে রাঙানো বন্দিশালা ভেঙে চুড়মার হয়ে যাবে আজ। আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা।
আরও পড়ুন : স্বাধীনতা দিবসের আগে নিরাপত্তা বলয়ে রেড রোড
দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল লালকেল্লায় সামনে। যত দূর পর্যন্ত চোখ যাচ্ছে, কালো মাথার ভিড়। এখনও দলে দলে লোক আসছে। ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হবে সবাই।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, জানি না। ক্রমেই ভিড় বাড়ছে। বুড়ো বুড়ি, যুবক যুবতী, এমনকি কচিকাচারাও বাদ যায়নি। অনেকে স্বপরিবারে চলে এসেছেন। অন্য রাজ্য থেকেও ভ্যানে করে লোক আসছে। আশেপাশের যে কটা উঁচু জায়গা ছিল, সে গুলো ভোরে গেছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবাই। লালকেল্লায় ছাদেও প্রচুর মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
আরও পড়ুন : স্বাধীনতা দিবসে ট্র্যাক্টর মিছিলের আশঙ্কা, উঁচু পাঁচিল উঠল লালকেল্লায়
এভাবেই আরও কিছুক্ষণ কাটল। তারপর হঠাৎ চারিদিক থেকে চিৎকার শুরু হল। আতঙ্কে নয়, উত্তেজনায়। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু লালকেল্লায় এসেছেন ভাষণ দিতে। লালকেল্লায় সামনে উপস্থিত জনসমুদ্র তখন আনন্দ আর উদ্দীপনায় ভাসছে।
পরণে সাদা পোশাক। মাথায় অতি পরিচিত সাদা টুপি। আর হাতে ভারতের পতাকা নিয়ে ভাষণ দেওয়া শুরু করলেন নেহেরু। ভাষণের শুরুতেই মহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানালেন তিনি। ভারতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে তিনি আলো হয়ে পথ দেখিয়েছিলেন। যে পথে হেঁটে আজ স্বাধীন হল ভারত। ভাষণ শেষ হলে ব্রিটিশ পতাকার দিকে এগিয়ে যান জওহরলাল নেহেরু। তারপর তাঁর হাত ধরেই নেমে এল ব্রিটিশ পতাকা এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লালকেল্লার লাহোরী গেটের উপর উঠল ভারতের পতাকা। অনেকটা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, ভারতের তেরঙ্গা পতাকা উড়ছে। একবার তাকালাম চারপাশে। সকলেই তাকিয়ে রয়েছে ওই পতাকার দিকে। চোখে মুখে তাদের এক প্রশান্তির ছোঁয়া। কারোর চোখে জল। মেয়েদের মুখে হাসি ধরছে না।
আরও পড়ুন : স্বাধীনতা দিবসে ফের ট্রাক্টর মিছিলের প্রস্তুতি কৃষকদের
এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেননি তাঁরা। একের পর এক আন্দোলন, বিপ্লব এবং অসংখ্য বলিদানের বিনিময়ে ব্রিটিশদের হাত থেকে ২০০ বছরের অধিকৃত ভারতকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন তাঁরা। আজ বুক ফুলিয়ে ‘আমরা স্বাধীন ভারতের নাগরিক’ বলবেন তাঁরা। আর মনে রাখবেন গান্ধীজি, সুভাষ চন্দ্র বসু, ভগৎ সিং, চন্দ্র শেখর আজাদ, বাল গঙ্গাধর তিলক, লালরাজপত রাই, লক্ষীবাঈ, চিত্তরঞ্জন দাশ সহ আরও অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিঃস্বার্থ অবদানকে।