‘ইন্ডিয়া’ নাম বদল করে ‘ভারত’ করা নিয়ে জোর রাজনৈতিক আকচাআকচি চলছে। কিন্তু কেন? সংবিধানের প্রথম লাইনেই রয়েছে, ‘ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত, শ্যাল বি আ ইউনিয়ন অফ স্টেটস।’ এক জাতি, এক রাষ্ট্র তত্ত্ব অন্তত ভারতের মতো ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ দেশের ক্ষেত্রে খাটে না।
কোথা থেকে এল ইন্ডিয়া অথবা ভারত শব্দটি! দুটি পৃথক শব্দের এক অর্থই হল কী করে?
খুব সম্ভবত সিন্ধু নদ, যাকে গ্রিকরা ইন্দাস নাম দিয়েছিল, সেই সিন্ধু (সংস্কৃত) সভ্যতা বা ইন্দাস সিভিলাইজেশন থেকে ইন্ডিয়া নামের উৎপত্তি। আলেকজান্ডারের পার্ষদ মেগাস্থেনিসের লেখাতেও ইন্ডিয়া শব্দের উল্লেখ রয়েছে। সে প্রায় পঞ্চম খ্রিস্ট পূর্বাব্দের কথা। গ্রিক ছাড়াও ইরানিরা সিন্ধু নদের পূর্ব দিকের ভূখণ্ডকে হিন্দো অথবা ইন্দো বলে ডাকত।
বিরোধী সহ অনেকের আশঙ্কা, সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে এই বিল পাশ করানোর জন্যই। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর লেটারহেড প্যাডেও প্রেসিডেন্ট অফ ভারত দেখার পর থেকে এনিয়ে চর্চা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
ভারত বা ভারতবর্ষ কিংবা ভারতমাতা শব্দটির উৎস কী?
প্রাচীন ইতিহাসবিদদের মতে, শকুন্তলা-দুষ্মন্তের ছেলে ভরতের নামে ভারত নামটি এসেছে। চন্দ্রবংশীয় এই রাজা রাজচক্রবর্তী অর্থাৎ অখণ্ড ভারতের সর্বময় ক্ষমতাধারী ছিলেন। ভারত মূল সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ ধারণ বা বহনকারী। কারও মতে, যিনি আলো ও জ্ঞানের অনুসন্ধানী, তাঁকে ভরত বলে।
ইন্ডিয়াকে ভারত কেন বলে?
এ বিষয়ে অসংখ্য মত রয়েছে। ঐতিহাসিক রোশেন দালাল তাঁর দি রিলিজিয়ন অফ ইন্ডিয়া গ্রন্থে লিখেছেন,
১। ঋগ্বেদে উল্লিখিত ভরত রাজার নাম থেকে দেশের নাম ভারত হয়েছে।
২। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার ছেলে ভরত। যার উত্তরসূরিরা হল পাণ্ডব ও কৌরব।
৩। রামায়ণের রামের ভাই ভরতের নামে এই নামকরণ।
৪। প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথ বা ঋষভের ছেলে ভরত।
৫। নাট্যশাস্ত্রের লেখক ভরতের নাম থেকে এসেছে।
৬। এছাড়াও এই একই নামে অনেক রাজা ও মুনি-ঋষির নাম থেকে আসতে পারে।
তবে সবথেকে বেশি মানুষ বিশ্বাস করেন ভরত রাজার নাম থেকে এই দেশের নাম ভারত হয়েছে। পুরাণমতে, ভারতবর্ষ জম্বুদ্বীপের একটি অংশ ছিল। জম্বুদ্বীপ হল পৃথিবীর সাতটি দ্বীপ বা মহাদেশের একটি দ্বীপ। তবে লেখিকার মতে, ভারতমাতার ধারণাটি উনিশ শতকের দিকে এসেছে। তারও অনেক পরে ১৯৩৬ সালে বারাণসীতে ভারতমাতা মন্দির নামে একটি মন্দিরের উদ্বোধন করেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী।
যদিও ভারতমাতার জন্ম এই বাংলায়। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জলরংয়ে একটি ছবি আঁকেন স্বদেশী আন্দোলনের সময়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কল্পিত রূপের প্রতিকৃতি তৈরি করেন অবন ঠাকুর। প্রবাসী পত্রিকায় ছাপার সময় ছবির নাম ছিল মাতৃমূর্তি। যদিও অবন ঠাকুর ভেবেছিলেন ছবির নাম রাখবেন বঙ্গমাতা। ভগিণী নিবেদিতা এই ছবির নাম দেন ভারতমাতা। ছবির প্রশংসায় নিবেদিতা লিখেছিলেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ছবির আবেদন অনস্বীকার্য। তা নামেই হোক কিংবা ভারতবাসীর মনে। আমার পক্ষে যদি সম্ভব হয়, তাহলে এই ছবি হাজার হাজার ছাপিয়ে আমি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ছড়িয়ে দেব। কৃষকের কুঁড়েঘর হোক বা শ্রমিকের ঘর সকলের দেওয়ালে যাতে এই ছবি টাঙানো থাকে।
কিন্তু মাতৃরূপে দেশভজনার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রবন্ধে একাধিকবার ভারতমাতার পুজো নিয়ে সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। যেমন, ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, আমাদের প্রথম বয়সে ভারতমাতা, ভারতলক্ষ্মী প্রভৃতি শব্দগুলি বৃহদায়তন লাভ করিয়া আমাদের কল্পনাকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল। কিন্তু মাতা যে কোথায় প্রত্যক্ষ আছেন, তাহা কখনো স্পষ্ট করিয়া ভাবি নাই…প্যাট্রিয়টিজমের ভাবরস-সম্ভোগের নেশায় একেবারে তলাইয়া গিয়াছিলাম।…আমাদের পক্ষেও দেশহিতৈষণার নেশা স্বয়ং দেশের চেয়েও বড় হইয়া উঠিয়াছে। সুতরাং, বিজেপি হোক বা হিন্দুত্ববাদীরা হঠাৎ ঔপনিবেশিক নামকরণ ছেঁটে ফেলে সনাতন ভারতের সিংহদুয়ার খোলার চেষ্টা করায় সামান্য সিঁদুরে মেঘ দেখা যাচ্ছে বইকি!