নির্বাচন শেষ, শুভেন্দু, বিকাশ, অধীরের যাবতীয় মামলাবাজী সামলে আজ বা কাল না হয় পরশু নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গ্রাম পঞ্চায়েত, সমিতি বা জেলা পরিষদের দায়িত্ব নেবেন। আগামী পাঁচ বছর ধরে আবার তাদেরই হাত দিয়ে, তাঁদেরই গ্রামের জন্য ৮ কি ৯ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হবে, টাকা আসবে দিল্লির সরকার এবং রাজ্য সরকারের কাছ থেকে। তা কারোর বাপের সম্পত্তি বেচে নয়, আমাদের ট্যাক্সের পয়সায়, স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের ট্যাক্সের পয়সায়, একটা দেশলাই বাক্স কিনলেও যে ট্যাক্স দেয় দরিদ্রতম মানুষটি, তার ট্যাক্সের পয়সায় গ্রামের রাস্তা থেকে স্কুল, পানীয় জল থেকে স্বাস্থ ভবনের কাজ হবে, রাস্তার কাজ হবে, আলো জ্বলবে। গ্রাম মানেই একরাশ অন্ধকার নয়, ছবি হু হু করে বদলাচ্ছে, গ্রামেও মানুষ খোঁজ নিচ্ছে ফাইভ জি কবে আসবে? গ্রামের ছেলেটাও তৈরি হচ্ছে ইউপিএসসি পরীক্ষার জন্য, গ্রামের ছেলেটাও গ্রুপ থিয়েটার করে, গান গায় ইউটিউব চ্যানেল খোলে, গ্রামের মানুষজনের কাছে আজ না চাইতেই বিশ্ব হাজির উঠোনে। কাজেই তার চাহিদা বাড়ছে, তার কৃষি নির্ভর অর্থনীতি থেকে সে ক্রমশ মিশ্র অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে, কৃষি অর্থনীতিও বদলাচ্ছে, ইন্ট্রিগ্রেটেড ফার্মিং শুরু হয়েছে বহু জায়গায়। আর এই উন্নয়নের প্রথম শর্ত হল পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ, তাঁদের হাতেই এই উন্নয়নের দায়িত্ব। ইতিহাস খেয়ালই করবেনা কে ছিল সরকারে? মাথাতেও রাখবে না মানুষ? কাদের আমলে গ্রামের মানুষ একরাশ সবুজ মাখা শহর হয়ে উঠলো? গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে কারা জুড়ে দিল শহরের প্রত্যেকটা সুখ সুবিধা? নিশ্চই মাথায় রাখবে মানুষ, যেমন মনে রেখেছে রাজীব গান্ধীর সময়ে মোবাইল যোগাযোগের স্বর্ণ ইতিহাস, অটল বিহারী বাজপেয়ীর সময়ের গোল্ডেন কোয়াড্রিল্যাটারাল, স্বর্ণ চতুর্ভূজের কথা, মনে রেখেছেন বিধান রায়ের দূর্গাপুর, কল্যাণী, সল্টলেকের কথা। ঠিক তেমন বাংলার মানুষ আজ গ্রামীণ উন্নয়নের এক ধাপে দাঁড়িয়ে, দাবী আরও উন্নয়নের। সেটাই বিষয় আজকে, পঞ্চায়েতে আসুক নবজোয়ার।
আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং অসহায় কাঁথির খোকাবাবু
গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত হল সংখ্যালঘু মতের সংরক্ষণ। আজ এটাই বাংলার প্রতিটি গ্রামের গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম কাজ। হয়ে গেছে তো ভোট। যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা তো সঙ্গেই আছেন, যাঁরা দেননি, এবার তাঁদের সঙ্গে নেওয়ার পালা। কাজেই বিরোধী দল, পরাজিত রাজনৈতিক দলের মানুষজন যেন আগামীদিনে গ্রাম উন্নয়নের সামিল হতে পারে তার গ্যারান্টি হল এই মূহুর্তের প্রথম কাজ। টিউব ওয়েলের বরাদ্দ এলে, লাইট পোসের বরাদ্দ এলে, টয়লেটের বরাদ্দ এলে তালিকার প্রথম সারিতে থাকুক তারা। ৫ বছর পরে আমরা রক্তপাতহীন পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখতে পাব। আহাম্মক রাজভবনের বেমতলব বয়ানবাজী বন্ধ হবে, বিরোধী নেতার ৩৫৫-র ধমকিকে মানুষ পাত্তাও দেবে না, যদি আজ থেকেই গ্রামে যে যেখানে ক্ষমতায় আছেন, তার বিরোধী মানুষজনকে সঙ্গে নিয়ে এই পঞ্চায়েতের জনজোয়ারে নামতে পারেন। আরও সামান্য ব্যাপারও আছে, কোনও টাকা পয়সাও নয়, বহু মানুষের প্রয়োজন একটা শংসাপত্রের, একটা ইনকাম সার্টিফিকেট, তার ছেলের বা মেয়ের পড়াশুনো চালাতে সুবিধে হবে, কিন্তু সেটুকু পেতেই মধ্যে দাঁড়িয়ে দালাল কেলো, কার্তিক, রবি, হাবুদের দল। এ জিনিস বন্ধ করতেই হবে। গ্রাম কৃষি সমিতি, সমবায় হয়ে উঠতেই পারে এক বিরাট হাতিয়ার, মহারাষ্ট্র বা গুজরাটও এক্ষেত্রে মডেল হতেই পারে, সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির হাল বদলে দিতেই পারে, সেটারও দায় নিতে হবে সরকারকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থনীতি আজ সেই মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেখানে সমবায়ের মাধ্যমে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়া যায়। সে সমবায় কৃষি পণ্যের হতে পারে, কৃষিজাত পণ্যের হতে পারে, ভেষজ পণ্যের হতে পারে, দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্যের হতে পারে, ছাগল, মুরগি, হাঁসের হতে পারে। এইসব ক্ষেত্রে বিরাট সম্ভাবনার সামান্য অংশই আমরা ব্যবহার করতে পেরেছি, আসুক না পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সমবায়ে নবজোয়ার। শিক্ষা কেনই বা সীমাবদ্ধ থাকবে এলিট কিছু প্রতিষ্ঠানে, গ্রামের স্কুল থেকে, জেলার স্কুল থেকে ভাল ফলাফল তো হচ্ছেই, এবার সেখানে গড়ে উঠুক প্রেসিডেন্সি বা স্কটিশ, গড়ে উঠুক গবেষণা কেন্দ্র। এই পঞ্চায়েতের মাধ্যমে শিক্ষাতেও আসতেই পারে নবজোয়ার। এবং মানুষের বিশ্বাসের প্রতিটি জায়গায় যুক্তিবাদ আসুক, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই চলুক, রাম থাকুন মর্যাদা পুরুষ হয়ে আমাদের মনে, তা যেন রহিমের সঙ্গে উন্মত্ত কলহে মত্ত না হয়। এবং সেই পরিবেশ গড়ে তুলতে এক বিরাট ভূমিকা নিক আমাদের গ্রাম পঞ্চায়েতের নব নির্বাচিত প্রতিনিধিদল। তৃণমূলে যে এক নবজোয়ার এসেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের গ্রামীণ জীবনে অর্থনীতিতে আসুক সেই নবজোয়ার, এ দায়িত্বও ঐ নবজোয়ারের কান্ডারিদেরই নিতে হবে। আমরা মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই পঞ্চায়েতের বিপুল অর্থ, পাঁচ বছরে প্রায় ৮/৯ লক্ষ কোটি টাকা, তা দিয়ে কি গ্রামের চেহারা আমূল বদলানো যায় না? তাঁরা কী বলেছেন শুনুন।
আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল কোন কোন সত্যিকে সামনে এনে দাঁড় করাল?
ইতিহাস মাঝে মধ্যেই কিছু সুযোগ এনে হাজির করে মানুষের সামনে। রাজীব গান্ধীকে দিয়েছিল ৪০৪ জন সাংসদের সমর্থন, এক ঐ টেলি, মোবাইল যোগাযোগ ছাড়া তেমন বড় তিনি কিছুই করে যেতে পারেননি। বাম দলগুলোকে বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টিকে দিয়েছিল ৩৪ বছরের অখন্ড সময়, শুরুর দিকে ভূমি সংস্কার ছাড়া, না তাঁরাও তেমন কিছুই করতে পারেন নি। এবার বিরাট সুযোগ মমতা অভিষেক, তৃণমূলের সামনে, গ্রামীণ জীবন আর অর্থনীতির চেহারাটাই বদলে দিতে পারেন তাঁরা, দেবেন কি না তা নির্ভর করছে তাঁদের সদিচ্ছার ওপর। কিন্তু সময় চাইছে, মানুষ চাইছে পঞ্চায়েতে আসুক নবজোয়ার।