কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ (Bangladesh War) শেষ হল তেরো দিন পর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর (Mukti Yudh 1971)। এরপর আরও আট মাস পার করে ১৯৭২, অগাস্টের ২ তারিখ, যুদ্ধবন্দি (POW) ৯৩হাজার পাক সেনাকে (Pakistan Army) মুক্তি দিল ভারত। দুই দেশ সিমলা চুক্তিতে (Simla Agreement) সই করল। শুরু হল বিতর্ক। দেশের ভিতরেই সমালোচনায় বিদ্ধ হলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi)। কাশ্মীর সমস্যার (Kashmir Conflict) স্থায়ী সমাধানের জন্য কেন তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে কষাকষি করলেন না? সুযোগ যখন ছিলই তখন কেন তা নষ্ট করলেন ইন্দিরা গান্ধী? (Prime Minister Indira Gandhi) প্রশ্ন উঠল।
সত্যিই তো কেন, কী মনে করে যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিলেন ইন্দিরা? কী ঘটেছিল? কোন অঙ্ক কাজ করেছিল? এমন কিছু ঘটেছিল কি, যা জানতে পারা যায়নি? আর যদি ঘটেই থাকে তা হলে সেই তথ্য সাধারণ মানুষ জানতে পারলেন না কেন? জানলে তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেখান থেকে ইতিহাসের কিছু শিক্ষা নিতে পারতেন। আজ এত বছর সে সব নিয়ে ‘দ্য ওয়ারে’ সেই ইতিহাস নিয়ে কলম ধরেছেন, অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক শশাঙ্ক এস বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, আত্মসমর্পনের দিন। খানসেনার বাহিনী আত্মসমর্পন করে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনার কাছে। অস্ত্র নামিয়ে রাখে পাকিস্তান। দিনটা দুই বাহিনীর কাছে এক কথায় ঐতিহাসিক এবং স্মরণীয়। একটি বাহিনী ছিল একেবারে নতুন আনকোরা, আর একটি অভিজ্ঞতায় ভরপুর। যুদ্ধজয়ের উল্লাসে যখন দুই বাহিনীতে উৎসব চলছে, সে সময় কেন্দ্রের মসনদে বসে আরও কিছু জটিল সমস্যা সামলাতে ব্যস্ত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
১৯৭১-এর যুদ্ধের ছবি
এত বড় একটা যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, অর্থব্যয় এ সব তো ছিলই, ভারতকে সামলাতে হয় শরনার্থী সমস্যা। মাথার উপর চেপে বসা অর্থনৈতিক দায়। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি শরনার্থী পাকসেনার অত্যাচারে কাঁটাতার পেরিয়ে এ পার বাংলায় আশ্রয় নেন। ইতিহাসে যে অধ্যায় একাত্তরের ‘বাংলাদেশ গণহত্যা’ নামেই পরিচিত।
আরও পড়ুন: একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, একটি ফুলের জন্য আমরা অস্ত্র ধরি
ভারতের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তিরানব্বই হাজার পাক-যুদ্ধবন্দির রক্ষণাবেক্ষণ। তাঁদের দেখভাল করা। কেননা বিষয়টি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যা দেশের জাতীয় সুরক্ষা এবং বিদেশনীতির সঙ্গে জড়িয়ে। ইন্দিরার সরকার পাক যুদ্ধবন্দিদের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিয়েছিল, এমনকি জেনিভা সম্মেলনে যে সব নিয়মনীতি রয়েছে, তার বাইরে গিয়েও যুদ্ধবন্দিদের মর্যাদা দিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর তখন একটাই চিন্তা, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে যে ভাবেই হোক জীবিত এবং সুস্থ অবস্থায় বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে যে কোনও মূল্য চোকাতে রাজি ছিলেন ইন্দিরা। এ কথা জানতেন একমাত্র একজন। ইন্দিরার কিচেন ক্যাবিনেটের অন্যরা এ নিয়ে ছিলেন অন্ধকারে। জানতেন একমাত্র, গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রধান রামনাথ কাও। ইন্দিরা গান্ধী জানতেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কতটা ক্রুর। কতটা নৃশংস। পাকবাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন মুজিবুর। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ইন্দিরা জানতেন, একবার যদি মুজিবের ফাঁসি হয়ে যায় তো বাংলাদেশ স্বাধীনতার শুরুতেই অনাথ হয়ে যাবে। ইন্দিরার কাছে এই পরিস্থিতি ছিল দুঃস্বপ্নের মতো।
ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল করতে সব রকমের সাহায্য করেছিল ভারতীয় সেনা। ভারত তাঁর আত্মা-শরীর সমস্ত এক করে দিয়েছিল এই যুদ্ধে। পাকবাহিনী যদি মুজিবুর রহমানকে সে দিন ফাঁসি দিয়ে দিত, তা হলে কী হত? বাংলাদেশ তো বটেই ভারতের স্বপ্নও ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। তাই ভারত কূটনৈতিক দিক থেকে যে কোনওরকম রফা করতে প্রস্তুত ছিল। লক্ষ্য ছিল একটাই, যে কোনও অবস্থায় মুজিবকে জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশে ফেরানো।
আরও পড়ুন: কৃষকরা খালিস্তানি! ইন্দিরা পিষে মেরেছিলেন জঙ্গিদের, লিখলেন কঙ্গনা
এ রকম একটা অবস্থায় চির-প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের হাতে পরাজিত হল পাকিস্তান। প্রতিবেশী ইসলামাবাদের কাছে যা চরম লজ্জার। মহম্মদ জিন্নাহ্’র দ্বিজাতি তত্ত্ব ধাক্কা খেল। দেশের অর্ধেক অংশ বেদখল হয়ে গেল শত্রুর প্রত্যক্ষ মদতে। এই জাতীয় বিপর্যয়ে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াইয়া খান হারের সব দায় নিয়ে পদত্যাগ করলেন। ডেকে পাঠালেন জুলফিকর আলি ভুট্টোকে। ভুট্টো তখন নিউ ইয়র্কে। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে। ভুট্টোকে এটাও জানান হয়, যে তাঁকে চিফ মার্শাল পদে বসানো হয়েছে। যাই হোক রাওয়ালপিন্ডি ফেরার আগে ভুট্টোকে বলা হল মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে কথা বলতে।
ইয়াইয়া খান ও বেঞ্জামিন ভুট্টো
রাওয়ালপিন্ডিগামী বিমান হিথরো এয়ারপোর্টে তেল ভরে নিতে কিছুক্ষণ থামবে এটা জানতে পারে ভারত। জরুরি বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সাউথ ব্লকের বৈঠকে ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রধান রামনাথ কাও, বিদেশ মন্ত্রকের অন্যতম শীর্ষ অফিসার দুর্গাপ্রসাদ ধর, প্রধানমন্ত্রী অফিসের প্রধান সচিব এবং বিদেশ সচিব টি এন কল। এই বৈঠকেই তৈরি হল বাঘবন্দি খেলার কৌশল।
আরও পড়ুন: একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, একটি ফুলের জন্য আমরা অস্ত্র ধরি
চলবে
ঋণ: দ্য ওয়্যার