পর পর তিন বার ৷ শঙ্খধ্বনি ।
তার পর…
আলো না ফোটা ভোরের চার পাশের ছুঁয়ে ভেসে আসত বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠ— “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির।”
পুরুষেরা একে একে জড়ো হতেন নদীর পাড়ে । হাল্কা ঠান্ডায় ধুতির খুঁটে গা-মাথা ঢাকা এক দল মানুষ নিস্তব্ধ হয়ে বসে শুনে যেতেন দুর্গার সৃষ্টি, রণযাত্রা, বিজয়— ‘যা দেবী সবর্ভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ …চণ্ডীপাঠ আর পঙ্কজ মল্লিকের সুরে চরাচর ভাসানো গানের পর গান ।
শ্রোতারা স্থির । সবাই যেন ধ্যানে বসেছেন। ‘‘বাবার মতো অনেককেই দেখতাম, শেষের দিকে কাঁদছেন । কেন, তা তখন বুঝতাম না,’’ বলতে বলতে ফের স্মৃতির সরণিতে হারিয়ে যান আশি ছুঁইছুঁই শ্যামপদ বিশ্বাস। ‘‘সে শোনা তো শোনা নয় ! দুর্গতিনাশিনীর অসুরদলন একেবারে চোখের সামনে দেখতে পেতাম যেন । রণচণ্ডীর রণং দেহী রূপ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ফুটে উঠত চোখের সামনে । আজকের হরেক চ্যানেলে, টিভিতে সচিত্র সেই আখ্যান ওই রকম ফুটিয়ে তুলতে পারে না’’— এক নিঃশ্বাসে বলে গিয়ে থামেন প্রৌঢ় তপন দাস ।
গঙ্গার ঘাটে তর্পণ৷ ফাইল চিত্র৷
মহালয়া মানে পিতৃপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের সূচনা । প্রাতে পিতৃতর্পণ । পিতৃপক্ষ বস্তুত প্রিয়পক্ষ । যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই সময়ে পরলোকগত প্রিয়-পরিজন ফিরে আসেন মর্ত্যের মায়ায় । বৃষ্টির পথ বেয়ে নেমে আসেন তাঁরা । আর জীবিত উত্তরপুরুষেরা জলদান করে তাঁদের তৃপ্ত করেন। সেই ‘তৃপ’ ধাতু থেকেই ‘তর্পণ’। কিন্তু আম বাঙালির ঘরে-ঘরে কবেই যেন মহালয়া হয়ে উঠেছিল রেডিওর আওয়াজে জেগে ওঠা একটা আশ্চর্য ভোর। শোনা শেষ হলে তবে নদীমুখো হওয়া ।
আরও পড়ুন-প্রকাশ্যে মহিলার গলা কেটে খুন, সিসিটিভিতে ধরা পড়ল খুনের দৃশ্য
গঙ্গার পাড়ে আদুর গায়ে, ভেজা শরীরে, পরনে দুধ-সাদা ধুতি গলায় গামছা জড়িয়ে জলে পা ডুবিয়ে বসে আছেন কত মানুষ । তাঁদের হাতে ধরা তামার কুশি । তার মধ্যে জলে ডুবে যব, তিল, গঙ্গামাটি, ফুল, বেলপাতা তুলসী । বাবুবাগানের ষাটোর্ধ্ব মুরারী মণ্ডল বলেন, ‘‘পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করবেন আর সেই মতো পিতৃতর্পণ হবে, এটাই ছিল বিধান । তবে এখন অনেকে মাতৃতর্পণও করেন।’’ সেই দলে আছেন বিএ পাশ যুবক সুমন ভট্টাচার্যেরা তিন ভাই । কয়েক বছর ধরে বাবুঘাটের গঙ্গায় তাঁরা বাবা-মা দু’জনের উদ্দেশেই তিল-জল-তণ্ডুল দিয়ে আসছেন । সুমনের কথায়, ‘‘দেবী দুর্গা তো জগজ্জননী । তাঁর আগমনের আগে পিতৃতর্পণ হবে আর মাতৃতর্পণ হবে না? তা আবার হয় নাকি!’’ উল্টো দিকে, মহিলারা যে তর্পণ করতে পারেন, তা মানেন না গোঁড়া হিন্দুদের একটা অংশ ।
এত ক্ষণ সব ঠিক ছিল ৷ কিন্তু, এই সবের সঙ্গে না কি আসল যোগ, প্রকৃত প্রথম পাণ্ডব কর্ণেরই !
কী ভাবে কর্ণ ?
মহালয়ার সঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সম্পর্ক জানা বাঙালির, এমনকি আকাশবাণীর পরবর্তী মহালয়ার সঙ্গে উত্তমকুমারের ‘ব্যর্থ সম্পর্কে’র কথাও অনেকের জানা ৷ তাই বলে মহাবীর কর্ণ ! জানা, যে মহালয়ায় পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের শুরু ৷ শারদীয় দুর্গোৎসবের পুণ্যলগ্নেরও শুরু মহালয় থেকেই ৷ মহালয়ার মধ্য দিয়েই মা দুর্গা পা রাখবেন মর্ত্যলোকে ৷ এ হল গিয়ে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অন্যতম তিথি ৷ কিন্তু, এর মধ্যে মহাভারত-পুরুষ কর্ণ কোথা থেকে এল ?
জলে নেমে চলছে তর্পণ৷ ফাইল চিত্র৷
আরও পড়ুন-লখিমপুরের ঘটনায় চুপ কেন মোদি, প্রশ্ন তৃণমূলের
মহাভারত অনুযায়ী, মৃত্যুর পর মহাবীর কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে তাঁকে খেতে দেওয়া হয় সোনাদানা, ধনরত্ন ৷ কর্ণ অবাক হন ৷ তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে জানতে চান, ব্যাপার কী ? ইন্দ্র জানান, তুমি সারা জীবন সোনাদানা, ধনরত্নই দান করে এসেছ, পিতৃপুরুষকে জল দাওনি ৷ তাই তোমার জন্য এমন খাবারের ব্যবস্থা ৷ উত্তরে কর্ণ বলেন, এতে আমার দোষটা কোথায় ! পিতৃপুরুষের কথা তো জানতে পারলাম কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে ৷ মা কুন্তি এসে জানালেন, যে আমি না কি তাঁরই ছেলে ৷ তারপর তো যুদ্ধ ৷ আপন ভাইয়ের হাতে মৃত্যু হল আমার ! পিতৃতর্পণের সময়টা পেলাম কোথায় !
আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলের গাড়িতে পিষে মৃতদের সৎকারে রাজি পরিবার
দেবরাজ ইন্দ্র বুঝলেন, প্রকৃতই কর্ণের দোষ নেই ৷ এরপরই তিনি কর্ণকে পনেরো দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দেন ৷ ইন্দ্রের কথা মতো মর্ত্যে ফেরেন কর্ণও ৷ এক পক্ষ কাল অবস্থান করেন, কথা মতো পিতৃপুরুষকে অন্নজল দানও করেন ৷ যার পর পাপক্ষালন হয় কর্ণের ৷
কর্ণ মর্ত্যে এসে যে পক্ষ কাল থেকে পিতৃপুরুষকে অন্নজল দিলেন, তারই নাম হল পিতৃপক্ষ ৷ অর্থাৎ, কিনা কর্ণই পিতৃপুরুষের প্রতি তর্পণ করা প্রথম উত্তরপুরুষ ৷