যা হওয়ার ছিল, তাই হল। সোমবার সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে লোকাল ট্রেনে ভিড় উপচে পড়ল। রবিবার থেকে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে লোকাল ট্রেন চালু করার নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য সরকার। ছুটির দিন বলে রবিবার বেশি ট্রেন চালায়নি রেল। সোমবার থেকে তারা লকডাউন পূর্ববর্তী সময়ের মতো ট্রেন চালানোর চেষ্টা করেছে। ঘোষণা ছিল, কোভিড বিধি মেনে ট্রেন চালানো হবে। থাকবে রেল পুলিশের নজরদারি। কিন্তু কোথায় কী? সকাল থেকে হাওড়া, শিয়ালদহের সব শাখায় লোকাল ট্রেনে বাদুড়ঝোলা ভিড়, ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখার নির্দেশ শিকেয়। সব ট্রেনে গাদাগাদি ভিড়। অধিকাংশ যাত্রীর মুখে মাস্ক নেই। যাঁদের মুখে মাস্ক ছিল, ঠাসাঠাসি ভিড়ের চাপে তাঁদের অনেকের মুখের মাস্ক ছিঁড়ে পড়ে গেল ট্রেনের মেঝেতে। দিনের শেষে অনেক প্ল্যাটফর্মে যুদ্ধক্ষেত্রের লাশের মতো ছেঁড়া ফাটা প্রচুর মাস্ক গড়াগড়ি খেতে দেখা গেল। যাত্রীদের অভিজ্ঞতা বলছে, বহু স্টেশনে আরপিএফ চোখে পড়েনি। হাতে গোনা অল্প কিছু স্টেশনে আরপিএফ সক্রিয় ছিল মাস্ক পরা নিয়ে। এটা বাস্তবে সম্ভবও নয়। প্রতিটা স্টেশনে পুলিশ রাখা সম্ভব না।
এক একটি লোকাল ট্রেন হাজার হাজার যাত্রী উগরে দেয় গুরত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোতে। আরপিএফ বা পুলিশের পক্ষে কতজন যাত্রীকে মাস্ক না পরার দায়ে আটকানো সম্ভব? ট্রেন থেকে নেমেই লোকজন অফিস বা কর্মস্থলের পথে দৌড়তে বাধ্য হন। সোমবারও সেটাই হয়েছে। লোকাল ট্রেন পুরোদমে চালানো হবে বলে অসংখ্য বেসরকারি অফিসের কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের হাজিরায় কড়াকড়ি করে দিয়েছে। অনেক অফিস অবশ্য আগেই কর্মীদের বলে দিয়েছে, যেভাবেই হোক, আসতে হবে। চাকরি বাঁচাতে, পেটের তাগিদে কর্মচারীদের পড়ি কী মরি ছুটতে ছুটতে অফিসে যেতেই হবে। না হলে মাইনে কাটা যাবে। কিংবা চাকরি থাকবে না। অতএব, ঝুঁকি নিয়েই হাজার হাজার মানুষ সোমবার ট্রেন ধরার জন্য হুটোপুটি করেছেন। টিভির পর্দায় সোমবার সকাল সাড়ে নটার সময় বিধাননগর স্টেশনের চেহারা দেখছিলাম। শিয়ালদহমুখী একটি ট্রেন থেকে কয়েক হাজার যাত্রী নামলেন। প্ল্যাটফর্মে শুধুই জনস্রোত। অনেকের মুখেই মাস্ক নেই।
আরও পড়ুন : ২৪ ঘণ্টা পেরলেও নদিয়ায় উঠল না রেল অবরোধ, দুর্ভোগ নিত্যযাত্রীদের
করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর রাজ্য সরকার বাস নিয়ে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাল। প্রথমে বলা হল, বাসে কেউ দাঁড়িয়ে যেতে পারবে না। আসন ফাঁকা রেখে দূরত্ব বিধি মেনে বাস চালাতে হবে। পরে বলা হল, ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহণ করা যাবে। কিন্তু ভাড়া বাড়ানো যাবে না। বেসরকারি বাস মালিকরা সে কথা গ্রাহ্যই করলেন না। বাসগুলি ইচ্ছেমতো ভাড়া নিতে লাগল। সরকার হুমকি দিল, বাড়তি ভাড়া নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বলা হল, বাড়তি ভাড়ার টিকিট দেখিয়ে পুলিশে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাত্রীদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। বাস থেকে নেমে তাঁরা কর্মস্থলে না গিয়ে পুলিশ বা থানার খোঁজ করবেন? শেষে সরকার হাত গুটিয়ে বসে রইল। এখন শহর, শহরতলি, জেলায় বেসরকারি বাস নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়াই নিচ্ছে। সেটাই বৈধতা পেয়ে গেল। ৫০ শতাংশের কোনও বালাই নেই। বাসে ১০০ শতাংশেরও বেশি যাত্রী যাতায়াত করছেন পেটের তাগিদে।
একই অবস্থা লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রেও। কোথায় ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখার বিধান? কোথায় কী? দীপাবলি মিটলে পুরোদমে অফিসকাছারি শুরু হয়ে যাবে। ট্রেন, বাসে লোক উপচে পড়বে। মানা হবে না কোভিড বিধি। আবার হয়ত দেখা যাবে, হু হু করে বাড়বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে। করোনাকে আমরা জয় করেই ফেলেছি বলে কিছু মানব না। ডাক্তার, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে পাত্তা না দিয়ে যা খুশি করব।
আসলে এসব পুলিশ দিয়ে, নিয়ম দিয়ে, নির্দেশিকা জারি করে রোখা সম্ভব নয়। মানুষ যদি সচেতন না হয়, তা হলে কিছুই হবে না। সেই বোধোদয় কবে হবে আমাদের?