কলকাতা: চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’। প্রখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদার দীর্ঘ রোগভোগের পর সোমবার সকালে প্রয়াত হন। বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে তাঁর ভূমিকা তাঁকে কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। অসংখ্য ভালো ছবির নির্মাতা ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। ১৪ জুন থেকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তরুণ মজুমদার। অবস্থার অবনতি হওয়ায় রবিবার বর্ষীয়ান পরিচালককে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়।
সোমবার সকাল ১১টা ১৭ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার। গতকাল থেকেই তাঁর অবস্থার অবনতি হয়েছিল। মাল্টি অর্গান ফেলিওর হয়ে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছিল। আজ সকালে ভেন্টিলেশনে থাকাকালীন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যু হয় তরুণবাবুর।
শুধুমাত্র পরিচালক হিসাবেই নয়, তাঁর বহু ছবির গীতিকার এবং সুরকারও ছিলেন তিনি। বাংলা ছবির ঘরানায় এক অন্য ধারার সূচনা করেছিলেন তরুণবাবু। প্রেম-ভালোবাসা, সমাজ, নারী, হাস্যরস তাঁর ছবির আকর ছিল। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনরা যখন চিন্তাশীল সিনেমার জন্ম দিচ্ছেন, ঠিক সেই সময় দাঁড়িয়ে গৃহিণীর হেঁশেলে সিঁদ কেটে দিয়েছিলেন প্রেমের ছবির রূপকার তরুণ মজুমদার। তাঁর ছবির মূল উপাদান ছিল প্রেম।
তরুণ মজুমদারের জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৩১ সাল। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পদ্মশ্রী, জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শচীন মুখোপাধ্যায় ও দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে যাত্রিক নামে একটি পরিচালক দল গড়েছিলেন তাঁরা। ১৯৫৯ সালে উত্তম-সুচিত্রার ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবির মাধ্যমে যাত্রা শুরু তরুণবাবুর। তাঁর ছবির একটি বিশেষত্ব ছিল রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার। বহু অপ্রচলিত রবীন্দ্রসংগীতকে তাঁর ছবিতে ব্যবহার করে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
১৯৬২ সালে কাচের স্বর্গ ছবির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পান। তারপর পলাতক (১৯৬৩), নিমন্ত্রণ (১৯৭১), সংসার সীমান্তে (১৯৭৫), গণদেবতা (১৯৭৮)। গণদেবতা ছবির জন্য তিনি ফের জাতীয় ও ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। তাঁর জনপ্রিয় সিনেমাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বালিকা বধূ (১৯৬৭), কুহেলি (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ফুলেশ্বরী (১৯৭৪), দাদার কীর্তি (১৯৮০), ভালোবাসা ভালোবাসা (১৯৮৫)।
ছবি করা সূত্রেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বিশিষ্ট অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়ের। তাঁর প্রায় ২০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সন্ধ্যা রায়। ঠিক তেমনই তাঁর ছবির আর একজন শিল্পী ছিলেন উৎপল দত্ত। তাঁর অসংখ্য ছবিতে এই মহান শিল্পীকে তিনি বহুরূপে ব্যবহার করেছেন। বহু নামী শিল্পী তাঁর হাত ধরেই পা রেখেছেন টালিগঞ্জে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রয়াত তাপস পাল। রসায়নের ছাত্র হলেও বঙ্গ সংস্কৃতি ও বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর সবিশেষ অনুরাগ ছিল। কিছু ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্য তাঁর লেখা হলেও বাংলার সনামধন্য লেখক-লেখিকাদের গল্প নিয়ে তিনি ছবি করেছেন। এই কারণেই তাঁর ছবির মূল মশলাই ছিল দর্শককে একটি নিটোল গল্প উপহার দেওয়া। যে কারণে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় কিংবা বাসু চট্টোপাধ্যায়কে চলচ্চিত্র প্রেমিকরা মনে রেখেছেন, ভালো ছবির দর্শক হিসাবে তরুণ মজুমদারকেও তেমনই বাঙালি বুকে ধরে রেখেছে।