সাম্যব্রত জোয়ারদার: দশ বছর আগের এক দিন। মে মাস। বাংলার বৈশাখ। দিনটা ছিল রবিরারের এক রাত। পাকিস্তানের (Pakistan) রাজধানী ইসলামাবাদ (Islamabad) থেকে কত হবে, এই বড় জোর ঘণ্টা তিনেকের দূরত্ব। খাইবার পাখতুনওয়া প্রদেশের ছোট পাহাড়ি শহর অ্যাবটাবাদ (Abbottabad)। সেখানকার এক নিরিবিলি সাদা বাড়ির ছাদে আচমকাই নামলেন মার্কিন কমান্ডোরা। চল্লিশ মিনিটের একটা অপারেশন। রাত দেড়টা, প্রবল বিস্ফোরণের শব্দে তখন অ্যাবটাবাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। কাছেই কাকুল মিলিটারি ক্যাম্প। শহরের বাসিন্দারা প্রথমে ভেবেছিলেন ওখানেই কিছু হয়েছে বোধ হয়। পরে দেখা গেল না ১৮ ফুটের পাঁচিল ঘেরা সেই সাদা বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলছে। তখনও টানা গুলির শব্দ। রকেট লঞ্চারের আওয়াজ। অ্যাবটাবাদের আকাশে উড়ে গেল মার্কিন হেলিকপ্টার। এর কিছু পরেই হোয়াইট হাউজ জানিয়ে দিল, ৯/১১-এর মূল চক্রী, সন্ত্রাসের মুখ ওসামা বিন লাদেন (Osama Bin Laden) খতম।
এরও দশ বছর আগের এক দিন। নিউ ইয়র্ক (New York) শহরের শান্ত সকাল। কাজ কর্ম সদ্য শুরু হয়েছে। অফিসের ঝাঁপ খুলেছে। ম্যানহাটনের আকাশ একেবারে ঝকঝকে নীল। পুরসভার কর্মীরা রাস্তা সারাইয়ের কাজ করছেন। সকাল ৮টা ৪৬ মিনিট। খুব নিচু দিয়ে প্লেন উড়ে গেলে যেমন শব্দ হয়, তেমনই কর্কশ শব্দ। পুরসভার কর্মীরা আকাশের দিকে তাকালেন। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের (World Trade Centre) নর্থ টাওয়ারে সরাসরি গিয়ে ধাক্কা মারল একটা বিমান। আমেরিকান এয়ারলাইন্স, বোয়িং ৭৬৭। উড়ানে ছিলেন বিরানব্বই জন যাত্রী। সঙ্গে ৫ ছিনতাইকারী জঙ্গি। ‘হোলি শিট’। এটিসি ক্রমাগত যোগাযোগের চেষ্টা করছে। ‘বেটি টক টু মি। বেটি আর য়ু দেয়ার? Betty?’
আরও পড়ুন: ‘৯/১১’, ‘পশ্চিমী চাপেই’ বাতিল হল তালিবান সরকারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
ম্যানহাটন, হাডসন নদী থেকে বেশ অনেকটা দূরে নিউ ইয়র্কের স্কাইলাইন ফ্রেমে ধরেছিলেন সিএনএন-এর সাংবাদিক। ফ্রেমে দেখা যাচ্ছিল একটা টাওয়ার থেকে গলগল করে ধোঁয়া বার হচ্ছে। ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন রিপোর্টার। তখনও বোঝা যায়নি কীভাবে আস্ত একটা যাত্রীবাহী বিমান টাওয়ারে ধাক্কা মেরে একেবারে ভিতরে ঢুকে গেল। ফ্রেমে ধরা স্কাইলাইনে দেখা গেল আরও একটা বিমান উড়ে আসছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দিকে। এটাও বোয়িং ৭৬৭। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স। বিমানে ৬৫ জন যাত্রী এবং ৫ ছিনতাইকারী। সিএনএন-এর সাংবাদিক লাইভে আছেন, ফ্রেমে ম্যানহাটনের স্কাইলাইন। সকাল ৯টা ৭ মিনিট, বোয়িং ৭৬৭ সরাসরি গিয়ে ধাক্কা মারল, এবার সাউথ টাওয়ারে। লাইভে পৃথিবী দেখল এই সময়ের অন্যতম ভয়াবহ, রোমাঞ্চকর, থ্রিলার উপন্যাসের দৃশ্যের মত ঘটনা। টিভি রিপোর্টারের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘ওহ্ জিসাস ক্রাইস্ট।’ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল খবর। নিজের দেশের মাটিতেই আক্রান্ত আমেরিকা।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার খবর বাংলা সংবাদমাধ্যমে৷
(মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও আমেরিকার মাটিতে একটা বোমাও পড়েনি।)
এ রকম মোট চারটি বিমান অপহরণ করে জঙ্গিরা। আলাদা আলাদা এয়ারপোর্ট থেকে। বস্টন, নেওয়ার্ক, ওয়াশিংটন। সব মিলিয়ে ১৯ জন জঙ্গি, যাদের অনেকেই ছিল পাইলট, বিমান চালানোয় পারদর্শী। ৯টা ৩ মিনিটের পর কিছুক্ষণের ব্যবধান। পৌনে দশটা নাগাদ রাজধানী ওয়াশিংটনে মার্কিন সেনাঘাঁটি পেন্টাগনে ঢুকে পড়ল আরও একটি বিমান। আমেরিকান এয়ারলাইন্স ৭৫৭। ৬৪ জন যাত্রী, ৫ ছিনতাইকারী জঙ্গি। পনেরো মিনিটের ব্যবধানেই আরও একটা বিমান, পিটসবার্গ থেকে একটু দূরে স্যাংক্সভিলের ফাঁকা মাঠে ভেঙে পড়ে। এই বিমানের টার্গেট কী ছিল জানা যায়নি। তবে গোয়েন্দাদের অনুমান টার্গেট ছিল প্রেসিডেন্ট ভবন, হোয়াইট হাউজ। আর মাত্র ২০ মিনিট দূরত্বেই ছিল ওয়াশিংটন। ভেঙে পড়ার আগে উড়ানের ভিতর ককপিটের দখল নিয়ে ছিনতাইকারী এবং যাত্রীদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। ফ্লাইট এক সময় তীব্র গতিতে হুহু করে নীচে নামতে থাকে। তারপর যেন ঝাঁপ দেয়।
LIVE: The U.S. flag is unfurled at sunrise on the west side of the Pentagon near the 9/11 Memorial in honor of those killed in the terrorist attack. The flag unfurling marks the 20th anniversary and is followed by private and public ceremonies. https://t.co/1s4ZF6TCGT
— Department of Defense ?? (@DeptofDefense) September 11, 2021
আরও পড়ুন: মহিলা বিদ্বেষী তালিবানের সমর্থকদের আক্রমণ জাভেদ আখতারের
প্রাণে বাঁচতে অনেকে ঝাঁপ দিলেন টুইন টাওয়ারের জানলা থেকে। দুই স্তম্ভ মিলিয়ে কম বেশি আড়াইশো লিফট। সব বন্ধ। বিদ্যুৎ নেই। প্রতিটি তলায় অসংখ্য দফতর, রেস্তোরাঁ, দোকান। পঞ্চাশ হাজার মানুষের কাজের ঠিকানা ছিল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হুড়মুড়িয়ে তাসের ঘরের মত সব ভেঙে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে যেন ভেঙে পড়ল মার্কিন দম্ভ, ঔদ্ধত্যের মনুমেন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এও যেন এক অন্যরকমের ‘যুদ্ধ’। নজিরবিহীন আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা।
সেদিন থেকেই ‘অপারেশন এনডিওরিং ফ্রিডমে’র নকশা আঁকতে শুরু করে হোয়াইট হাউজ। টার্গেট ওসামা বিন লাদেন। টার্গেট আল কায়দা। তালিবান। এবং আফগানিস্তান। ওয়াশিংটন থেকে হটলাইনে ফোন ইসলামাবাদে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের কাছে। উল্টোদিক থেকে স্পষ্টতই হুমকির সুর। হয় তুমি আমেরিকাকে সাহায্য কর, না হলে সব কিছুর জন্য প্রস্তুত থাক। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এই পাকিস্তানকে দিয়েই মুজাহিদিনদের হাতে অস্ত্র আর ডলার পাঠিয়ে রাশিয়াকে সামলেছে আমেরিকা। এ বার ওসামা বিন লাদেন কোথায়, পাকিস্তানে আল কায়দার ঘাঁটি কোথায় কোথায় আছে? মুশারফকে তা জানাতে বলল আমেরিকা।
Tomorrow marks the 20th Anniversary of the attacks on Sept. 11. We're sharing our National Guard members' remembrances as #WeRemember911. Maj. Gen. John Andonie shares his story of serving with the @nationalguardny during the attacks on 9/11/2001. More: https://t.co/oWBXBESUHf. pic.twitter.com/PK3czA4Xo6
— National Guard (@USNationalGuard) September 10, 2021
আরও পড়ুন: মহিলারা মন্ত্রী হতে পারে না, সন্তান জন্ম দেওয়াই তাদের কাজ: তালিবান
কিন্তু কেন আমেরিকাকে সে দিন টার্গেট করেছিল আল কায়দা বা ওসামা বিন লাদেন? সৌদি আরবের ধনকুবের ওসামা কেন দেশ ছেড়ে পাকিস্তান হয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল আফগানিস্তানে? তাও লিখব। লিখব এর সঙ্গে কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের যোগসূত্র কোথায়? দু’দশক আগে এক অক্টোবরে, টুইন টাওয়ারে হামলার ঠিক এক মাসের মধ্যে, রাতের অন্ধকারে কাবুল শহরে প্রথম ক্রুজ মিসাইল পড়ে। চোখ ধাঁধানো সবুজ আলোয় ভরে যায় আকাশ। পারস্য উপসাগরে দাঁড় করানো যুদ্ধ-জাহাজ থেকে এরপর একের পর এক উড়ে আসতে থাকে ক্ষেপণাস্ত্র। টার্গেট কাবুল। জালালাবাদ। হিরাট। কন্দহার। টার্গেট ওসামা বিন লাদেন। আর সেই একই শহর থেকে বছর কুড়ি পরে মার্কিন সি-১৭ বিমানে পা রাখলেন মেজর জেনারেল ক্রিস ডোনাহুই। ভিয়েতনাম থেকে যেভাবে একদিন পাততাড়ি গুটিয়ে মার্কিন মারিনরা ফিরে এসেছিল, আফগানিস্তানেও সেই একই ছবির পুনরাবৃত্তি ঘটল। কী পেল আফগানিস্তান এই কুড়ি বছরে?