সাগরের উত্তাল জলরাশি শুনলেই বুকের ভেতরটা কেমন টগবগ করে ওঠে। তায় আবার ক্যারিবিয়ান সাগর, ভার্জিন আইল্যান্ড, নির্জন আনকোরা দ্বীপের ফেননিভ শয্যায় ভার্জিন কিশোরীর উদ্দাম শরীরী বিভঙ্গে ভেসে যেতে যেতে, রতিবিলাসে আদম-ইভ হয়ে ওঠার বাসনা যেন ফুটন্ত লাভার মতো গড়িয়ে পড়ে। উত্তুঙ্গ বুকে ক্যালিপসোর ছন্দ, নাভির অনেকটা ওপরে একফালি আর নীচে আরেক ফালি মখমলি আচ্ছাদন আর নীল জল থেকে উঠে আসা দুগ্ধলাস্য কামনা মসৃণ উরু বেয়ে পিছলে নামে। তাতেই তো মজেছেন বিল ক্লিন্টন থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও থেকে স্টিফেন হকিং, প্রিন্স অ্যান্ড্রু থেকে মাইকেল জ্যাকসন, জর্জ লুকাস থেকে কেভিন স্পেসি, ব্রুস উইলস থেকে জেসন রিচার্ডস, এমনকী বিল গেটসও। দূরে যেখানে সাগর হারিয়ে গেছে পাহাড়ের কোলে, উপত্যকা চিরে যেমন গড়িয়ে নামে মিষ্টি রোদ, তেমনই ভার্জিন কিশোরীর নরম বুকের গিরিখাত বেয়ে নামতে থাকে আকণ্ঠ ডুবে যাওয়ার লিপ্সা। জেফরি এপস্টিনের প্রাইভেট দ্বীপ ছিল বড়ই প্রাইভেট, প্রাইভেট জেটে কখন যে ল্যান্ড করতেন বিল ক্লিন্টন কিংবা স্টিফেন হকিং, আর বিলাসে মোড়া দ্বীপে শরীরী সুখের উল্লাসে কখন যে হারিয়ে যেতেন চরম অন্তরঙ্গতায়, দেবা ন জানন্তি। কতই বা বয়স ওদের, এগারো কি বারো কিংবা ষোলো-সতেরো, ভার্জিন আইল্যান্ডে ওই ভার্জিন কিশোরী-তরুণীদের সঙ্গে উদ্দাম যৌনতায় ভাসতেন মার্কিন ধনকুবের জেফরি এপস্টিন, ভার্জিনিটি ভঙ্গ হওয়ার পর তাদের অঙ্কশায়িনী হতে হত বিশ্বের তাবড় সেলিব্রিটিদের সঙ্গে, তাঁদের মধ্যে কেউ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, কেউ ব্রিটেনের যুবরাজ, কেউ আবার দুনিয়াখ্যাত বিজ্ঞানী, কেউ আবার হলিউড কাঁপানো অভিনেতা।
চোখের সামনে ভাসছে ধু ধু জলারাশি, নির্জন সাগর সৈকত, রোদ পড়ে চিকচিক করছে বালি আর পাড় ধরে সারি-বাঁধা নারকেল গাছের সারি, কচি ডাব আর শাঁসে আকণ্ঠ ভদকা পান আর কচি শরীর নিয়ে সেলেবদের যৌন-বিলাস। জেফরি এপস্টিন অন্তরালে রাখতে চেয়েছিলেন, পারেননি, এ সব কেচ্ছা কি আর ঢাকা দেওয়া যায়! ভার্জিন গার্লের টকটকে লাল বিকিনির আড়ালে থাকা তেল-পিছলানো শরীর যেমন ঢাকা থাকত না, জেফরির যৌনকেচ্ছাও আড়াল করে রাখা যায়নি। লিটল সেন্ট জেমসের সৈকতপাড়ে অন্তত দুমাইল দূরে জেফরি এপস্টিনের বাহাত্তর একরের নির্জন ভার্জিন দ্বীপে ছড়ানো ছেটানো ব্যাভিচার ভিলা, ক্যারিবিয়ান সাগরের মাঝে ব-দ্বীপের ব্যাভিচার এখন সমুদ্রের নীচে নীল গোপন জলরাশির মতোই স্বচ্ছ, কাচের মতো পরিষ্কার। নৌকায় লেখা LSJ, তাতেই ভিলাকর্মীদের আসা-যাওয়া। জেফরির মৃত্যুর পাঁচ বছর পরেও আলোচনায় সেই পেডোফাইল দ্বীপই। যৌনতা আর মাদকের নেশার আঁতুরঘর। ৫৭৭ মিলিয়ন ডলারের বিশাল বাংলো। বাংলোকে সবসময় ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকত একাধিক প্রাইভেট জেট, হেলিকপ্টার। এই কপ্টার বা জেটেই উড়িয়ে আনা হত ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সি নাবালিকাদের। তারপর ব-দ্বীপে চলত উদ্দাম ব্যাভিচার। জেফরির কাঁধে হাত রাখতেন ক্লিন্টন, ট্রাম্পরা, ব্যস, সুন্দরী কিশোরী-সঙ্গ। স্টিফেন হকিং নাকি এই নাবালিকা যৌনদাসীদের সঙ্গে মিলনেই বেশি আনন্দ পেতেন। বিশ্বের কুখ্যাত যৌন অপরাধী জেফরি এপস্টিনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার দ্বিতীয় রিপোর্ট সামনে আসতেই পেঁয়াজের খোসার মতো এক এক করে খুলে যাচ্ছে ব-দ্বীপে ব্যাভিচারের অন্দর-কথা। নয় নয় করেও প্রায় ২০০ জন এমন ব্যক্তির নাম আছে, যারা বিশ্বজুড়েই পরিচিত। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে এপস্টিনের ভার্জিন দ্বীপে রতিসুখের সাগরে হাবুডুবু খেতেন, রতিসুখসাগরের উথাল পাথাল ঢেউয়ে তাঁরা সাঁতার কাটতেন চরম কামনায়। পৃথিবীর মধ্যেই এক নরকে বাচ্চা মেয়েদের উপর নারকীয় যৌন নির্যাতন চলত, যৌনদাসী কেনাবেচাও হত।
১৯৯৮ সালে দ্বীপটি কয়েক কোটি মার্কিন ডলারে কেনেন জেফরি। ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডের অ্যাটর্নি জেনারেল ডেনিস জর্জিয়া বলেছেন, দ্বীপটিতে এগারো থেকে সতেরো বছর বয়সি মেয়েদের নিয়ে আসা হত। তাঁর বান্ধবী ম্যাক্সওয়েল এই কাজে সাহায্য করতেন জেফরিকে। উদ্দাম যৌনতার পর যৌনদাসী, তার পর ‘বিশেষ’ অতিথিদের প্রসাদ হিসেবে নিবেদন করা হত। ২০০১ থেকে ২০১৯ সাল অবধি এমন শয়ে শয়ে নাবালিকাদের ধরে আনা হয়েছিল সেই দ্বীপে। একাধিক নাবালিকার যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত ছিলেন জেফরি এডওয়ার্ড এপস্টিন। তাঁর বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৪০ জন মহিলা হেনস্থার অভিযোগ আনেন। জেফরির বান্ধবী তথা সঙ্গিনী গিলেন ম্যাক্সওয়েলও দোষী সাব্যস্ত হন। এই ম্যাক্সওয়েলই জানিয়েছেন, জেফরির যৌনাকাঙ্ক্ষা নাকি তীব্র ছিল। দিনে তিনবার মিলনের ইচ্ছা হত তাঁর। প্রতিবারই নতুন নতুন নারী। নাবালিকাই বেশি পছন্দ ছিল। বাচ্চা মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে জেফরির ঘরে নিয়ে আসতেন ম্যাক্সওয়েল। তারপর চলত নারকায়ী যৌন নির্যাতন। কামসূত্রের চৌষট্টি কলায় পারদর্শী ছিলেন জেফরি। মেয়েদের দিয়ে প্রতিদিন বডি ম্যাসাজও করাতেন। ব্রিটেনের যুবরাজ অ্যান্ড্রু নাকি এই দ্বীপের বিশেষ অতিথি ছিলেন। তাঁর চাহিদা মেটানোর জন্য নিত্যনতুন মেয়েদের নিয়ে আসা হত দ্বীপে। বাচ্চা মেয়ে না হলে নাকি মন ভরত না প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের। বিলকে এপস্টিনের নথিতে সম্বোধন করা হয়েছে ‘ডো ৩৬’ নামে। জেফরি এপস্টিন মামলায় অন্তত ৫০ বার তাঁর নাম ঘুরেফিরে এসেছে। ট্রাম্প একবার বলেছিলেন, তিনি নাকি জেফকে ১৫ বছর ধরে চেনেন। দারুণ লোক। অনেক মজা করতে পারে। তাঁর মতো জেফরিও সুন্দরী নারীসঙ্গী পছন্দ করে। এদের মধ্যে অনেকেই তরুণী। জেফ তার সামাজিক জীবন খুব উপভোগ করে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। যাঁর মুখে এই কথা, তিনি যে জেফরির ভার্জিন দ্বীপে গিয়ে ভার্জিন সুখ উপভোগ করবেন, এ তো কচি ছেলেও বুঝবে। বিল ক্লিন্টন অবশ্য জেফরিকে একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, জেফরি সফল ফিনান্স ম্যানেজার ও প্রতিশ্রুতিশীল সমাজসেবক। বিশ্বের বাজার সম্পর্কে তাঁর প্রখর জ্ঞান। একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান সম্পর্কেও তাঁর গভীর জ্ঞান। বিশেষ করে আফ্রিকা সফরে বিল নাকি গণতন্ত্রায়ন, দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন, নাগরিক সেবা ও এইডসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেফরির অন্তর্দৃষ্টি ও উদারতা দেখেছেন, তা তারিফযোগ্য। ২০০২ সালে নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনে তাঁকে নিয়ে এমনই প্রশংসায় ভরিয়ে দেন দুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। প্রচারের আড়ালে থাকা দুর্ধর্ষ যৌন নিপীড়ক নামে কুখ্যাত জেফরির ছিল প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তারকাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এগুলোকে কাজে লাগিয়েই যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতেন জেফরি। এপস্টিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় বিল গেটসের প্রাক্তন স্ত্রী মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটসও চূড়ান্ত অখুশি ছিলেন।
১৯৫৩ সালে জন্ম, কোনি আইল্যান্ডে বড় হওয়া জেফরি এপস্টিন পড়াশোনা করেন লাফিয়াত হাই স্কুলে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কুপার ইউনিয়নে ফিজিক্স পড়েছেন। ১৯৭১ সালে কুপার ইউনিয়ন ছেড়ে দেন এবং নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথেমেটিক্যাল ফিজিওলজি অফ হার্ট নিয়ে ভর্তি হন। কিন্তু পড়া শেষ করেননি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালে ডালটন স্কুলে ক্যালকুলাস ও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ডালটনে শিক্ষকতা ছেড়ে দেন এবং স্টিয়ার্নসের আমেরিকান স্টক এক্সচেঞ্জে একজন ফ্লোর ট্রেডারের জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর কেরিয়ারে দ্রুত উন্নতি।
১৯৮২ সালে নিজেই জে এপস্টিন নামে কোম্পানি খুলে ফেলেন। এখানে তাঁর সার্ভিস নিতে হলে ক্লায়েন্টদের এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক হতে হত। তিনি তাঁদের বিনিয়োগের পরামর্শ দিতেন। সমাজসেবা ও কর সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়েও আশ্বস্ত করতেন। এভাবেই ক্ষমতাধরদের সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে এপস্টিনের। ১৯৯২ সালে তিনি ম্যানহাটনের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত বাড়ির মালিক হন। কর সংক্রান্ত কারণে তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে তাঁর ব্যবসার যাবতীয় কাজ করে আসছিলেন সেন্ট টমাস দ্বীপ থেকে। ওই দ্বীপের কাছে লিটল সেন্ট জেমস দ্বীপটি কিনে ফেলেন তিনি। এ দ্বীপ থেকে তিনি তাঁর ফাউন্ডেশনের কাজও করতেন, যার নাম ছিল জেফরি এপস্টিন সিক্স ফাউন্ডেশন। তাঁর ফাউন্ডেশনটি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬.৫ মিলিয়ন ডলার ডোনেশন দিয়েছিল। এর পরেই বিল ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচয় তাঁকে তারকা খ্যাতি এনে দেয়। বিল ক্লিনটনের ফাউন্ডেশনের আফ্রিকা সফরের এইডস প্রতিরোধ প্রজেক্টে তাঁর ব্যক্তিগত ৭২৭ বিমান ব্যবহার করতে দেন। সেখানে বিল ক্লিন্টন ছাড়াও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন হলিউড অভিনেতা কেভিন স্পেসি ও কমেডিয়ান ক্রিস টাকার। ২০০২ ও ২০০৩ সালের মধ্যে এপস্টিনের ব্যক্তিগত বিমানে ক্লিনটন একাধিকবার ভ্রমণ করেন। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখতেন। তাঁদের মোটা অঙ্কের ফান্ড দিতেন। এভাবে নিজেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বলয়ে নিয়ে আসেন। সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকলেও এর আড়ালে জেফরির ছিল অন্ধকার জীবন। তীব্র নারীসঙ্গলিপ্সা। তাঁর দ্বীপে কিংবা ম্যানহাটনের বাড়িতে প্রায় প্রতিদিন নিত্যনতুন নাবালিকা নিয়ে যেতেন। তাদের দিয়ে শরীর মালিশ করাতেন। তাদের কাপড় খুলতে বাধ্য করতেন। এরপর হস্তমৈথুন করতেন কিংবা তাদের সঙ্গে সহবাস করতেন। অনেককে ধর্ষণও করেছেন। তিনি আবার এসবের বিনিময়ে পারিশ্রমিকও দিতেন। ৩০০ ডলার থেকে ১,০০০ ডলার পর্যন্ত হত পারিশ্রমিক। আমেরিকার বাইরে থেকেও অল্পবয়সী তরুণীদের ধরে আনতেন। তাদের বলতেন আরও মেয়ে এনে দিতে। তাঁর চাহিদা ছিল কমবয়সী তরুণী। এভাবে তিনি একটা সেক্সুয়াল পিরামিড স্কিম তৈরি করেন। কেউ অভিযোগ করতে চাইলে প্রভাবশালী আইনজীবী কিংবা গোয়েন্দাদের দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করাতেন। ২০০৫ সালে ফ্লোরিডা পুলিশের কাছে এক নারী অভিযোগ করেন, তাঁর মেয়েকে এক মধ্যবয়সী পুরুষ যৌন হয়রানি করেছে। পাম বিচের গোয়েন্দারা তদন্ত করতে গিয়ে একাধিক তরুণীর সাক্ষ্যে প্রমাণ পান, এপস্টিন তাঁদেরকে যৌন হয়রানি করেছেন। এ মামলাটি তখন এফবিআইয়ের কাছে চলে যায়। ২০০৮ সালে পতিতাবৃত্তির দায়ে তাঁকে সাজা দেওয়া হয়। এফবিআই ৪০ জনের প্রমাণ পেয়েছিল। এপস্টিনের শিকার হওয়া নারীদের জীবন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এপস্টিনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগের সময় ও পরের সময়। তাঁর যৌন নিপীড়নে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অনেকে নেশায় জড়িয়ে পড়ে। এপস্টিনের লক্ষ্য ছিল মূলত গরিব ও অসহায় নারী। তাঁর এক ভুক্তভোগী নারী ছোট সন্তান রেখে হেরোইনের ওভারডোজে মারা যান। তাঁর নাম যৌন অপরাধীদের তালিকায় উঠলেও কোনও ফেডারেল বা স্টেট প্রিজনে থাকেননি। বরং পাম কাউন্টি জেলের প্রাইভেট এক উইংয়ে ছিলেন।
তিনি সেখানে দৈনিক ১২ ঘণ্টা ও সপ্তাহে ছয় দিন ‘কর্মঘণ্টায়’ ছাড়া পাওয়ার সুবিধা ভোগ করেছেন। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির তখনকার চেয়ারম্যান রিন্স প্রিবাস সন্দেহ করেন, বিল ক্লিনটনও এপস্টিনের অপকর্মের একজন সঙ্গী। তিনি বলেন, আপনি যখন জেফরির মতো ব্যক্তির সঙ্গে একাধিকবার ঘুরে বেড়ান, তাঁর প্লেনে চড়েন, উইকেন্ডে ঘোরেন, এমন সব জায়গায় যান, যেখানে খুব বাজে কিছু ব্যাপার ঘটার অন্তত অভিযোগ এসেছে, তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না, সাবেক প্রেসিডেন্ট কী করে বেড়াচ্ছেন। ওই সময় ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও এক নারী অভিযোগ করেন, ১৯৯৪ সালে এপস্টিন ও ট্রাম্প তাঁকে ধর্ষণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। যদিও পরবর্তীতে মামলা তুলে নেন।
‘মি টু’ আন্দোলন শুরু হলে এপস্টিনের নাম ফের শিরোনামে উঠে আসে। ভুক্তভোগী নারীরা ফের অভিযোগ করতে শুরু করেন। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ফ্রান্স থেকে ভ্রমণ শেষে ফেরার সময় নিউ জার্সি বিমানবন্দর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। নিউইয়র্কের ফেডারেল কোর্টে নারী পাচারের মামলায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়। তখন ফের তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিস্তর চর্চা হতে থাকে। সামনে আসে একাধিক বান্ধবীর নাম, ইভা অ্যান্ডারসন ডুবিন, ঘিসলাইন ম্যাক্সওয়েল। ইভার সঙ্গে এগারো বছর ডেটিং করেন এপস্টিন, পরে গ্লেন ডুবিনের সঙ্গে বিয়ে হয় জেফরির। তখনও মাঝে সাঝে তাঁর বিছানা গরম করতে আসতেন ইভা। এরপর জেফরির জীবনে আসেন ম্যাক্সওয়েল। এপস্টিনের বেশ কয়েকজন গৃহকর্মী ২০০৯ সালে সাক্ষ্য দেন যে, ম্যাক্সওয়েল তাঁর পাবলিক এবং প্রাইভেট দুটো জীবনেই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরে এপস্টিইন ফ্লোরিডার পাম বিচে তাঁর একটি কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ঘিসলাইন কর্পোরেশন রাখেন। প্রিন্স অ্যান্ড্রু, টম ব্যারাক, বিল ক্লিন্টন, জর্জ স্টেফানোপোলোস, ডোনাল্ড ট্রাম্প, কেটি কুরিক, উডি অ্যালেনর মতো তাবড় সেলেবদের সঙ্গে পার্টি করতেন জেফরি। তাঁর ছাপানো ফোন ডিরেক্টরিতে নাম আছে রুপার্ট মারডক, মাইকেন ব্লুমবার্গ, রিচার্ড ব্র্যানসন, অ্যালেক বলডুইন, মাইকেল জ্যাকসনের। এ ছাড়া এহুদ বারাক, টনি ব্লেয়ার, মহম্মদ বিন সমলনও ছিলেন জেফরির পরিচিত।
এপস্টিনের ছিল একটি ব্যক্তিগত বোয়িং জেট, যাতে চড়ে এদিক সেদিক যেতেন তিনি। বছরে অন্তত ছশো ঘণ্টা উড়ত এটি। ভার্জিন দ্বীপের স্থানীয়দের কাছে এর ডাকনাম ছিল লোলিতা এক্সপ্রেস। কারণ লিটল সেন্ট জেমসের দৃশ্যত অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সঙ্গেই এটির ঘন ঘন আগমন। এপস্টিন একবার কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর আমন্ত্রণে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট পাস্ত্রানা আরাঙ্গোর সঙ্গে ওই বিমানে চড়ে কিউবায় যান। কারও মতে, এপস্টিন সম্ভবত মার্কিন আইন প্রয়োগের হাত থেকে বাঁচার জন্য কিউবায় পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিউবায় পাকাপাকি বাসস্থান বানাননি। বরং ভার্জিন দ্বীপে নৈশবাসর ছিল জেফরির জীবনের সবথেকে বিলাসময় অধ্যায়, যা তাঁকে পরিচিতি দিয়েছে। সেই জয় বাবা ফেলুনাথে মগনলাল মেঘরাজের ডায়লগটা মনে পড়ে যেতে পারে, নাম কি বলছেন, বদনাম বলুন। ঠিক তাই, বদনাম কু়ড়িয়েছেন বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম কুখ্যাত যৌন নিপীড়ক জেফরি এপস্টিন। ব্ল্যাকমেলের মতো অপরাধমূলক উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট মানুষদের মেয়েদের সঙ্গে যৌন কার্যকলাপ রেকর্ড করার জন্য এপস্টিন তাঁর ভিলার একাধিক জায়গায় অসংখ্য গোপন ক্যামেরা বসিয়েছিলেন। ঘিসলাইন ম্যাক্সওয়েল এক বন্ধুকে একবার বলেছিলেন, ভার্জিন দ্বীপে এপস্টিনের ব্যক্তিগত দ্বীপটি ভিডিয়োর জন্য সম্পূর্ণভাবে যুক্ত ছিল। দুহাজার ছয়ে পুলিশ যখন তাঁর পাম বিচের বাসভবনে অভিযান চালায়, তখন তাঁর বাড়িতে দুটি গোপন ক্যামেরা পাওয়া যায়। এটিও রিপোর্ট করা হয়েছিল যে নিউ ইয়র্কে এপস্টিনের প্রাসাদটি একটি ভিডিয়ো নজরদারি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। এফবিআই তাঁর বাসভবনে তল্লাশি চালিয়ে একাধিক নাবালিকার প্রচুর ছবি, একাধিক গোপন ক্যামেরা উদ্ধার করে। তদন্তের বিশদ বিবরণে অভিযোগ রয়েছে যে, এপস্টিনের জন্মদিনের জন্য ফ্রান্স থেকে একটি বারো বছরের মেয়েকে উড়িয়ে আনা হয়, তার সঙ্গে একাধিকবার যৌন সম্পর্কের পর তাকে পরের দিন দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তবে প্রচুর ডলার তাকে দেওয়া হয়েছিল। এটাও অভিযোগ করা হয়েছিল, ব্রাজিল ও অন্যান্য দক্ষিণ আমেরিকার দেশ, রাশিয়া, ইউরোপ থেকে অল্পবয়সী মেয়েদের নিয়োগ করা হয়েছিল এবং জিন লুক ব্রুনেলের ‘MC2’ মডেলিং এজেন্সিও এপস্টিনের কাছে মেয়ে সাপ্লাই দিত।
শেষ জীবনে জেলে বন্দি ছিলেন জেফরি। ২০১৯ সালে ৬৬ বছর বয়সে জেলেই তাঁর মৃত্যু হয়। শোনা যায়, জেলে আত্মহত্যা করেছিলেন জেফরি। এ লেখা পড়তে পড়তে অনেক পাঠকের মনেই বাসনার উদ্রেক হতে পারে, একবার ক্যারিবিয়ান সাগরে ভার্জিন আইল্যান্ডে উঁকি দিয়ে দেখলে কেমন হয়। সেই মখমলি ভিলা, টান টান সাদা বিছানা, বহু ভার্জিন কিশোরীর প্রথম রক্তের লাল আভা, উঠোনে সুইমিং পুল আর তার স্বচ্ছ নীল জল, যেখানে হয়ত শুধু একটা অন্তর্বাস পরে সাঁতার কাটতেন বিল ক্লিন্টন কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম কিংবা প্রিন্স অ্যান্ড্রু বা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও আর তাঁদের চারপাশে একগুচ্ছ নরম কিশোরী। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ নীলে জলকেলি আর নিস্তরঙ্গ জলে উত্তাল উদ্দামতা। নাহ, সে গুড়ে বালি, কারণ, বর্তমানে ওই দ্বীপটি সিল করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পাহারায় আছে এফবিআই। অনন্ত জলরাশির গায়ে আলতো ভাসছে ভার্জিন দ্বীপের ভার্জিন আঁধারের কথকতা, ব-দ্বীপে ব্যাভিচার।