পাশে আছি।
মানুষ এমনি পাশে থাকতে পারছে না। তবু পাশে আছে। এ-পাড়ার অমুকের জন্য আছে, ও-পাড়ার তমুকের জন্য আছে, ডেনমার্কের ক্রিশ্চিয়ান এরিকসনের জন্য আছে। আমরা বেঁধে বেঁধে আছি। পাখির ছানার মতো ঠোঁট ফাঁক করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ভালোবাসা।
কে এই এরিকসন? ডেনমার্কের তারকা ফুটবলার। ইন্টার মিলানে খেলেন। কিন্তু তাতে কী? রোনাল্ডো বা মেসি তো নন। চিনতেই হবে তার কী মানে? আমিও চিনতাম না। কিন্তু কাল যখন মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলেন, ভেবেছিলাম কেউ ল্যাং মেরেছেন। কিন্তু কেউ মারেননি। তিনি নিজেই সামনের দিকে উপুড় হয়ে পড়েছেন। হার্ট এটাক। কিন্তু আমরা কি জানতাম heart attack? না। ফুটবল মাঠে প্রতি মুহূর্তে কেউ না কেউ আছাড় খায়। তিনিও খেয়েছেন। আর আছাড় খাওয়ার দু’মিনিটের মধ্যে বিশ্ববাসী জানলেন, ছেলেটির নাম ক্রিশ্চিয়ান এরিকসন। বিশ্বের কোথাও তখন সকাল, কোথাও বিকেল, কোথাও বা দুপুর। তাতে কী! সকলেরই জোড়হাত আকাশের দিকে। ভালো হয়ে ওঠো তুমি এরিকসেন। ভালো হয়ে ওঠো। একটি মানুষের জন্য সারা বিশ্ব প্রার্থনা করছে, এ দৃশ্য শেষ কবে দেখা গেছে? আমরা কিন্তু বেঁধে বেঁধে আছি।
ফুটবল মাঠে পড়ে যাওয়া কোনও ঘটনা নয়। কিন্তু পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সতীর্থ খেলোয়াড়ের চোখ ছলছল, আগে দেখিনি। এরিকসন পড়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁর চোখ স্থির হয়ে যায়। ভয় পেয়েছিলেন সতীর্থরা। কেউ চোখ মুছছেন, কেউ জার্সি দিয়ে চোখ ঢাকছেন, আমরা যাঁরা এরিকসনের নামই শুনিনি, টের পাচ্ছি, চোখের কোণে কিছু একটা সুড়সুড় করছে। বেঁচে আছে তো ছেলেটা? তাঁর স্ত্রী কাঁদছেন। ঘন ঘন চোখ মুছছেন ফিনল্যান্ডের খেলোয়াড়রাও। আমি চিনতাম না ওঁকে। কিন্তু মুহূর্তে ‘মন যে বলে চিনি চিনি।’ বেঁচে আছ তো তুমি ভাই? এরিকসন তখন সুদূর ডেনমার্কের কেউ নন। আমার পাড়ার নান্টু অথবা মন্টু। খেলতে গিয়ে চোট পেয়েছে। আমি তার পায়ে লাগিয়ে দিচ্ছি উষ্ণ চুন-হলুদ।
বহুদিন বাদে মাঠে লোক দেখে কী ভালো লাগছিল। যেন শীতের জীর্ণ কম্বল সরিয়ে কুচি কুচি দখিন হাওয়া। কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল রং ছেয়ে ছিল কোপেনহেগেনের গ্যালারি। রেকর্ড করা যান্ত্রিক আওয়াজ নয়, মানুষের কথায়, মানুষের সুরে, মানুষের গানে যেন বসন্তের অবিরাম হিল্লোল। হঠাৎ ছন্দপতন। সারা বিশ্বের চোখে জল। ফুটবল আসলে সব পারে। ফুটবল আসলে মানুষকে বাঁধতে পারে। ওই যে কোণের দিকে এরিকসনকে ঘিরে রেখেছেন সতীর্থরা। লং শটে কিছু ক্রন্দনরত মানুষের জটলা। আর আমরা প্রতি পলে বুঝে নিতে চাইছি জটলার ভাষা, কী হল? কী হল? কেউ কিছু বলছে না কেন? তবে কি…। সামনে সবুজ মাঠ, মাঠের কোণে জীবন-মৃত্যুর হিসেব নিকেশ। এমন হাহাকারের মতো নৈঃশব্দ বহুদিন দেখিনি। একটু আগে যে-মাঠে ছিল দখিন হাওয়া, সেই মাঠকেই যেন মনে হচ্ছে মৃত্যু উপত্যকা। যেন ডেনমার্কে এক দমবন্ধ করা অপারেশন টেবিল। বিশ্ববাসী তার দরজায় দাঁড়িয়ে। সকলের জোড়হাত আকাশের দিকে, ভালো হয়ে ওঠো তুমি এরিকসন, ভালো হয়ে ওঠো। ডাক্তার বলেছেন, তাঁর পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। চোখ ছিল স্থির। ডাক্তার ও সতীর্থরা বারবার তাঁর বুকে চাপ দিয়ে শ্বাস চালু করার চেষ্টা করছিলেন। তখন মনে হচ্ছিল, ছুটে যাই মাঠে। একটু বুকে হাত দিয়ে আসি। চিনি না, নাম শুনিনি, তবু…।
এরিকসনকে যখন মাঠ থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, গ্যালারির একপ্রান্ত বলছে, ক্রিশ্চিয়ান ক্রিশ্চিয়ান। আর এক প্রান্ত বলছে, এরিকসন এরিকসন। আসলে গ্যালারির দু’প্রান্ত নয়, আসলে পৃথিবীর দুই মেরু। জীবনের কী বিপুল স্পন্দন! ফুটবল সব পারে। হাওয়া-তিরতির মাঠে ফুটবলই ফিসফিসিয়ে বলে যায়, পাশে আছি।
পাশেই আছি। বাংলার এঁদো গাঁ হোক কিংবা ডেনমার্কের রাজপ্রাসাদ—পাশে আছি। ভালো হয়ে ওঠো এরিকসন, ভালো হয়ে ওঠো।