রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকেত্তায় আছি। হুতোমের কলকাতার উপলব্ধি বঙ্গাব্দ পেরিয়ে এসে আজও শহরের ইন-থিং। ফি-বছর মশার-হুল পুরসভাকে দংশাচ্ছে। বরাদ্দ অর্থ ধ্বংস করছে। ফি-বছর মাইকিং চলছে। বাড়ির সামনে আবর্জনা জমতে দেবেন না। জল জমতে দেবেন না। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপাচ্ছে সরকার বাহাদুর। কিন্তু ‘পোঁওওওও’ থামছে না। ম্যালেরিয়াসুর বধের শহরেই বারংবার রূপ বদলিয়ে হারেরেরে করে যুদ্ধংদেহী ফিরে আসছে মশক-অবতার।
গত দু’বছর ধরে পৃথিবী আর মানবজাতি লড়ছে এক ভয়াবহ অতিমারির সঙ্গে। করোনা ভাইরাস। কোভিড-নাইনটিন। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসেছে। ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ। এর শেষ কোথায়, কবে? তা নিয়ে এখনও নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। কোভিড নিয়ে এই ধারাবাহিক চর্চার মধ্যেই চাপা পড়ে গিয়েছে ম্যালেরিয়ার মত একটি প্রাণঘাতী রোগের নাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা পরিসংখ্যানে বোঝা যায় মশকবাহিত এই রোগের প্রভাব আজও কতটা ভয়াবহ। ২০২০। কোভিড সংক্রমণের বছরেই ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৪ কোটি ১০ লক্ষ। বিশ্বের মোট ৮৫ দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৬ লক্ষ ২৭ হাজার মানুষের। মৃতদের দুই-তৃতীয়াংশই ছিল শিশু। যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম।
ম্যালেরিয়া শব্দের অর্থকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় বায়ু-দূষণের কথা। অর্থাৎ এই রোগ সংক্রমণের শুরুতে মানবজাতির বিশ্বাস ছিল, বিষাক্ত বায়ু শ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ কর। আর সেই দূষিত বায়ু সেবনই ম্যালেরিয়া রোগের আঁতুরঘর। পরে সেই বিশ্বাস বদলায়। মশার কামড় থেকেই যে রোগের সৃষ্টি তা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়।
https://twitter.com/Indography_/status/1518529518406938624?s=20&t=YfVY3OP8fDH6g7LKcp3rgA
আরও পড়ুন – World Book Day 2022: বই-দিবসে পুরনো পাতার ভাঁজে অক্ষরের নস্টালজিক ঘ্রাণ
আঠারো শতকের একেবারে শেষের দিকে কথা। স্যর রোনাল্ড রস তখন দক্ষিণের সেকেন্দরাবাদ শহরে। গবেষণাগারে মশাদের রক্ত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর রক্ত। এ জন্য রস সাহেবকে গাঁটের কড়ি খরচা করতে হয়েছিল। হুসেন খান নামের এক রোগীর শরীর থেকে অর্থের বিনিময়ে ম্যালেরিয়ার রক্ত সংগ্রহ করেন তিনি। স্যর রস নিশ্চিত করে বোঝার চেষ্টা করেন মশাদের শরীরে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট জন্ম নেয় কিনা। রসের অনুমান ভুল হয়নি। দেখা গেল ম্যালেরিয়া রোগীর রক্ত খেয়ে মশার পাকস্থলীতে তৈরি হচ্ছে প্যারাসাইট।
স্যর রোনাল্ড রস
আরও পড়ুন- Poila Baisakh: বৈশাখে রচিত এক দুপুরে থেমে যাওয়া দেওয়াল ঘড়ি
পরের বছর কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে কাজ করতে এলেন স্যর রোনাল্ড রস। যে মেডিকেল কলেজ আজ ‘শেঠ সুখলাল কারনানি মেমোরিয়াল হাসপাতাল’ বা এসএসকেএম হসপিটাল নামে পরিচিত। রসের সাবজেক্ট এবার পাখি। ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট রয়েছে এ রকম মশা দংশন করল রসের পাখিকে। পাকস্থলীর প্যারাসাইট মশার লালাগ্রন্থী হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পাখির শরীরে। শুধু তাই নয় দেখা গেল ম্যালেরিয়া আক্রান্ত পাখির শরীর থেকে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে সুস্থ পাখির শরীরেও। যুগান্তকারী এই আবিষ্কার রোনাল্ড রসকে এনে দিল নোবেল সম্মান। কলকাতা শহরের প্রথম নোবেলও রসের হাত ধরে।
https://twitter.com/HeritageTimesIN/status/1518473402637463555?s=20&t=qUPOZzXH1H9eBTaGfgnZ-Q
কবিতা লিখতেন স্যর রোনাল্ড রস। স্ত্রীকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা আজও খোদিত আছে কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উলটো দিকের স্মৃতি-ফলকে। ম্যালেরিয়া নিয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কারের প্রায় ২৫ বছর পর কলকাতায় এসে ফলকটির উদ্ধোধন করেছিলেন স্যর রোনাল্ড রস স্বয়ং। বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসে সেই ফলকটির কথা বোধকরি ভুলেই গিয়েছেন কলকাতার মানুষ।