বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্তকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আই এন এ-র ইতিহাস কয়েক খণ্ডে লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সেই ইতিহাস তিনি যথাসময়ে লিখে ভারত সরকারের কাছে জমাও দেন। তার পর সেই পাণ্ডুলিপির যে কী হল, তা আর জানা যায় না। প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত তাঁর আত্মজীবনী ‘দিনগুলি মোর’-এ লিখেছেন সংসদে বহুবার এই নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে। তিনি জবাব না দিয়ে কার্যত বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন। সেই পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে জানতে একাধিক আরটিআই করা হয়েছে, সেও অনেক বছর হল। জবাব মেলেনি। সেখানে আইএনএ নিয়ে কোনও নতুন তথ্য আছে কি না আমরা জানি না। কিন্তু কেন এত গোপনীয়তা! সম্প্রতি নেতাজির ১২৫ বছর উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে সেই দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু বিজেপিও রহস্যজনক ভাবে বিষয়টি নিয়ে নীরব।
আই এন এ সেনাদের শেষ পর্যন্ত কী হল? আজ পর্যন্ত এই বিষয়ে বহু তথ্য জানা যায় না। আইএনএ সেনারা সংখ্যায় কত ছিলেন? ৩০ হাজার না ৪০ হাজার? নাকি তার চেয়েও বেশি! নেতাজি আইএনএ সেনাদের বলেছিলেন, আপনারা প্রথমে বিপ্লবী তার পরে সেনা। এই ভাবে এক প্রশিক্ষিত সেনাদলকে তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের সংগঠনে পরিণত করে্ছিলেন। বার্মা বা মিয়ানমারে যে সেনারা ধরা পড়েন তাঁদের রাখা হয়েছিল সেন্ট্রাল কারাগার, ইনসেন কারাগার এবং ওল্ড সেক্রেটারিয়েটে। শোনা যায় ইঙ্গ-আমেরিকান সেনারা তাদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিল। ১৯৪৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি, এই সময়ে তিনটি জাহাজে কয়েক হাজার আইএনএ সেনাকে দেশে ফেরানো হয়। প্রকৃত সংখ্যা কেউ জানে না। সংখ্যাটা ২০-২৫ হাজারও হতে পারে। এই সেনাদের আনা হয় যুদ্ধবন্দি হিসেবে। তাঁদের পাঠানো হয় তামিলনাড়ু, ব্যারাকপুর এবং পাকিস্তানের কোনও একটি জায়গায়। তার পর তাদের কী হল? এই দেশপ্রেমিক সেনাদের ইতিহাসও ভারতবাসীর অনেকটাই জানা নেই। আজ বা কাল, এই ইতিহাসও নতুন করে খুঁজে বের করার দাবি উঠবে। নেতাজির ১২৫ বছরে এই সব প্রশ্নই উঠুক বড় করে।
নেতাজির সঙ্গে আইএনএ সেনারা
জ্যোতি বসু প্রয়াণের এক যুগ
১৭ জানুয়ারি, ২০১০ প্রয়াত হয়েছিলেন জ্যোতি বসু। সেই প্রসঙ্গেই এই লেখা। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কনভয় পাঞ্জাবে কৃষক বিক্ষোভে আটকে পড়লে প্রধানমন্ত্রীকে নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের কর্মসূচি বাতিল করে ফিরে যেতে হয়। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী খুবই ভয় পেয়েছিলেন এই ঘটনায়। তাই তিনি পাঞ্জাব ছাড়ার আগে বলেন, বেঁচে ফিরতে পেরেছি…। বোঝাই যাচ্ছে প্রাণ সংশয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত তাঁর কথায়। এর পর দেখা গেল দেশ জুড়ে বিজেপি নেতারা কোথাও মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র আওড়াচ্ছেন, কোথাও যজ্ঞ হচ্ছে। এই প্রসঙ্গেই আমরা একবার ফিরে দেখতে পারি আরেক জননেতা, জ্যোতি বসুর উপর আক্রমণ এবং সেই ঘটনায় জ্যোতি বসুর প্রতিক্রিয়া।
দ্বিতীয় যুক্ত ফ্রন্ট সরকারের পতন হয়েছে। তারিখটা ১৯৭০-এর ২৯ মার্চ। তার ঠিক দু’দিন পরে ৩১ মার্চ পাটনায় দলের এক কর্মসূচিতে যোগ দিতে ট্রেনে পাটনা স্টেশনে পৌঁছলেন তৎকালীন প্রাক্তন উপ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। হাজার হাজার মানুষ এসেছেন স্টেশনে জ্যোতিবাবুকে অভ্যর্থনা জানাতে। হোটেলে নয়, দল ঠিক করে দিয়েছে জ্যোতি বসু থাকবেন দলের নেতা আলি ইমামের বাড়িতে। স্লোগান, চিৎকারের মধ্যে আলি ইমাম জ্যোতি বসুকে সঙ্গে নিয়ে পাটনা স্টেশনের বাইরে এসে সবে দাঁড়িয়েছেন, ঠিক দশ ফুট দূর থেকে জ্যোতি বসুকে লক্ষ্য করে রিভলভারের গুলি। প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাগল আলি ইমামের বুকে। পরের গুলি লাগল জ্যোতি বসুর হাতের আঙুলে। এর মধ্যে আততায়ী পালিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা গেলেন জীবনবীমা কর্মীদের আন্দোলনের নেতা আলি ইমাম। এর পর জ্যোতি বসু কলকাতায় ফিরে এসে বলেননি যে তিনি প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছেন! সব থেকে বড় কথা, যে কঠিন কাজটা তিনি এর পর করেছিলেন, সেটা হল তিনি ওই ঘটনার পরও সেই আলি ইমামের বাড়িতেই গিয়ে উঠেছিলেন। এবং কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। দুই নেতার মধ্যে কতটা দূরত্ব তা বোধহয় এর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়?
জ্যোতি বসু
অভিষেকের ভিন্ন মত-ই তৃণমূলের জিয়নকাঠি
তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারাই আড়ালে বলে থাকেন দলে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। নেত্রীকে আরও মহিমান্বিত করতেই এই ধরনের মন্তব্য। তিনি বলেন, বাকিরা শোনেন। মুখের উপর কথা বলার ক্ষমতা কারও নেই। শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি থেকে শুরু করে কোনও কমিটিরই সে অর্থে কোনও স্বাধীন মত নেই। ফলে আমরা জানতে পারি না রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বা সব্যসাচী দত্তরা দলে ফেরার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কী মত ছিল? হাতে গোনা দু’তিনটি বড় দল বাদ দিলে, ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এই ভাবে চলে। যাকে বলে ‘ওয়ান ম্যান অর্গানাইজেশন’। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের বৃদ্ধি হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস ভাবছে রাজ্যের বাইরে পা রাখার কথা। এই বৃদ্ধি যত হবে, ততই বাড়বে দলে ভিন্ন মতের প্রয়োজনীয়তা। তার শুরুটা সম্ভবত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন। তিনি চান ভোট, মেলা সব দু’মাস পিছিয়ে দেওয়া হোক, প্রকাশ্যে এই কথা বলে আপাত দৃষ্টিতে তিনি দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এর থেকে প্রমাণ হয় দলের ভিতরে এখনও ভিন্ন মত প্রকাশের এবং তা নিয়ে আলোচনার পরিসর তৈরি হয়নি। তাই ভিন্ন মত প্রকাশ করতে হচ্ছে ব্যক্তিগত মত বলে। কিন্তু দেখা গেল অভিষেকের কথায় আংশিক কাজ হল। বইমেলা এক মাস পিছিয়ে গেল। ভোটও পিছিয়ে গেল বেশ খানিকটা। এই ঘটনার একটাই শিক্ষা। সেটা হল, দলকে বাড়াতে হলে দলের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচন করতে হবে। প্রকৃত ক্ষমতা দিয়ে দলের নীতি নির্ধারক কমিটিকে (নাম তার যা-ই হোক) সক্রিয় করে তুলতে হবে। খুলে দিতে হবে ভিন্ন মত প্রকাশের বন্ধ দরজাগুলো।
‘প্রাইস অফ দ্য মোদী ইয়ারস
লেখক, সাংবাদিক, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারত-শাখার প্রধান আকার প্যাটেল ‘আওয়ার হিন্দু রাষ্ট্র’-এর পর তাঁর দ্বিতীয় বই প্রকাশ করলেন, ‘প্রাইস অফ দ্য মোদী ইয়ারস’। নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতি, টুইট, ভাষণ, শব্দ-চয়ন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গত সাত বছরে কী ভাবে আরএসএসের অ্যাজেন্ডাকে পূর্ণ করে চলেছে, তার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এই বই। যার মূল কথা, ২০১৪ পর্যন্ত যে সব কাজ সাম্প্রদায়িক বলে বিবেচিত হত, নরেন্দ্র মোদীর সাত বছরের শাসনে সেসব হয়ে গিয়েছে আইন-সঙ্গত। ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ এখন বহু মানুষের চোখেই একটা বেঠিক ধারণা। আকার প্যাটেল নরেন্দ্র মোদীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তিনি আত্ম-সচেতন, অবস্থানে দৃঢ়, স্বচ্ছ, আধুনিকতা বিষয়ে অজ্ঞ, পরিশ্রমী এবং বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি রক্ষণশীল নন, র্যাডিক্যাল, রীতিতে বিশ্বাস করেন না বরং ধারাবাহিকতা ভাঙতে পছন্দ করেন, এবং তিনি একজন ‘ডিসরাপটর’, অর্থাৎ বিঘ্নকারী। তাঁর মতে, গত সাত বছরে বিজেপি সরকার কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন রাজ্যে যে সব আইন এনেছে তার বড় অংশই কোনও না কোনও ভাবে সংখ্যালঘু বিরোধী। এর ফলে ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষ এবং বহুত্ববাদী সাংবিধানিক অবস্থান থেকে আইনসঙ্গত ভাবেই অনেকটা সরে গিয়েছে।
আরও পড়ুন- শাসক নির্লজ্জ, ভেঙে ফেলা হল লজ্জার স্মারক
২০১৫ সালে প্রথমে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানায় তার পর একে একে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে গোরুর মাংস রাখা নিষিদ্ধ করে আইন আনা হল। আকার প্যাটেল নথিবদ্ধ করেছেন গোরুর মাংস রাখার অভিযোগ এনে সারা দেশে মুসলিমরা যে ভাবে আক্রান্ত (লিঞ্চিং) হয়েছেন তার বিস্তারিত তথ্য। তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৯, পাঁচ বছরে দেশ জুড়ে ৮৩টি লিঞ্চিংয়ের ঘটনার উল্লেখ করেছেন। এমনই আরেকটি আইন ‘গুজরাট প্রহিবিশন অফ ট্র্যান্সফার অফ ইমমুভেবল প্রপার্টি অ্যান্ড প্রহিবিশন ফর প্রোটেকশন অফ টেনান্টস ফ্রম এভিকশন ফ্রম প্রেমাইসেস ইন ডিস্টার্বড এরিয়াস অ্যাক্ট, ২০১৯’। এই আইনে গুজরাটে মুসলিমদের পছন্দ মতো জায়গায় জমি কেনা বা বাস করা প্রায় অসম্ভব। গুজরাটেই বিভিন্ন পুরসভায় আইন আনা হয়েছে রাস্তার ধারে আমিষ বিক্রি নিষিদ্ধ করে। এই আইনেরও মূল লক্ষ্য সংখ্যালঘুরা। একই ভাবে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এসেছে ‘লাভ-জিহাদ’ আইন। তারও আগে পাস হয়েছে সিএএ। আকার প্যাটেলের মতে এসবই হল সংখ্যালঘুদের সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করার সচেতন রাজনৈতিক প্রয়াস।