কলকাতার শব্দ নিয়ে কথা চলছে বহুদিন ধরে। তবে বলার মতো সুরাহা কিছু হয়নি। শব্দে বাধা দিয়ে দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হয়েছেন, এমন ঘটনাও বেশ কয়েকটা ঘটেছে এই রাজ্যে। রাজনৈতিক দলগুলো তাঁদের শব্দ-শহিদ নামে মনে কিছুটা রেখেছে হয়তো, কিন্তু শব্দ নিয়ে কলকাতার মানসিকতা খুব একটা পাল্টায়নি। সম্প্রতি, শব্দদূষণ সংক্রান্ত একটি মামলায় জাতীয় পরিবেশ আদালতের বিচারপতি রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন, এই শহরে এত হর্নের আওয়াজ কেন? কলকাতায় হর্নের শব্দ বেশি তো বটেই, এমনকি সাইলেন্স জোনেও , স্কুল, হাসপাতালের সামনেও, অনেক সময়ই ইচ্ছে মতো হর্ন বাজান চালকরা। দু’মাসের মধ্যে সরকারকে এই রিপোর্ট আদালতে পেশ করতে হবে। প্রস্তাব এসেছে মাইকের মতো হর্নেও ‘লিমিটর’ লাগানোর। এর ফলে ভবিষত্যে কলকাতায় কতটা শব্দ কমে তা সময়ই বলবে। তবে এই সুযোগে ভারতেরই একটি ছোট শহরের কথা বলি, যেখানে হর্ন বাজে না।
মিজোরাম ঘুরতে গিয়ে আইজল-এ ছিলাম। তখনই মনে হল, শব্দ নিয়ে মিজোদের থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। আইজল মিজোরামের রাজধানী, ছোট্ট শহর। মিজো ভাষায় ‘রাম’ মানে জমি। মিজোদের জমিই হল ‘মিজোরাম’। পেংলুই বিমানবন্দরে নেমে ঝরনা, নদী পেরিয়ে আইজল শহরে গাড়িতে প্রায় এক ঘণ্টা। শহরে গাড়ির সখ্যা তুলনায় বেশ বেশি। প্রাইভেট গাড়ি, স্কুলবাস, অসংখ্য ট্যাক্সি, গণপরিবহণের বাস, ছোট মালবাহী ভ্যান, হাজারে হাজারে স্কুটার সারাক্ষণ ছুটছে রাস্তায়। পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তা অনেক সময়ই দুই লেনের নয়। এক লেনের। দু’দিক দিয়েই গাড়ি আসছে যাচ্ছে। মাঝখানে সাদা রঙের দাগ দিয়ে কোনও নির্দেশও নেই। কিন্তু বিভিন্ন রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম, আইজল শহরে কোনও গাড়ি হর্ন দেয় না। ট্রাফিক পুলিশও প্রায় চোখে পড়ে না। কিন্তু কোনও গাড়ি অন্য গাড়িকে ওভারটেকও করে না। জ্যাম হয়। ভালোই হয়। কিন্তু হর্নের আওয়াজ নেই। রাস্তার ধারে দাঁড়ালে, দু’দিকের গাড়ি থেমে যাবে। আগে পথচারী যাবেন। তার পর গাড়ি। যদি কোনও বাইরে থেকে আসা গাড়ি না জেনে হর্ন বাজিয়ে ফেলে, সবাই সেই চালকের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, ভাব খানা এই, সবাই মিলেই তো যাচ্ছি বাছা, অযথা হট্টগোল কেন? অথচ কলকাতায় আমরা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরোলেই বিনা কারণে হর্ন বাজাতে থাকি। কলকাতা পুলিশ নিঃশব্দ এলাকায় হর্ন বাজানোর জন্য নিয়মিত জরিমানা জারি করে। বছরে লক্ষের উপর মামলা হয়। কিন্তু অবস্থা বলায় না।
যাই হোক, ফের আইজলে ফেরা যাক। গোটা শহরটাকে দেখলে মনে হতে পারে মহিলাদের শহর। বড় বড় ব্র্যান্ডের শোরুম চালাচ্ছেন মিজো মেয়েরা। পানের দোকানও চালাচ্ছেন মহিলারা। রেস্টুরেন্টেও তাদেরই দাপট। বড়া বাজারে মতো বিরাট বাজারে গিয়ে দেখলাম, হকারিও মেয়েদের দখলে। এবং সবাই খুব সাজ-গোজ করে কাজটা করছেন। আইজল শহরে ঘুরলে পুলিশের দেখা মেলা ভার। স্থানীয় এক যুবককে এই বিষয়ে প্রশ্ন করতে তিনি হেসে বললেন, পুলিশ দিয়ে কী হবে? প্রায় কখনই কোনও গোলমাল হয় না। আর যদি গাড়ির সঙ্গে গাড়ির ধাক্কা-টাক্কা লাগে, নিজেরা আলোচনা করে যার দোষ সে টাকা দিয়ে দেয় যার ক্ষতি হয়েছে তাকে। অবাক হয়ে গেলাম, যখন দেখলাম, আইজল শহরে কোনও সিনেমা হল নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কয়েক জন ব্যবসায়ী সিনেমা হল খুলেছিলেন, কিন্তু চলেনি। কেউ দেখতে আসে না। তাই বলে কি সিনেমা দেখেন না মিজোরা? তা কিন্তু নয়, বাড়িতে টিভিতে দেখেন। মিজো ভাষায় ৮-৯টি চ্যানেল আছে সেখানে সারাদিনই সিনেমা চলছে। মিজো সিনেমা আছে। তবে বেশি চলে মিজো ভাষায় ডাব করা হিন্দি সিনেমা। চলে মিজোতে ডাব করা কোরিয়ান ছবিও। হিন্দি এখানে মোটে চলে না। লোকজন হিন্দি বুঝতেও পারেন না। হয় মিজো নয়তো ইংরেজি। ভাঙা, গোটা, আধা-ভাঙা ইংরেজি মোটামুটি শহরের সবাই বলতে পারেন।
আইজল থেকে একটু বেরোলেই চোখে পড়বে ছবির মতো সব গ্রাম। বড় রাস্তার ধারে চোখে পড়বে কোথাও ফলের দোকান, কোথাও সবজির দোকান, কিন্তু দোকানি নেই। দাম লেখা আছে কাগজের চিরকুটে, লোকজন জিনিস নিয়ে পাশে রাখা বাক্সে টাকা রেখে চলে যাচ্ছেন। কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। কেউ-ই কম টাকা দিয়ে জিনিস নিয়ে চলে যাচ্ছেন না। আমিও ৩০টাকা বাক্সে ফেলে একটা আনারস নিলাম। আমার চালক ৬০টাকা দিয়ে দুটি। আমি মনে মনে গুণতে শুরু করলাম, কী কী আমরা শিখতে পারি মিজোদের থেকে।