কিশোর কুমারের শেষযাত্রা। লরির উপর ঠায় দাঁড়িয়ে রাজ বব্বর, সুরেশ ওবেরয় ও আরও একজন। তিনি সম্পর্কে কিশোর কুমারের ভাগ্নে। বাপ্পি লাহিড়ি। সকলে যখন ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’ বলছেন, তখন তার মধ্যেই একজনের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে ‘বলো হরি..হরি বোল।’ তিনিও বাপ্পি লাহিড়ি।
কিশোরের মৃত্যুর পর সঙ্গীতে সুর বসানোর কাজ ছেড়ে দেবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কিশোরদাকে আমি কিশোর মামা বলে ডাকতাম। ওনার সঙ্গে অনেক ছবিতে কাজ করেছি। কিন্তু, ওনার মৃত্যুর পর মনে হয়েছিল, সুর পরিচালনার কাজ আমার ছেড়ে দেওয়া উচিত। ১৯৮৭-তে কিশোরদা চলে যাওয়ার পর কাজে একেবারেই মন লাগত না। তখন বাবা আমার বললেন, কিশোরদার আশীর্বাদ সবসময় তোমার সঙ্গে রয়েছে। তুমি কাজ ছেড় না। তখন ১৯৯১ সালে সাব্বির কুমার আমার সুরে ‘গোরি হ্যায় কলাইয়াঁ’ গানটি গাইলেন ও সেটা সুপারহিট হল।
বাবা অপরেশ লাহিড়ি ও মা বাঁশরী ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী। মাত্র ৩ বছর বয়সে তবলায় হাতেখড়ি বাপ্পির। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য বেশ কয়েকটি বাজনা বাজাতে পারতেন জলপাইগুড়ির এই ভূমিপুত্র। প্রায় ২ দশক মুম্বই দাপিয়েছেন। সলিল চৌধুরী, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, আর ডি বর্মন যখন জুহুর তীরে রাজ করছেন, তখন ১৩ বছরের একটা ছেলে হুশ করে এসে জুটল ভারতীয় সুরের জগতে। তার পর খেকে ৪৮ বছরের শিল্পী জীবনে ৫০০ ছবিতে ৫ হাজার গানে সুর দিয়েছেন বাপ্পি। বাংলা ও হিন্দি ছাড়াও সুর দিয়েছেন ভারতের প্রায় সব ভাষার গানে। বাংলাদেশেরও বেশ কয়েকটি গানে সুর বসিয়েছেন। বাদ যায়নি ইংরেজি ভাষার গানও।
সোনার মানুষ বাপ্পি
বাপ্পি লাহিড়ি নামটা মনে এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতি উজ্জ্বল পোশাক পরা, চোখে রোদ চশমা ও চওড়া বুকের উপর ঝুলে থাকে অসংখ্য সোনার হার, লকেট ও মালা। হাতের আঙুল, কবজি সর্বত্র সোনার অলঙ্কার। ২০১৪ সালে বিজেপির টিকিটে শ্রীরামপুর থেকে ভোটে দাঁড়ানোর সময় বিরোধী দল থেকে কটাক্ষ করে বলা হয়েছিল, গয়না বাপি। কিন্তু, কেন এত গয়না! এর পিছনে রয়েছে করুণ এক কাহিনি।
আরও পড়ুন- Bappi Lahiri: আরও এক রত্নকে হারালাম, বাপ্পি লাহিড়ির মৃত্যুতে
প্রখ্যাত মার্কিন রকস্টার এলভিস প্রেসলির ভক্ত ছিলেন বাপ্পি। এক সাক্ষাৎকারে বাপ্পি বলেছিলেন, মঞ্চে গান গাওয়ার সময় এলভিস সোনার চেন পরতেন। মুম্বইয়ে যখন প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ লড়াই চালাচ্ছিলেন, তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেলেন যে, কোনওদিন খ্যাতি জুটলে তিনিও প্রেসলির মতো সোনার চেন পরবেন। আর হলও তাই। খ্যাতির শিখরে একটু একটু করে যত উঠেছেন, সোনার ভারও ততই বাড়িয়েছেন। একসময় তাঁকে ‘গোল্ডম্যান’ বলেও ডাকত অনেকে। বাপ্পি মনে করতেন, সোনা তাঁর ভাগ্যের প্রতীক।
আরও পড়ুন- Russia-Ukraine: সেনা প্রত্যাহার রাশিয়ার, যুদ্ধের মেঘ কাটল
কত সোনার মালিক বাপ্পি?
২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের হলফনামায় তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছে ৭৫২ গ্রাম সোনা, ৪.৬২ কেজি রুপো আছে। কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের খবর, প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক ছিলেন তিনি। শুধু বাপ্পিই নন, তাঁর স্ত্রী চিত্রাণী লাহিড়িরও সোনা ও হিরের শখ ছিল। হলফনামায় বলা ছিল, তাঁর স্ত্রীর ৯৬৭ গ্রাম সোনা, ৮.৯ কেজি রুপো ও ৪ লক্ষ টাকার হিরে রয়েছে।
আরও পড়ুন- Bappi Lahiri: বাপ্পি লাহিড়ির প্রয়াণে মর্মাহত মমতা, টুইটে শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
জীবনে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সুরের জগতের মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন বাপ্পি। ভোটের সময় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘বাপ্পি বাড়ি যা’। আজ সত্যিই বাড়ি চলে গিয়েছেন তিনি, যে বাড়ি থেকে আর কোনওদিন ফেরার পথ নেই। শুধু মাঝ আকাশে ঘুরেউড়ে বেড়াচ্ছে তাঁর সেই সুর, ‘ইয়াদ আ রহা হ্যায়…হুয়ে তুম কঁহা গুম।’