যদি জানতে চাওয়া হয় নারায়ণ দেবনাথের বয়স কত? উত্তরটা সবারই জানা। কিন্তু যদি বলা হয় হাঁদা-ভোঁদার বয়স কত! অনেকেই মুখ চাওয়াচায়ি করবেন। হ্যাঁ, ৬০ বছর বয়সি চিরকিশোর হাঁদা-ভোঁদার জন্ম ১৯৬২ সালে।
১৯৫০ সালের ঘটনা। পারিবারিক সোনার ব্যবসা ছিল তাঁদের। তাতে মন বসাতে না পেরে ভর্তি হন আর্ট কলেজে। পড়ার শেষ বছরে তাতেও মন টেকেনি। নেমে পড়লেন বিভিন্ন বিজ্ঞাপন এজেন্সি, সিনেমার পোস্টার, লোগো তৈরির কাজে। বিভিন্ন সূত্রে পরিচিত হলেন দেব সাহিত্য কুটিরের সঙ্গে। এক বিরাট জমিদারির মালিক বরদাপ্রসাদ মজুমদার বিভিন্ন নেশায় জমিদারি খোয়ান। তারপর নতুন জীবন শুরু করেন। তাঁর এক ছেলে এই প্রকাশনা সংস্থার পুনর্জন্ম দেন।
নারায়ণ দেবনাথ এই সংস্থায় বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসের ছবি আঁকতেন। হঠাৎই ১৯৬২ সালে তাঁর রেখায় জন্ম নিল দুই প্রবাদপ্রতিম চরিত্র হাঁদা ও ভোঁদা। কমিক চরিত্র দুটির নামও প্রকাশনা সংস্থারই দেওয়া। শুকতারা তখন শিশু ও কিশোর পত্রিকার ধ্রুবতারাই বলা চলে। আবির্ভাবেই বঙ্গ সমাজে মন জিতে নেয় হাঁদা-ভোঁদা। জীবনের মোড়ও ঘুরে যায় নারায়ণ দেবনাথের। শুকতারার প্রতি সংখ্যায় ছাপা হতে থাকে হাঁদা-ভোঁদা।
একদিন কলেজ স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে আসছিলেন। তখন হঠাৎই বাঁটুলের কল্পনা করেন। সেই মুহূর্তেই কল্পিত বাঁটুলের ছবিও এঁকে ফেলেন নারায়ণ। বাংলা কমিক সাহিত্যে ১৯৬৫ সালে জন্ম নিল “বাঁটুল দি গ্রেট।“ অর্থাৎ বুকের উপর অনায়াসে রোড রোলার চলে যাওয়া বাঁটুলের বয়স এখন ৫৭ বছর।
সেই আমলে কিশোর ভারতী গোষ্ঠী তাঁকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করে। সেখানে তিনি শুরু করেন ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়।‘ এটি মূলত একটি গোয়েন্দা গল্প। এরপর রেখায়-লেখায় সৃষ্টি করেন ‘ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ।‘ কিন্তু তারা কেউই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। কিশোর ভারতী গোষ্ঠী চাইছিল হাঁদা-ভোঁদা ও বাঁটুলকে টেক্কা দিতে অন্য কমিক চরিত্র। নারায়ণবাবু তাদের জন্য সৃষ্টি করলেন নন্টে-ফন্টেকে। ১৯৬৯-এ ছবিতে জন্ম হল দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধুর। এখন নন্টে-ফন্টের বয়স গিয়ে দাঁড়াল ৫২।
তারপরেও ’৭৬ সালে শুকতারায় গোয়েন্দা কৌশিক, ’৮৩-তে বাহাদুর বেড়াল। ওই বছরই অন্য একটি পত্রিকায় ডানপিটে খাদু আর তার কেমিক্যাল দাদুর প্রকাশ। এছাড়াও তিনি “টারজানের” বহু গল্পের কার্টুন এঁকেছেন।
নারায়ণবাবুর কমিকস এক অনন্য সাহিত্যকীর্তি। বাংলা ভাষায় লেখক বলে মৃত্যু পর্যন্ত সঠিক মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত থেকে গেলেন নারায়ণ দেবনাথ। হাঁদা-ভোঁদার চেয়ে টিনটিনের আন্তর্জাতিক খ্যাতি থাকলেও নারায়ণ দেবনাথের কমিকস কোনও অংশে কম নয়। বাংলা ভাষায় এক অদ্ভুত সারল্য এনেছ্লেন তিনি। সহজসরল সংলাপে দ্রুতগামী ছিল তাঁর কাহিনী। হাসির সৃষ্টিতে তাঁর অনবদ্য ক্ষমতা ছিল। সংলাপে কৌতুক বাড়াতে সাধু বাংলা, সংস্কৃত ও তৎসম শব্দ ব্যবহার করতেন।
কমিকসকে তিনি মধ্যবিত্তের হেঁসেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন। শুধু ছোটরাই নয়, বড়রাও সমান তালে নির্মল আনন্দ পেয়েছেন তাঁর কমিকসে। কিশোর মনের আঁতিপাঁতির খোঁজ রাখতেন তিনি। কিশোর বয়সের দুষ্টুমি, ভালো লাগা, মন্দ লাগার অতলে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। প্রাচীন ও সবেমাত্র আধুনিকতার বাতাস লাগা প্রজন্মের বিরোধ, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ তাঁর রেখায় জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। জীবনে অনেক সম্মান, খ্যাতি, পুরস্কার পেলেও সবটাই বঙ্গের সীমানার মধ্যে থেকে গিয়েছে। আজ পৃথিবীর মানচিত্রের বাইরে মিলিয়ে যাওয়া তাঁর ছবির রেখায় জোটেনি কোনও আন্তর্জাতিক সম্মান। আমরা তাঁর লেখা পড়ে মজা পেয়েছি। তিনি সকলকে অনাবিল আনন্দ দিতে দিতেই চলে গেলেন। পড়ে রইল তাঁর সৃষ্টি করা চরিত্ররা। যাদের কোনওদিন বয়স হবে না।