কলকাতায় শুরু হল বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই অনুষ্ঠানে আসবেন, অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এলেন না। গত নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলেন। অর্থাৎ প্রায় ছ’মাস আগে। ছ’মাস আগে আমন্ত্রণ পেয়ে না-আসার জন্য জন্য কোনও যুক্তি দেওয়া কঠিন। যদি না অতি জরুরি কোনও ঘটনা ঘটে থাকে। ঘটনা হল, তেমন কিছু ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রী আসবে না বলেই আসেননি। সম্ভবত এটা তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিজেপির নেতা হিসেবে নয়। কিন্তু তাঁর না-আসার কারণ যদি রাজনৈতিক হয় (যার সম্ভাবনাই বেশি) তা হলে বলতেই হয়, তাঁর এই সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর মতো নয়, বিজেপি নেতার মতো। তাতে কোনও দোষ নেই। কিন্তু গণতন্ত্র আরেকটু উদারতা আশা করে। অন্তত প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে।
প্রধানমন্ত্রী না আসায় রাজ্য বিজেপির নেতারা খুশি, তা তাঁদের বক্তব্যে স্পষ্ট। না মেনে উপায় নেই, এই যে প্রধানমন্ত্রী এলেন না, এতে রাজ্যের ক্ষতি। প্রধানমন্ত্রী এলে বিনিয়োগকারীদের প্রতি একটা বার্তা যায়।সেটা জরুরি। মমতার সরকারকেও ভাবতে হবে কঠোর রাজনৈতিক বিরোধিতা বজায় রেখেও কী ভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরেকটু উন্নত করা যায়। সিপিএমও গোড়ার দিকে কেন্দ্রের সঙ্গে এই রকম যুদ্ধ চালিয়েছিল। লাভ কিছু হয়নি। পরে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছিল। ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের সঙ্গে আদবানীর সুসম্পর্ক তো সাংবাদিক মহলে রীতিমতো আলোচনার বিষয় ছিল। তৃণমূলের রাজনীতিতে কৌশলের উপাদান বাড়াতে হবে। ভেবে দেখতে হবে কী করে বিজেপি আর নির্বাচিত কেন্দ্রীয় সরকারকে কিছুটা আলাদা করে দেখা যায়। নবীন পট্টনায়ক এই কাজটা বেশ দক্ষতার সঙ্গে করে চলেছেন। কাজটা খুবই কঠিন কারণ, বিজেপির সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি মোটেই এলইডি বাল্বের আলো নয়, তা হ্যারিকেনের আলোর মতোই টিমটিমে।
মমতা-মোদি
বিজেপি প্রসঙ্গে আলোচনায় যে কথাটা এসেই যায়, সেটা হল সদ্য হয়ে যাওয়া উপনির্বাচনে বিজেপির ফল এবং পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভবিষ্যৎ। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের পর তিন দফা উপনির্বাচন হল রাজ্যে। বিজেপির ভোট কিন্তু দেখা যাচ্ছে কমতে কমতে তলানিতে নেমে এসেছে। বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে জমানত জব্দও হয়েছে। দু’বারের জেতা আসন আসানসোলে প্রায় তিন লক্ষ ভোটে হেরে এখন দ্বিতীয় স্থানে। বালিগঞ্জে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। বালিগঞ্জে সংখ্যালঘু ভোটাররা ভোট দেননি তাই এই ফল, বলছেন বিজেপি নেতারা। কথাটা আংশিক সত্যি। কারণ অন্য উপনির্বানের বেশির ভাগ কেন্দ্রেই বিজেপি এই রকম বা এর কাছাকাছি খারাপ ফল করেছে। আসলে বিজেপি-ফেরতা বাবুল প্রার্থী হওয়ায় সংখ্যালঘুদের অনেকে ভোট দিতেই বেরোননি। ৪১ শতাংশ ভোটা পড়ার সেটা অন্যতম কারণ। তাঁদের আনেকে সিপিএমকে ভোট দিয়েছেন।
আরও পড়ুন- CBI Investigation: কেন্দ্রে নিরপেক্ষ সিবিআই, রাজ্যে নিরপেক্ষ পুলিশ, কেউ কি চায়?
সিপিএম প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে অবশেষে ঘুরে দাঁড়ানো গেল বলে তাঁদের কেউ কেউ মনে করছেন। যদিও আসানসোলের ছবিটা দেখলে আর সে কথা মনে হয় না। বালিগঞ্জ এবং আসানসোলের ভোটের এই প্যাটার্নে একটা ইঙ্গিত আছে। ২০-২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে ভবিষ্যতে যদি সিপিএম এবং বিজেপি থেকে যায়, তাহলে বিরোধী ভোট ভাগের সব সুযোগটাই পাবে জোড়াফুল। তবে দু’টো কেন্দ্রের ভোট দেখে এখনি সেকথা বলার সময় হয়নি। আরেকটা সম্ভাবনা হল বিজেপির আরও তলানিতে চলে যাওয়া এবং সিপিএমে দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উত্থান। বঙ্গ রাজনীতি কোন পথে হাঁটবে তা অবশ্য ২০২৪-এর আগে বোঝা যাবে না। এটাও ঠিক, এই মুহূর্তে বিজেপি যেখানে দাঁড়িয়ে, তাতে বলাই যায়, ২০২৪-এ এই রাজ্যে বিজেপি তাদের ২০১৯-এর সাফল্যের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারবে না।
একটা নতুন ঝোঁক উত্তর প্রদেশের ভোটেও দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গের এই উপনির্বাচনের ভোটেও দেখা গেল। সেটা হল স্থানীয় ঘটনা নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে না। উত্তরপ্রদেশে যেমন যোগীর জমানায় ঘটা লখিমপুর খেড়ি, উন্নাও, হাথরসের মতো ভয়ঙ্ক ঘটনার কোনও প্রভাব ভোটে পড়ল না। লখিমপুর খেড়ি, উন্নাও, হাথরস, তিন কেন্দ্রেই বিজেপি বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছে। তেমনই পশ্চিমবঙ্গের এই দুই কেন্দ্রের উপনির্বানেও বগটুই গণহত্যা বা পর পর ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ভয়ঙ্কর নারী নির্যাতনের ঘটনার কোনওই প্রভাব পড়েনি। কেন এরকম হয়? এর একটা কারণ সম্ভবত সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজ। যে মানুষ সরকারের উপর খুশি, সে বা তারা কয়েকটি খারাপ ঘটনার জন্য সরকারকে ছাড়তে রাজি নয়। মানসিকতায় একটা প্রতিদানের ব্যাপার হয়তো তৈরি হয়। ভোটারদের নীতিবোধকে হয়তো কিছুটা ভোঁতা করে দেয়। অনেকটা নুন খেয়ে গুণ গাওয়ার ব্যাপার। যে সুবিধা যোগী এবং মমতা , দুই মেরুর রাজনীতিক হয়েও, দু’জনেই পেয়েছেন।
শেষ