পশ্চিমবঙ্গের একটি অতি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল, বাম ফ্রন্টের শরিক, ফরওয়ার্ড ব্লক টানা প্রায় সাত দশক বাঘ আর কাস্তে-হাতুড়ির সঙ্গে ঘর করছে। তাদের লাল পতাকায় বাঘ আর কাস্তে-হাতুড়ির সহাবস্থান। লেনিনের সোভিয়েত রাশিয়ার পতাকা থেকে কাস্তে-হাতুড়ি বিদায় নিয়েছে ৩১ বছর হল। অবশেষে ফরওয়ার্ড ব্লক-ও বেশ কিছু বৈঠকে চুল-চেড়া বিশ্লেষণের পর এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, শুধু বাঘ-ই বা কম কিসে! কাস্তে-হাতুড়ির দরকারটা কী! বাঘ একাই একশো। বাঘের পাশে ঘোগের মতো তাদের দলের পতাকায় যে কাস্তে-হাতুড়ির ছবি এদ্দিন আঁকা হত, তার আর দরকার নেই। টকটকে লাল পতাকা, তাতে লেজ তুলে লাফানোর ভঙ্গীমায় একটা রোগা মতো ডোরাকাটা, পাশে জরাজরি করে কাস্তে-হাতুড়ি, সেটাই ফব-র দলের পতাকা ছিল। ফব মানে ফরওয়ার্ড ব্লক। দেবব্রত যেমন দেবু, অনুব্রত যেমন অনু, তেমনই ফরওয়ার্ডব্লকের ডাক নাম ফব। ফব-র নতুন পতাকায় কাস্তে-হাতুড়ি ভ্যানিশ। ফব-র এই ব্যাঘ্র-প্রকল্প নিয়ে বড় কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও প্রতিক্রিয়া অবশ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
একটা কথা মেনে নেওয়া ভালো যে, ফব একটি অতি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল। পশ্চিমবঙ্গর রাজনীতিতে যার কোনও প্রভাব, একদা কিছু থাকলেও, আজ আর নেই। বিধানসভায় একটি আসনও তাদের নেই। প্রাপ্ত ভোট প্রায় শূন্যের-ই কাছাকাছি। তাহলে কি ফব-র মতো দলগুলি উঠে যাবে? কী ভূমিকা তারা পালন করছে রাজ্যের রাজনীতিতে? ফব কি তাহলে মিশে যাবে তারই মতো আন্য কয়েকটি অণু-দলের সঙ্গে? এর উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে ইঁদুড় কি কখনও ছুঁচোর সঙ্গে মিশে যায়! চামচিকে কি কখনও বাদুড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে! প্রকৃতিতে ছোট-বড় সবাই একেকটা কেউ-কেটা হয়ে যে যার জায়গায় রাজত্ব করে। এমনটাই নিয়ম। ফলে বিজেপি, কংগ্রেসের মতো বটগাছের পাশে নয়নতারা হয়ে বা নিদেন পক্ষে ঘেঁটুগাছ হয়ে ফব-ও থেকে যাবে, মানে, থেকে যেতে পারে। প্রকৃতিতে এমন নজির বহু। ফব-র সেটাই এখন বড় ভরসা।
১০০ জনেরমধ্যে ৮৭ জন যখন লিখতে পড়তে পারেন না, দারিদ্রের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকা প্রায় ২০ কোটি জনতাকে নিয়ে আমরা ভারতে সবার জন্য গণতন্ত্রে প্রবেশ করেছিলাম, সেটা ১৯৪৭। পৃথিবীতে এই ধরনের বিপ্লবের দ্বিতীয় কোনও দ্বিতিয় দৃষ্টান্ত নেই। নারী-পুরুষ, জমিদার এবং ভূমিহীন মজুর, সবার জন্য একটা ভোট, সরকার তৈরি হবে সকলের ভোটে, এই জায়গাটায় পৌঁছতে ইয়োরোপ, আমেরিকাকে বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যেহেতু মাত্র ১৩ শতাংশ সাক্ষর, ফলে তখন প্রতীকের দরকার হয়েছিল। পতাকার দরকার হয়েছিল রাজনৈতিক দলের। দেশের জন্য একটা পতাকা দরকার হয়। কারণ জাতীয়তাবাদ দেশের মূল প্রাণশক্তি। কিন্তু যেদিন সবার হাতে কাজ থাকবে, খাদ্য, বাসস্থান থাকবে. সভ্য ভাবে বাঁচার মতো জীবন থাকবে, সেদিন কিন্তু দলীয় পতাকা, বিদায় হয়তো নেবে না, কিন্তু অনেকটাই মূল্যহীন হয়ে পড়বে। অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়বে। কারণ পতাকা মানেই বিভাজন। পতাকা মানেই আমরা-ওরা। পতাকা মানেই দখল। পতাকা মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
শুধু বাঘ রয়েছে পতাকায়
আরও পড়ুন- CBI Investigation: কেন্দ্রে নিরপেক্ষ সিবিআই, রাজ্যে নিরপেক্ষ পুলিশ, কেউ কি চায়?
ভারতে, নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে ৮টি জাতীয় পার্টি, ৫৪টি রাজ্য-দল এবং সব মিলিয়ে মোট ২৮৫৮টি রাজনৈতিক দল আছে। তাদের আলাদা আলাদা নাম যেমন আছে, অত গুলো পতাকাও নিশ্চয়ই আছে। এরকম দিন কখনও আসতে পারে সুদূর ভবিষ্যতে, যখন রাজনৈতিক দলের পরিচয় হবে শুধু নামে। পতাকা, প্রতীকের দরকার হবে না। তখন পতাকার ইতিহাস জানতে হলে জাদুঘরে যেতে হবে। তবে একটা কথা এইখানে বলে রাখা ভালো। সব পতাকা যদি একদিন জাদুঘরে চলেও যায়, কালো পতাকা কিন্তু থাকবে। সব থেকে গণতান্ত্রিক এই একটি মাত্র পতাকা সকলের এবং চিরকালের। আমাদের প্রতিবাদের ভাষা এই কালো পতাকা। কালো পতাকা মৃত্যুহীন।
রং যতই কালো হোক, ভবিষ্যৎ তার মোটেই অন্ধকার নয়।