একটাই কথা, বাজি পোড়ানো বন্ধ হোক। তা সে শব্দ হোক কিংবা আলোর বাজি। অনেকেই দাবি তুলেছেন, বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ করুক সরকার। কিন্তু, এটা সরকারের একার কাজ নয়। আমরা যদি আমাদের উত্তরসূরিদের ফুসফুস থেকে বাতাস কেড়ে নিতে চাই, তাহলে আসুন সমোৎসাহে বাজি পোড়াই। বাতাসে মিশিয়ে দিই বিষাক্ত ধোঁয়া ও ক্ষতিকর ধাতুকণা। তাই সরকারি নিষেধাজ্ঞা নয়, সকলে মিলে শপথ নিন, দাবি তুলুন— দীপাবলির আলো জ্বলে উঠুক মুক্তমনে, শুদ্ধ চিত্তে। ভাস্বর হোক জ্ঞান, শিক্ষার জ্যোতি। তবেই পরিবেশের আঁধার কাটবে।
কেন দীপাবলি?
রামায়ণ অনুসারে লঙ্কাজয়ের পর রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের অযোধ্যায় ফিরে আসা উপলক্ষ্যে গোটা রাজ্য দীপমালায় সেজে উঠেছিল। দক্ষিণ ভারতে এটা উদযাপন করা হয়, কৃষ্ণের নরকাসুর বধ উপলক্ষ্যে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও দীপাবলি পালিত হয়। হিন্দু নববর্ষ অথবা লক্ষ্মীপুজো ও কালীপুজো হয় এই দিনেই। মূলত অশুভ শক্তির বিনাশ ও অন্ধকার (মনের, অশিক্ষার) দূর করে আলোর (জ্ঞান, বুদ্ধি, মুক্তি) উদগীরণের উৎসব দীপাবলি। স্কন্দ পুরাণ ও পদ্ম পুরাণেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন প্রস্তর ও তাম্রলিপিতেও দীপাবলির নাম রয়েছে। রাজা হর্ষ, শূণ্ড থেকে বিজয়নগর (হায়দরাবাদ), এমনকী আকবরের আমলে দিল্লিসহ গোটা দেশে দিওয়ালি পালিত হতো। আকবর নিজেও অংশ নিতেন উৎসবে। আল বারুনির লেখায় ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলার বর্ণনা রয়েছে। যদিও ঔরঙ্গজেব সরকারিভাবে দিওয়ালি ও হোলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু, কবে থেকে আলোর উৎসব এভাবে শব্দদানবের মোচ্ছবে পরিণত হয়েছিল, তা জানা না গেলেও রাজস্থান ও গুজরাতের প্রাচীন বিবাহ অনুষ্ঠানে ঘটা করে বাজির রোশনাই ছিল চমকপ্রদ।
বাজির জন্ম
করোনার মতো বাজির জন্মও চীনে। প্রথম দিকে বাঁশের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে তার চড়চড় শব্দ শুনে মানুষ উল্লাস করত। গান পাউডার আবিষ্কারের পর তাতে এটা সংযোজিত হয়। চীনের মিং সাম্রাজ্যের কালে বাজির হদিশ মেলে। ভারতেও বাজির আমদানি শুরু হয় চীনের গিরিপথ দিয়েই। তখন তার নাম ছিল মান্দারিন বাজি।
আরও পড়ুন : নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে মজুদ, দিল্লিতে বাজেয়াপ্ত ১,১১৫ কেজি বাজি
মৃত্যুর মহোৎসব
বাজির সূচনাকালের পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান কালের আকাশ-পাতাল ফারাক। কিন্তু এখন সমস্ত রকমের দূষণে ভারী বাতাস, জল, স্থল। এ অবস্থায় একটাও বাজি পোড়ানো আমাদের সন্তানের কয়েক বছরের আয়ু পুড়িয়ে দিয়ে যাবে। সে কারণেই হাইকোর্টে একটি মামলা হয়েছে। যেখানে বাজি পোড়ানো বন্ধের আর্জি জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, বেশ কয়েকটি ডাক্তার সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সগঠন সম্মিলিতভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোভিডকালে এ বছরও বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে বলে একটি ইংরেজি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট অব ইন্ডিয়া (এ আর ও আই), সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিন ইন্ডিয়া, সাউথ এশিয়ান মেডিক্যাল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন সহ বেশ কয়েকটি পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে এই আবেদন করা হয়েছে। ডাক্তারদের মতে, শুধু শব্দবাজিই নয়, সব ধরনের বাজি নিষিদ্ধ করা হোক। কারণ বাজি থেকে বাতাসে যে দূষণ মাত্রা বাড়ে, তা বর্তমান পরিস্থিতিতে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। শুধু যে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়, তা নয়, বাতাসে ভারী ধাতুকণার মাত্রা বেড়ে যায়। বিশেষত, আলোর বাজিগুলি শব্দবাজির তুলনায় অতি-দূষণ ছড়ায়। যদিও এই মুহূর্তে ৯০ ডেসিবেলের কম শব্দসম্পন্ন বাজি পোড়ানোয় কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। ডাক্তারদের অভিমত, দিওয়ালিতে যে পরিমাণ বাজি পোড়ানো হয়, তাতে ২০ গুণ বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জানিয়েছে, তারা বাজি পোড়ানোয় সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে আবেদন জানিয়েছে।
একটি সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, বায়ুদূষণের মাত্রায় এক পয়েন্ট বৃদ্ধিতেও কোভিড আক্রান্তের হার ৬-৭% বৃদ্ধি পাবে। ডাক্তাররা বলছেন, বাজির ধোঁয়া ও ধূলিকণা মিশে যে ধোঁয়াশা (স্মোগ) তৈরি হয়, তা থেকে ভয়ঙ্কর ধরনের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। সরকারকে এ ব্যাপারে অতি সতর্ক থাকতে হবে। এক বিখ্যাত ডাক্তারের মতে, বায়ুদূষণ ও কোভিডের দ্বিমুখী আক্রমণ ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি করে দেবে।
আরও পড়ুন : বাজি ফাটাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
রাজনীতির তুবড়ি
বাজি নিয়ে যখন পরিবেশবিদ-ডাক্তাররা উদ্বিগ্ন, তখন রাজনীতির ফুলঝুরি নিভে নেই। এমনকী ধর্মের তুবড়িতেও অগ্নিসংযোগ চলছে। দিল্লিতে শুরু হয়েছে আপ-বিজেপির বাক্যবোমা ফাটানো। দিল্লির আম আদমি পার্টির সরকার ইতিমধ্যেই যে কোনও বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ করেছে। তা নিয়ে খাণ্ডব দাহনে নেমেছে বিজেপি। দিল্লির বিজেপি সাংসদ মনোজ তেওয়ারির অভিযোগ, এদের সব উদ্বেগের কথা মনে পড়ে হিন্দুদের উৎসবের সময়। কিন্তু, মানুষের বিশ্বাসকে এভাবে পিষে দেওয়া যায় না। দিল্লির প্রবল দূষণের কথা স্বীকার করে নিলেও তিনি বলেন, সরকারকে দূষণমুক্তির বিকল্প ভাবনা ভাবতে হবে। সেজন্য দূষণমুক্ত বাজির ব্যবস্থা চাই। যদিও আপ সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, কোনও বাজিই পোড়াতে দেওয়া হবে না। সেইমতো পুলিশকে কঠোর তল্লাশিতে নামানো হয়েছে। যদিও অসমের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ অবশ্য বাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। দিওয়ালির রাতে দূষণমুক্ত বাজি ২ ঘণ্টার জন্য পোড়ানোর অনুমতি দিয়েছে পর্ষদ।
অন্যদিকে, রাজনীতিরই আর এক অঙ্গ হিসাবে দিওয়ালির বাজি ও বৈদ্যুতিক চকমকি আলো নিয়ে সমাজ-মাধ্যমের কাঠগড়ায় সেই চীন। বিভিন্ন মাধ্যমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থার এক পদস্থ আধিকারিকের বক্তব্য উদ্ধৃত করে গুজব ছড়ানো চলছে। তাতে বলা হচ্ছে, ভারতে গণ- হাঁপানি ও চোখের অসুখ ছড়িয়ে দিতে নতুন ধরনের বাজি ও চীনা আলো রপ্তানি করছে বেজিং। পাকিস্তান সরাসরি ভারতের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে চীনকে এ ধরনের কাজে অনুরোধ করেছিল বলেও দাবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য ভারত সরকারের তরফে এর সত্যতা অস্বীকার করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বাজি শুধুমাত্র পরিবেশ নয়, সামাজিক দূষণও ঘটাচ্ছে। ফলে পরিবেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এই মুহূর্তে বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ করা হোক রাজ্যে। আর এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র সরকারি নয়, নিজেদের মধ্যেই গড়ে তুলতে হবে। আসুন আমরা সকলে সন্তানের ভবিষ্যৎকে আলোকময় করে তুলি দীপাবলিতে। তাদের চুল্লিতে আগুন জ্বালার উদ্দেশ্যে বাজি না-হয় না-ই পোড়ালাম!