বাজল তোমার আলোর বেণু…। মহালয়ার ভোরে এই গানের সঙ্গেই শুরু হয় বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো। শরতের আকাশে বাতাসে ভেসে ওঠে পুজো পুজো গন্ধ। আর হাওয়ার দোলায় নেচে ওঠে কাশবন। আগমনির সুর জানিয়ে দেয় উমা আসছেন। তারপর প্রথমা, দ্বিতীয়া করে একে একে এগিয়ে আসে পঞ্চমী ও ষষ্ঠী। শরতের আকাশে ভেসে ওঠে ঢ্যাং কুড়াকু়ড়… ঢাকের আওয়াজ। আট থেকে আশি বাঙালির মনকে নাচিয়ে তোলে সেই বাদ্যি।
ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত মায়ের আবাহন, বরণ, আরতি, বিসর্জন সব ক্ষেত্রেই ঢাকের বোল একেক রকম। দীর্ঘদিন ধরেই দুর্গা পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ঢাকের বোল ও ঢাকিদের জীবনযাত্রা। চতুর্থী-পঞ্চমী থেকেই ঢাকিরা তাঁদের ঢাক সাজাতে শুরু করেন। সুন্দর কাপড় পরায়, ঢাকের পিছনে সাদা পালক লাগিয়ে সাজায়। ঢাকের সঙ্গে ঢাকির থাকে প্রাণের যোগ। পুজোর দিন কটাতেই রোজগারের পথ খুঁজে পায় ঢাকিদের। নিজের পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে দূরদূরান্ত থেকে তাঁরা চলে আসে কলকাতায়। আশা শহরে ঢাক বাজিয়ে পরিবারের জন্য চারটে নতুন কাপড় নিয়ে যাওয়ার।
ষষ্ঠীর মধ্যেই শিয়ালদহ স্টেশনে চত্বরে ভিড় জমান বাঁকুড়া, বীরভূম,পুরুলিয়ার মতো দূরদূরান্ত থেকে আসা ঢাকিরা। অনেক পুজোর কর্মকর্তারা ওখানে ঢাকিদের ঢাক বাজানো শুনতে ভিড় করেন। বাছাই করে নেন তাঁদের পছন্দের ঢাকিকে। তারপর বায়না হয় বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত। দরদাম করা হয়। বায়নায় ভাল দাম পাওয়ার আশায় নিজেকে উজার করে দেন ঢাকিরা। ষষ্ঠী থেকেই ঢাকিদের বোলে ভেসে ওঠে হর্ষের ধ্বনি। আর দশমীতে উমা যেদিন বাড়ি ফিরে যান সেই বিসজর্নের সন্ধ্যায় বিষাদের সুর ভেসে ওঠে ঢাকিদের বোলে। কারণ মায়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরও ঘরে ফেরার পালা।
শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে ঢাক বাজাচ্ছেন ঢাকিরা
পুজোর দিনগুলিতে ঢাকিদের ঘরে বাজে দুঃখের বোল। গ্রাম বাংলার বহু ঢাকিকেই পুজোর কটাদিন নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে যেতে হয় দূরের কোনও শহরে। কেউ যান পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে। আবার অনেকে চলে আসেন কলকাতায়। ঢাকিদের পরিবার সূত্রে জানা যায়, বংশপরম্পরায় এই কাজ তাঁরা করে আসছেন। পুজোর সময়ে অন্য শহরগুলি যখন আলোর রোশনাইতে ভরে ওঠে তখন মন খারাপের নিয়ন আলো জ্বলে ঢাকিদের পরিবারে।
সময়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন অনেক জায়গায় পুজোর উদ্যোক্তরা সাবেকিয়ানার ঢাকির বোলের পরিবর্তে বেছে নেন হিন্দি গান। আবার কেউ কেউ রেকর্ডিংয়ে ঢাকের আওয়াজ বাজিয়ে খরচ কমানোর পথেও হাঁটেন। যার ফলে বিগত কয়েক বছর ধরেই রোজগারে টান পড়েছে ঢাকিদের। আধুনিকতার এই ছোঁবল বিদ্ধ করেছে তাঁদের। তবুও নতুন নতুন বোল বাজিয়ে আজও উদ্যেক্তাদের মন জয়ের নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। বর্তমানে বহু ঢাকি পরিবারই পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে তুলে দিতে চাইছেন না ঢাক।
গতবছর করোনা পরিস্থিতির কারণেই আরও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে ঢাকি পরিবারগুলিকে। সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী,বড় পুজো করতে চাইছেন না কোনও উদ্যেক্তারা। তাই অন্যান্য বারের মতো চাহিদা অনেকটাই পড়ে গিয়েছে গ্রাম বাংলার ঢাকিদের। আটকে গিয়েছে রোজগারের একটা পথ। ভয়ঙ্কর অতিমারীর আবহে শারদীয়ার আকাশে ম্লান হয়েছে ঢাকিদের ‘খুশির-বোল’।