হঠাৎই তৃণমূলের অভিষেক-বিতর্ক (Abhishek Banerjee and TMC Clash) সামনে চলে এসেছে। স্বাভাবিক ভাবেই সাংবাদিক হিসেবে আমাদের প্রশ্ন, কোন দিকে যেতে পারে জোড়াফুল দলের (TMC) এই অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন?
আমরা যদি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডির ছেলে জগনমোহন রেড্ডি, এনটিআরের জামাতা চন্দ্রবাবু নায়ডু, করুণানিধিপুত্র এম কে স্ট্যালিন, লালুপুত্র তেজস্বী যাদব, মুলায়মপুত্র অখিলেশ যাদব, বিজুপুত্র নবীন পট্টনায়ক, মুফতি মহম্মদ সইদের কন্যা মেহবুবা মুফতি, ফারুক আবদুল্লাপুত্র ওমর আবদুল্লা, নেহরু-গান্ধী পরিবারের রাজীব, রাহুল, প্রিয়ঙ্কা গান্ধী, এরকম অনেক নাম, যাঁরা পারিবারিক সূত্রে দলের উঁচু পদে বসেছেন, অনেকেই সফলও হয়েছেন। সিপিএম, সিপিআই, বিজেপিতে এই ব্যাপারটা নেই। ফলে অভিষেকের (Abhishek Banerjee) উত্থান কোনও ব্যতিক্রম নয়। বলা যায় সেই তালিকায় অভিষেক আরেকটি নাম মাত্র। ভালো হোক, মন্দ হোক, এটাই ভারতীয় রাজনৈতিক ‘পরম্মরা’ হিসেবে এখনও চলছে। মানুষ যদি তাঁদের ভোট না দিতেন, তাহলে বলা যেত এ জিনিস অচল। কিন্তু মানুষ তাঁদের ভোট দিচ্ছেন, জেতাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিচ্ছেন।
স্বাভাবিক কারণেই সাংবাদিক হিসেবে অনেকের মতো আমিও অভিষেককে ফলো করেছি দীর্ঘ সময়। এটা ঘটনা, গত ১০-১১ বছরে তিনি নিজেকে অনেকটাই বদলে ফেলেছেন। গত বছর ৫ জুন আনুষ্ঠানিক ভাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আনা হয় দলের সংগঠনের শীর্ষে। একব্যক্তি-একপদ নীতিতে দলের বর্ষিয়ান নেতা, রাজ্যসভাপতি ৬১ বছরের সুব্রত বক্সী ছেড়েছিলেন সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ। আর সেই দায়িত্ব তৃণমূল সুপ্রিমো তুলে দিয়েছিলেন ৩৪ বছরের যুবক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্ত সাহসী, বঙ্গ রাজনীতিতে প্রায় বিরল। পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিতে কংগ্রেস বা সিপিএমের দলের সংগঠনের শীর্ষে যখন প্রমোদ দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস, গনি খান চৌধুরী, সিদ্ধার্থ রায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়রা এসেছেন, তখন তাঁরা প্রায় সবাই ৫০ পেরিয়ে গিয়েছেন। ব্যাতিক্রম অতুল্য ঘোষ এবং জ্যোতি বসু। অতুল্য ঘোষ রাজ্য সভাপতি হন ১৯৪৮ সালে ৪৪ বছর বয়সে। আর জ্যোতি বসু রাজ্য সম্পাদক হয়েছিলেন ১৯৫৩ সালে ৩৯ বছর বয়সে। মাত্র ৩৪ বছরে সেই গুরুত্ব পেলেন অভিষেক।
আরও পড়ুন- পলিটিকালবিট: ভক্ত-যুগ কি আসছে?
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত কিশোর
এই ধরনের ধূমকেতু-উত্থানে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা সাইড এফেক্ট অব্যশ্যম্ভাবী। হয়েছেও তাই। অভিষেকের উত্থানে, নিজেদের সাফল্যের সেনসেক্স মমতার ছায়ায় যে গতিতে বাড়ছিল, সেই গ্রাফ নিম্নমুখী হতে পারে, এই আশংকায় দল ছেড়েছিলেন মুকুল রায় এবং পরে শুভেন্দু অধিকারী, তৃণমূলী দেওয়ালে কান পেতে এমন কথা অনেকেরই কানে এসেছে। কিন্তু মানতেই হবে, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তৃণমূলের দরজায় প্রবল পদ্ম-ধাক্কা এবং ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে বঙ্গ-পদ্মের পুনর্মূষিক ভব ঘটনার অন্তর্বর্তী প্রায় দু’বছর সময়ে, এক অন্য অভিষেককে পাওয়া গেল। মোদী-শাহ তাঁদের নির্বাচনী বক্তৃতায় ক্রমাগত মমতার সঙ্গে অভিষেককেও আক্রমণ করায়, অভিষেকের খুব দ্রুত একটা সর্ব ভারতীয় পরিচিতিও হয়ে যায়। তখন অনেকেরই মনে হয়েছিল অভিষেকের উত্থানের সাইড এফেক্ট বোধহয় সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেল বা যেতে চলেছে।
নির্বাচনের পূর্বে
১০৭ পুরসভার প্রার্থী ঘোষণায় ২২৭২টি নামের তালিকা প্রকাশ করতে গিয়ে দেখা গেল তৃণমূলের সাফল্যের প্রদীপ থেকে ফের দৈত্যটা বেরিয়ে এসেছে। এর পর জল গড়িয়েছে নানা দিকে। অবশেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাল ধরেছেন। প্রথম বার তিনি বলেছেন, দলের মধ্যে সমস্যা হলে হয় সমস্যার চরিত্র অনুযায়ি তা দেখবেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা সুব্রত বকসী। সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাহলে কী কাজ, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। ফের উত্তরপ্রদেশ যাওয়ার আগে তিনি বললেন , পার্থ-বকশীর সই করা লিস্টই ফাইনাল লিস্ট। এই কথা বলে তিনি কার্যত অভিষেকের লিস্টের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করলেন, এবং একই সঙ্গে এ ব্যাপারে যে সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের কোনও ভূমিকা নেই, তা-ও স্পষ্ট করলেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের সংবিধানে চেয়ার পার্সনকে সব বিষয়ে শেষ কথা বলার চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া আছে। তৃমূল কংগ্রেসের নেতারাও সেটা জানেন বলেই ঠাট্টা করে তাঁরা মাঝে মাঝে বলেন, এখানে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্প পোস্ট। ফলে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি সেকেন্ড ইন কমান্ড সাপ-লুডোর চক্করে পড়ে বেশ কয়েক ধাপ নেমে গেলেন? তৃণমূলে অভিষেক যুগ শুরু না হতেই শেষ হয়ে গেল? আমার তা একেবারেই মনে হয় না। ভারতীয় রাজনীতির যে ‘পরম্পরা’র কথা শুরুতে বলেছি, তা থেকে তৃণমূল কংগ্রেস বিচ্যুত হবে, এমন মনে হয় না।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত কিশোর
আমার মনে হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ‘সিনিয়র লিডার’দের আশ্বস্ত করতে অভিষেককে কিছুটা আড়াল করলেন। এটা সাময়িক। এই ‘এবি’ (অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামীরা তাঁকে এই নামেই ডাকেন, এক সময় অনিল বিশ্বাসকেও সিপিএমে এই ‘এবি’ নামে বোঝানো হত) বনাম কালীঘাটের লড়াইটা আসলে খুবই অস্থায়ী এবং খুবই সংঘাতশূন্য। কমিউনিস্টরা যাকে বলে, নন অ্যান্টাগনিস্টিক কন্ট্রাডিকশন। ভাসমান বরফের চাঙড়ের মাথায় একটা বিরোধের আভাস আছে বটে, কিন্তু বরফের ডুবে থাকা অংশে তা নেই বলেই মনে হয়।