ভোট নেই। খেলাধূলাও নেই বিশ্বে। আলোচনা বলতে দুটি। এক, করোনার দৈনিক সংক্রমণ উঠল না নামল। দুই, বর্ষা কবে আসবে। দুটোই আলোচনাই খুব ক্লান্তিকর। অতএব নতুন বিষয় চাই। তাই আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, তাই নুসরত জাহান, তাই সায়নী ঘোষ। তিন জনকে নিয়েই সীমাহীন আজাইরা প্যাচাল। এবং এই তিন জনের সঙ্গেই আমার, আপনার, কালু, ভোলা, শৈল, রহিম, বীণার কোনও সম্পর্ক নেই।
তিনজনেই নিজের মুরোদে আলোচ্য হয়ে উঠেছেন। এতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে তাঁদের নিয়ে আলোচনাটা আদৌ জরুরি কি না, তাঁদের নিয়ে এই গণবিশ্রম্ভালাপ মানবের কোন কাজে লাগছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত। তবে মানবহিতে আমরা আর কটি কাজই বা করি! মাঝে-মাঝে হিতাহিত বিচার করার দায় সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ভাবে নিজের কাঁধে তুলে নিই। আমাদের প্রিয় বাক্যবন্ধ হয়ে ওঠে, ‘এটা কি উচিত হল?’
উচিত-অনুচিত খোঁজা আমাদের বড় প্রিয় সাধ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফেসবুক বন্ধ করা কি উচিত হল? এতক্ষণ মিষ্টির দোকান খুলে রাখা কি উচিত? সরকারের কি উচিত ছিল না গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া? এরকম হাজার হাজার ‘উচিত’ হেমন্তের শ্যামাপোকার মতো আমাদের কান-মাথা ছেয়ে থাকে। দিবসরজনী আমি এমন আলোচনার বিষয় খুঁজি যার সঙ্গে আমার খোসপেঁচড়া, যদুর গ্যাস-অম্বল কিংবা কুসুমের ‘শরীর খারাপ’-এর কোনও সম্পর্ক নেই। তবু ক্লান্তিহীন আমরা এসব নিয়ে ভাবি। ভেবে চলি। ভাবতে ভাবতে ‘দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।’
বস্তুত আলাপনকে যে আলোচনা শুরু হয়েছে তা মা কালী আর সাধক রামপ্রসাদের ‘মায়ে-পোয়ে আলাপন’-কেও অতিক্রম করেছে। আমলার প্রতি এত ভক্তি বঙ্গজননী আগে দেখেনি। আলাপন আর পাঁচ জন আমলার থেকে আলাদা। কোথায় আলাদা? কেন তাঁকে আলাদা করেছি? বস্তুত তিনি কী কাজ করেন, তাঁর দক্ষতা কতটা—এসব পাঁচপাবলিক জানে না। জানার দরকারও নেই। নিশ্চয় তিনি দক্ষ। মুখ্যসচিব তো আর যে কেউ হতে পারেন না। তবে তিনি ‘আলাদা’ হয়েছেন কতকটা বাঙালির কাব্যপ্রীতির জন্য। তাঁর ভাষা, তাঁর শব্দচয়ন আর পাঁচ জনের চেয়ে কিঞ্চিৎ আলাদা। সর্বোপরি তাঁর নামটাও বেশ অভিনব। মধ্যবিত্ত বাঙালি এসব পছন্দ করে। তাই তিনি অচিরেই ‘অনন্য’ হয়ে উঠেছেন। তাঁর বিশুদ্ধ বাংলা কোথাও যেন থাবা উঁচিয়ে থাকা হিন্দি ভাষার উপর কোমল ভাটিয়ালি প্রলেপ। তবে এরকম বাংলা আরও অনেকেই বলেন। কিন্তু তাঁদের কথা আমরা মনে রাখি না। আমরা সাধারণত উচ্চপদস্থ লোকের গুণাবলি খুঁজতে অভ্যস্ত। অজগাঁয়ের কোনও পাঠশালার শিক্ষকও যে এমন সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, তা যেন আমরা বিশ্বাস করতেই চাই না। আলাপন মুখ্যসচিব থাকলেন, না দিল্লি গেলেন, তা আমরা ভেবে করব কী! এ তো চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। আইএসের সার্ভিস রুল খুলে অনেকেই দেখানোর চেষ্টা করছেন, এটা কেন্দ্রের দোষ। হয়তো ঠিকই বলেছেন। তাঁর প্রতি মোদী-শাহের বাড়াবাড়ি যে প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছুই নয়, সেটা কেকের গায়ে কিসমিসের মতো স্পষ্ট। কিন্তু দোষটা কার, এটা জেনে আমার কী হবে? এটা মেসির গোল নয়, কোহলির সেঞ্চুরি নয়। আমলার বদলি আমাদের প্রাত্যহিক হরষে-বিষাদে কোনও প্রভাবই ফেলে না। তবু একটা প্রশাসনিক লড়াই বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। কখন যে কোনটাকে আমরা আঁকড়ে ধরি, নিজেই জানি না।
যেমন জানি না নুসরত জাহানকে হঠাৎ এত আলোচনার কী হল? নুসরত মা হতে চলেছেন। তাঁর সঙ্গে স্বামীর বনিবনা নেই। অতএব ঝাঁপিয়ে পড়েছে ‘সেই সব শিয়ালেরা।’ তা হলে বাবাটা কে? অনেকে অঙ্ক কষতে বসেছেন। নুসরতের সঙ্গে তাঁর স্বামীর বিচ্ছেদের দিনের সঙ্গে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া দিনের কোনও গোলমাল আছে কি না। যদিচ থাকে, তা হলে বাবাটি কে? নুসরতের গর্ভের ভ্রূণও বোধহয় বুঝতে পারছে, জন্মের আগে থেকেই সে বিতর্কিত। এক কদর্য পরচর্চায় রসালো হয়ে উঠছে আমাদের ঘর্মাক্ত দুপুর। কোনও কোনও টিভি চ্যানেল অঙ্ক কষে বুঝিয়ে দিচ্ছে সন্তানের বাবা নুসরতের স্বামী নন।
যে-বিষয়টি ছিল নুসরতের ব্যক্তিগত, তাকে আমরা হাটের মাঝে এনে ফেলেছি। তাঁর সন্তানের বাবা কে হবেন, এটা একান্তই তাঁর সিদ্ধান্ত। তবু আমাদের জিভ দিয়ে জল পড়ছে। দারুণ একটা বিষয় পাওয়া গেছে। বাবাটা কে? আমি জানি, এ রসপ্ৰবাহ
অনন্ত। সহজে থামার নয়।
সায়নী ঘোষ তৃণমূলের যুব সভাপতি হওয়ার পরও শুরু হয়েছে তর্ক। সায়নী অভিনয় জগতের মেয়ে। ভোটে দাঁড়িয়ে তিনি হেরেছেন। অতএব তৃণমূলের কি উচিত হল, তাঁকে সভাপতি করা? এখন সায়নীর জায়গায় যদি কোনও অখ্যাত লোক যুব সভাপতি হতেন, তা হলে হয়তো এ প্রশ্ন উঠত না। তিনি সিনেমা জগতের লোক বলেই প্রশ্নটা উঠছে। আমাদের মূল্যবোধ এমনই যে, সিনেমার লোকেরা যে অন্য কোনও কাজ করতে পারেন, তা বিশ্বাসই করতে চাই না। তার উপর তিনি যদি মেয়ে হন, তা হলে তো কথাই নেই। সায়নী তৃণমূলের সভাপতি হলে সংসারে কী লাভ বা ক্ষতি হবে আমার জানা নেই। তবু তাঁকে নিয়ে আলোচনা চলবে।
যদিও আমার খোসপেঁচড়া, যদুর গ্যাস-অম্বল কিংবা কুসুমের ‘শরীর খারাপ’-এর সঙ্গে কোনও কিছুরই কোনও সম্পর্ক নেই, তবু…।