মোদী শাহের হতাশার বর্হিপ্রকাশ দেখে আপামর বাঙালি, কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজিবী, সিপিএম, কংগ্রেস, তো বটেই এমনকি রাজ্য বিজেপিরও বেশ কিছু নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, অবশ্যই তাঁদের সবাই প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন না, কিন্তু আলোচনায় বলছেন, এরফলে মমতার আরও সুবিধে হল, মানুষ বুঝতে পারছে পরিস্কার, মোদী – শাহ যা করছেন সেটা রাজনৈতিক হতাশা থেকে জন্ম নেওয়া রাগ থেকে, ওনারা হার, বলা যাক, গোহারান হার সহ্য করতে পারছেন না। সেই রাগ থেকে অবসরের দিন, কিছুদিন আগে মুখ্যসচিব হিসেবে সার্ভিস এক্সটেনশন দেওয়া আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লিতে আসতে বলা, খালি চেয়ার বসিয়ে যাত্রাপালার ছবি পাঠানো, শুভেন্দু অধিকারীকে ডেকে ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা বা মাত্র ২৫০ কোটি টাকার সাহায্য, সবটাই করা হচ্ছে, সবটাই নিছক রাগের নোংরা বর্হিপ্রকাশ।
তো সবাই এসব কথা জেনে গেছেন, এ নিয়ে বিভিন্ন জনের মতামত ছাপা হয়ে গেছে, এনিয়ে খেলা আর একটু এগোক, তখন আপনাদের আমাদের মতামত জানাবো, আজ বরং অন্য আর একটা বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক, এক্কেবারে আলাদা এক বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক, এই অতিমারীর সময়ে আমাদের পড়শি দেশ, বাংলাদেশ আমাদের সাহায্য পাঠিয়েছে, ৭১ এ জন্ম নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ আজ তার পড়শি রাষ্ট্রকে সাহায্য পাঠাচ্ছে, কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের ১০০ টাকা দিলে ভারতের ৫৫ টাকা দিতে হত, এখন ভারতের ৮৬ টাকায় বাংলাদেশের ১০০ টাকা হয়, ওয়ার্লড ইকোনমিক আউটলুক রিপোর্ট বলছে বাংলাদেশের গ্রোথ বা বৃদ্ধির হার, ৩.৮%, ভারতের, -১০.২৯%। বাংলাদেশের মাথা প্রতি জিডিপি ১৮৮৭.৯৭ টাকা, ভারতের ১৮৭৬.৫৩ টাকা, হিসেবটা ভারতের টাকা অনুযায়ী। আরও কিছু হিসেব দিই, ভারতবর্ষে মানুষ গড়ে ৬৯.৪ বছর বাঁচে, বাংলাদেশে, ৭২.৩ বছর। শ্রমিকদের মধ্যে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বাংলাদেশে ৩৬, ভারতে ২০%। মহিলা পুরুষ সাম্য মানে লিঙ্গ সাম্যের দিক থেকে বাংলাদেশ ৫০ এ আর আমার দেশ ভারত, ১১২ তে, বিশ্ব ক্ষুধা তালিকায় বাংলাদেশ ৭৫ এ আর আমরা ৯৪ তে। কোথায় পেলাম এই তথ্য? গ্লোবাল হাঙ্গার রিপোর্ট, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক। হ্যাঁ সেই বাংলাদেশ, যেখানকার নাগরিকদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তড়িপার, অমিত শাহ’জি বলেছিলেন, টারমাইট, উঁইপোকা। ওনার জানাই নেই উঁইপোকার ঢিপির ভেতরে ছিলেন বাল্মিকী, রামায়ণ প্রণেতা। তো সেই কোট আনকোট উইঁপোকার দল, যারা স্বাধীনতা পেল এই সেদিন, তাঁরা আমাদের থেকে অর্থনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, কৃষিতে অগ্রগতি অবাক করে দেবার মত, আইটি ইউনিভার্সিটিতে তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যতের বিশ্বকর্মারা, তাদের সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, জামাতে ইসলাম সেখানে নিষিদ্ধ, কাঠমোল্লার বিরুদ্ধে লড়ছে সরকার, সেদেশের যুক্তিবাদী মানুষজন, ছাত্র ছাত্রীরা। আর এই উন্নতি, অগ্রগতি তার চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে তাঁদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে, তাঁদের দীর্ঘ লড়াই, আত্মদানের মধ্যে। মুসলমানদের আলাদা দেশ চাই, এই দাবিতে ভারত পাকিস্তান ভাগ হল। একধারে রুক্ষ পাহাড়, পর্বতঘেরা পশ্চিম পাকিস্থান আর এধারে নদীমাতৃক পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে তৈরি হল পাকিস্তান, কায়দে আজম জিন্নাহ হলেন প্রথম রাষ্ট্রপতি, ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস। সেদিন ঢাকাতেও উল্লাস হয়েছিল, আসলে হিন্দু জমিদারদের ক্রমাগত অত্যাচার আর শোষণ থেকে মুক্ত বাঙালি মুসলমান এক অন্য স্বাধীনতা পেয়েছিল বৈকি, তাঁরা তাঁদের মত করে স্বাধীনতার মানে বুঝেছিল, তাহলে সেই জনসমষ্টি বছর ১০ এর মধ্যেই কেন আবার নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন মনে করলো? কেন তাঁদের সামাজিক রাজনৈতিক পরিসরে, আবার নিজেদের স্বাধীন স্বদেশের কথা উঠতে শুরু করলো? কেন তাঁরা আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলতে শুরু করলেন? কেন মুজিবর রহমান ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার কথা বললেন? কেন বললেন, এ লড়াই বাঁচার লড়াই? (মুজিবরের বক্তৃতাটা আবার একটু শুনুন), আসুন, আজ আমাদের দেশের রাজনীতি নিয়ে না কপচিয়ে আমাদের পড়শি রাষ্ট্র বাংলাদেশ কেন তৈরি হল, সেই ইতিহাসটা একবার ফিরে দেখা যাক, ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ থেকে ৩১ মে, হ্যাঁ এই মে মাস, ১৯৭১ এর মধ্যে, দু মাসে ৩ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল, পাকিস্তানি সেনা, আল বদর, আল শামস, রাজাকারেরা। কেন হয়েছিল এই গণহত্যা? এক কথায় উত্তর হল, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের শেষ করার জন্য। তো সেই বাংলাদেশের মানুষজন, যাঁরা ১৯৪৭ এই স্বাধীনতা পেলেন, তাঁদের কোন প্রয়োজন ছিল? আবার একটা স্বাধীনতার? তার ইতিহাসের সূত্রপাত বাংলা ভাষা জন্য লড়াই। পাকিস্তান ঘোষণা করে দিল, ঊর্দুই হবে জাতীয় ভাষা, এদিকে বাংলাদেশে ঊর্দু বলে ক’জন? বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, মুজিবর রহমান, পাকিস্তানের অন্যতম দাবীদার, আন্দোলনের নেতা, অবাক হয়ে দেখলেন, স্বাধীনতা তাঁর মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। ভাষার আন্দোলন শুরু হয়ে গেলো, সেদিন থেকেই কিছু মানুষ আবার নিজেদের পরাধীন মনে করাও শুরু করলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ পোঁতা হয়ে গেলো, কেউ টেরও পেল না, ইতিহাস এমনই হয়, বহু ঘটনা এক অন্য ঘটনার জন্ম দেয়, যা তখনই বোঝা যায় না, কেবলমাত্র সুবিধের জন্য আনা এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজের চর্বি যে সিপাহী বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারে, তা ক’জনই বা ভেবেছিল? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই বাংলা ভাষার আন্দোলন নেমে এল রাজপথে, গুলি চললো শহিদ হলেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার। ৫৪ র মে মাসে বাংলা ভাষা, ঊর্দুর সঙ্গেই স্বীকৃতি পেল, কিন্তু অসন্তোষ থেকে গেলো, বাংলাভাষী অফিসার, কর্মচারি, রাজনীতিবিদদের অবহেলা করা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, অপমান করা, চলতে থাকলো, আর সেই বিদ্বেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অক্সিজেন দিতেই থাকলো, শেষদিন পর্যন্ত। মুজিব বক্তৃতা শেষ করলেন নতুন শ্লোগান দিয়ে, বললেন জয় বাংলা, প্রান্তর থেকে প্রান্তরে প্রতিধ্বনিত হল সেই শ্লোগান, জয় বাংলা।
https://www.youtube.com/watch?v=Yk-aZsEzPiU&t=2s
এরপরের কারণ ছিল বঞ্চণা, প্রবল বঞ্চণা, বাংলাদেশ ট্যাক্স দিচ্ছে বেশি, তাদের তৈরি সম্পদের মূল্য বেশি, অথচ তাদের ভিক্ষে দেওয়া হচ্ছে, শাসন চলছে রাওলপিন্ডি থেকে, করাচি থেকে। ১৯৫০ -৫৫ তে পশ্চিম পাকিস্তান পাচ্ছে ১১,২৯০ মিলিয়ন পাকিস্তানি টাকা, পূর্ব পাকিস্তান পাচ্ছে ৫২৪০ পাকিস্তানি টাকা, ১৯৫৫-৬০ এ পশ্চিম পাকিস্তান পাচ্ছে ১৬৫৫০, পূর্ব পাকিস্তান পাচ্ছে ৫২৪০, ১৯৬০-৬৫ তে পশ্চিম পাকিস্তান পাচ্ছে ৩৩৫৫০ মিলিয়ন পাকিস্তানি টাকা, পূর্ব পাকিস্তান পাচ্ছে মাত্র ১৪০৪০ মিলিয়ন টাকা, ১৯৬৫- ৭০ এ পশ্চিম পাকিস্তান পাচ্ছে ৫১৯৫০ মিলিয়ন পাকিস্তানি টাকা, পূর্ব পাকিস্তান পাচ্ছে ২১৪১০ মিলিয়ন টাকা, এই বঞ্চনা বাংলাদেশের মানুষ পদে পদে টের পেত, তাঁদের চাকরি ছিল না, মিলিটারিতে সম্মান ছিল না, তার ওপরে এই অর্থনৈতিক বঞ্চণা বিরাট প্রভাব ফেলেছিল, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পেছনে এই বঞ্চণা বিরাট কাজ করেছিল, মানুষ বুঝেছিল তাঁদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, অতএব স্বাধীনতা চাই।
এরপর ছিল সাংস্কৃতিক সামাজিক ফারাক, পূর্ব বাংলায় হিন্দু মুসল্মান সম্প্রীতি পাক রাজনীতিবিদরা মেনে নেয়নি কোনওদিন, তাঁরা বাংলাদেশের মুসলমানদের সহি মুসলমান বলেও মনে করতো না, তাঁদের খাবার দাবার, গান বাজনা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এতটাই আলাদা ছিল যে তাঁদের একসঙ্গে থাকা প্রায় অসম্ভব ছিল, যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এটা পাক রাজনীতিবিদ, ইয়াহিয়া খানেরা বুঝতো বলেই, ২৫ শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইটে তারা হত্যা করে এখনকার বাংলাদেশের সাহিত্যিক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের।। আর রাজনীতি, বাংলাদেশে মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামি লিগ আর পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টি, সম্পূর্ণ বিপরীত রাজনৈতিক ধারণা নিয়ে চলত, এবং পিপলস পার্টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের দল, আওয়ামি লিগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের দল, ১৯৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামি লিগ পেল ১৬৭ টা আসন, পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেল মাত্র ৮৬ টা আসন, ক্ষমতায় ইয়াহিয়া খান, মিলিটারি জেনারেল। পিপিলস পার্টির নেতা ভুট্টো বললো অসম্ভব, এই হার মেনে নিচ্ছি না, মুজিবর রহমানকে মানবো না, ভোটে জিতেছে তো কি হয়েছে, পশ্চিমে এলে তাদের জবাই করা হবে। কোনও মিটমাট হল না, মিলিটারি শাসন শুরু হল, এবং তার সঙ্গে স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাঙালি লড়েছিল, অনেকেই বলেন, ভারতের সাহায্যে লড়েছিল, হ্যাঁ ঠিক, কিন্তু ভারত লড়াইটা লড়ে দেয়নি, লড়াইটা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারাই লড়েছিল, বিভিন্ন ফ্রন্টে বিভিন্ন নেতা, বিভিন্ন লড়াই, কিন্তু বাঘের বাচ্চার মত লড়েছিল বাঙালিরা, জিতেছিল। সেই ১৯৭১ এ স্বাধীন হওয়া ছোট্ট দেশ, বাংলাদেশ আজ প্রগতির পথে, তাদের চাকরি বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে, মাথা পিছু রোজগার বাড়ছে, তারা পাশেই এত বিশাল এক দেশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েই যাচ্ছে। সেদিন সেলাম জানিয়েছিলাম স্বাধীনতার জন্য, স্বাধীনতার লড়াই এ জয়ী হওয়ার জন্য, আজ কুর্ণিস এই অগ্রগতির জন্য।