বিপর্যয়ের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরও গভীর ধন্দে ঢুকছে রাজ্যের সবথেকে বড় বামপন্থী দলটি। কী রাজনীতির দিশা, কী সাংগঠন, কী প্রচার, সব ব্যাপারেই বিভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অস্তিত্বের এহেন গভীর সংকটে বেঁচে উঠবার আপ্রাণ চেষ্টাটাই যেন তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না রুটিনমাফিক এই জেলা-রাজ্য কমিটি-গত চর্চায়।
নির্বাচনে কল্পনাতীত ধাক্কার পরে পর্যালোচনা বৈঠকে বসেছে সিপিএম। এর আগে জেলা কমিটিগুলিও প্রাথমিক পর্যালোচনা সেরেছে। জেলা স্তরের আলোচনার সুর বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ২৯ মে তারিখে হওয়া রাজ্য কমিটির বৈঠক থেকে। জেলাগুলির আলোচনায় উঠে এসেছে নানা মত। যে ফলাফলকে বিপর্যয় বললেও কম বলা হয়, তার কারণ খোঁজা, সামনের দিকে এগিয়ে যাবার মতো বিষয়ে মতামত সংগঠিত করতে গিয়ে অবশ্য দলটির সম্পূর্ণ এলোমেলো চেহারাটাই সামনে এল আরেকবার।
বর্তমান পর্যায়ে রাজ্য কমিটির বৈঠক দু’দিনের। ১৯ ও ২০ জুন। অনলাইনে চলা এবারের রাজ্য বৈঠকেও রাজ্য নেতৃত্বের তরফে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে, যা চূড়ান্ত হবে ২০ জুন, অর্থাৎ এবারের বৈঠকের শেষ দিনে। কী কী বিষয় আলোচনার তালিকায় রয়েছে? সংক্ষেপে বলা যায়, নির্বাচনের জন্য দলের তথা বামফ্রন্টের সাংগঠনিক প্রস্তুতি, কংগ্রেস ও আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট গড়ার সিদ্ধান্ত, প্রার্থী ঠিক করায় দেরি, জোটের নানা দল ও শক্তিগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, এসবই চর্চার বিষয়। তাছাড়া আছে রাজনৈতিক লাইনের আলোচনা। তৃণমূল ও বিজেপি, উভয়কেই প্রতিদ্বন্দ্বী চিহ্নিত করে, ‘বিজেমূল’ ফরমুলা বানিয়েছিল সিপিআইএম। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে কার্যত তৃণমূলের বিরুদ্ধেই সমালোচনার বর্শাফলক কেন্দ্রীভূত হয়েছিল কি-না, সেটাও হয়ে উঠেছে বিতর্কের অন্যতম দিক। কংগ্রেস বা আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট গড়তে গিয়ে কয়েকটি বাম দলকে সঙ্গে রাখা গেল না, অল্প কয়েকটি আসনও দেওয়া গেল না কেন, উঠছে এসব প্রশ্নও। প্রসঙ্গত, এসইউসি বরাবরই আলাদা লড়ে, ২০০৯-১১ পর্বে তৃণমূলের সঙ্গে জোট বাঁধাটা ব্যতিক্রম। কিন্তু অনেক আন্দোলনের পথ একসঙ্গে চলেও সিপিআইএম-এল লিবারেশন বা পিডিএস-এর মতো বামদলগুলি ছিটকে গেল কেন, সেটাও প্রশ্ন হিসেবে রয়েছে।
১৯ জুন শনিবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত হওয়া সভার যে খবর আমাদের হাতে এসেছে, তাতে মোটের ওপর রাজ্য নেতৃত্বের প্রতি আস্থাই রাখা হয়েছে। যেমন, জানা যাচ্ছে, তৃণমূল ও বিজেপি, উভয়কেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখার লাইন সিপিআইএম-এর রাজ্য তথা সর্বভারতীয় স্তরের সম্মেলনগুলিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের অনুসারী। তা নিয়ে তেমন প্রশ্ন তোলা হয়নি। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়েও কথা প্রায় একই। এটাও দলটির সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্ত মোতাবেক হয়েছে বলেই সাধারণ মতামত উঠে আসছে। আইএসএফ সংগঠনটিকে সাম্প্রদায়িক সংগঠন বলে দাগিয়ে দেবার একটা প্রবণতা অনেকের মধ্যে থাকলেও তাদের প্রার্থী তালিকায় অধিকাংশ হিন্দু হওয়ায় সিরিয়াস আলোচনায় ওই সংগঠনকে সাম্প্রদায়িক বলা কঠিন, সেটা সিপিআইএম-এর জেলা নেতারা বোঝেন। এসবের ফলশ্রুতিতে জোট নিয়েও সমালোচনা খুঁটিনাটির মধ্যেই আটকে রয়েছে।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সিপিআইএম প্রচারের চমক তৈরি করেছিল। জনপ্রিয় চটুল গানের প্যারডি করে রাজনৈতিক কথা ঠেসে এক ধরনের সহজ পথে মানুষের কাছে পৌঁছবার রাস্তা বের করেছিল তরুণ প্রজন্মের দলীয় কর্মীরা। দলের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম এই ডিজিটাল বিপ্লবের পুরোধা। এটা নিয়ে কিছু দ্বিধা থাকলেও এই গানই যে পরাজয়ের কারণ, সেটা বলার মতো বালখিল্য আচরণ করছেন না কেউই। সংগঠনের নানা দুর্বলতা নিয়েই কথা হচ্ছে বেশি। দলের নীচের দিকের কর্মীরা যাতে নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবে অসহায় মনে না করেন, সেটার কথাও বলা হচ্ছে বারবার। তবে, কেন এত বিপুল সংখ্যায় বাম ভোটার বিজেপি তথা তৃণমূল শিবিরে চলে গেল, তার তেমন জোরালো ব্যাখ্যা মিলছে না। টিভি বা খবরের কাগজ এবারের নির্বাচনকে দ্বিমেরু বলে প্রচার করাতেই এমন হাল, এই কথায় চিঁড়ে কতটা ভিজবে কে জানে! এক কথায় প্রথম দিনে রাজ্য কমিটির সভায় বিমান-সূর্য-সেলিম-রবীনদের তেমন শক্ত বিরোধিতায় পড়তে হয়নি, রাশ রয়েছে নেতাদের হাতেই। আগামীকাল, ২০ জুন ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা। রেড ভলান্টিয়রদের অসমসাহসী উদ্যোগকে সেলাম জানিয়েও সমর্থকরা চান দিশা দেখানোর মতো রাজনৈতিক উদ্যোগ। তেমন কোনো তাস যে বিমান-সূর্য-রবীনদের আস্তিনে লুকোনো নেই, তা আগেভাগেই বলে দেওয়া যায়।