‘তবু দেখ নৃপমণি, রিপু প্রহরণে
ক্ষত বক্ষস্থল মম, পৃষ্ঠে নাহি অস্ত্রলেখা।’
মাইকেলের ভগ্নদূতের এই ক’টি কথা প্রায় প্রবাদ হয়ে গেছে বীরত্বের বর্ণনায়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ক্ষত্রিয় সমাজের দৃষ্টিতে ‘রণছোড়’ প্রজাতি ছিল নরকের কীট। তাদের বাঁচার অধিকার ছিল না। অথচ, গত ২ মের পর থেকে দেখা গেল, উজাড় হওয়া পদ্মবনে আর ভ্রমরের দেখা নেই। কোথায় গেল তারা সব! এই প্রশ্নটা এখন পশ্চিমবঙ্গবাসীর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
কিছুদিন আগেও যাদের মৌমাছির মতো বাংলার মধু চুষে খাওয়ার নিমিত্ত আকাশপথে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে, আজ তারা মেঘের আড়ালে চলে গেল কেন? বিশেষত যখন করোনা এবং যশদীর্ণ বাংলার শরীরে গভীর ক্ষত হয়েছে। তখন তাতে ‘ত্রাতা মধুসূদন’ হিসাবে যাদের ঝাঁপিয়ে পড়ে ফের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার চুষিকাঠি ধরিয়ে দেওয়ার কথা, সেই সেনানিরা কোন মাতৃক্রোড়ে মুখ গুঁজল? ত্রাণ-পুনর্বাসন, করোনা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর মতো মাজার জোর যে এত সহজে হারিয়ে ফেলবে ‘কমলসেনা’ তা কি বাঙালি ভেবেছিল!
তাহলে হলটা কী?
প্রথমত, বাংলার ভোটে যারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পলাশির প্রান্তরে জড়ো হয়েছিল, তারা আদতে অবঙ্গজ। তাই এ মাটির ঘ্রাণ তাদের কাছে অজানা। আর বঙ্গীয় যে গন্ধমূষিকের দল জলদস্যুদের পালে বাতাস দিয়েছিল, তারাও ছিল ক্ষমতার মোহে বুঁদ। মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার পাওয়ার পর হায়ার সেকেন্ডারিতে এসে বয়ে যাওয়া ছেলে যেমন কোনওমতে সেকেন্ড ডিভিশনে গণ্ডি টপকায়, তাই ঘটেছে পদ্মলোচনদের। টেনিদার মতো আচার-আচরণ হয়ে গেছিল। প্যালারামের জীর্ণ শরীরে যেন এইট প্যাকের ভাস্কর্য খোদাই হয়েছিল। ‘অতি দর্পে হত লঙ্কা’ হতেও তাই সময় নেয়নি।
দ্বিতীয়ত, একজন বাঙালি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দলে যোগ্য বঙ্গ-নেতৃত্বের ঘোরতর অভাব। বাকিটা পুরোটাই অবাঙালি। যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আবার বেনিয়া। ফলে সাংস্কৃতিক একটা দূরত্ব থেকেই গেল। জাত্যভিমান কিংবা প্রাদেশিকতাবাদের কথা অন্তরালে রেখেই বলা যায়, এই প্রথম বাঙালিকুলের অবচেতনের আক্কেল দাঁতে ঘা লাগল। এই ভেবে যে, খোট্টাশালার ব্যাটারা সুযোগ পেলেই শ্রীকান্তের পিসেমশাইয়ের মতো ‘কিলায়কে কাঁঠাল পাকায়…’ দেবে। এমনিতেই বাংলায় এখন মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ হিন্দিভাষী। কলকাতা, খড়্গপুর, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, আসানসোল, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ির মতো বড় শহরগুলিতে অবাঙালিতে ভরে গেছে। প্রাচীন জনগোষ্ঠীদের মতো বাঙালিরা এখন উপকণ্ঠে আশ্রয় খুঁজে পেয়ে আমোদবোধ করছে। তাই সরকার পরিচালনাতেও আর অবাঙালি রাজদণ্ড আসুক চায়নি তাঁরা।
তৃতীয়ত, বেনোজল। লোকসভার পর বিধানসভা ভোটের আগে পর্যন্ত নির্বিচারে আয়তন বড় করার লোলুপতা। বানের জলে ভেসে আসা মরা গোরু, শুয়োর, ভেড়া, পাঁঠা কিছুই বাদ দেয়নি জাল ফেলে তুলতে। যেগুলোর গা দিয়ে দুর্নীতির পূতিগন্ধ বেরিয়ে গেছে, তাদেরও গায়ে আতর ছড়িয়ে, সং সাজিয়ে নাচঘরে খেমটা নাচাতে কসুর করেনি। মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
যাইহোক পরাজয় তো হতেই পারে! কিন্তু রাজ্য বিজেপি তো যুদ্ধবন্দি হয়নি এ রাজ্যে! তাহলে তারা এভাবে আত্মগোপন করে আছে কেন? কারণ, রাজনৈতিক দৈন্য। দলটা বৃহৎ হয়েছে হাইব্রিড পদ্ধতিতে। কম সময়ে অধিক উৎপাদনের মতো ‘ফাঁকি দিয়ে মহৎ কার্য’ করার প্রবৃত্তিই সর্বনাশ ডেকে এনেছে। তাই বাংলার ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের ঘনঘটা ঘনিয়ে এল, তখন মেঘের আড়ালে চলে গেল তারা। তাদের থেকেও তো খারাপ দশা সিপিএমের। তবু, তারা তো এখন ‘রক্তিম সেবক’ হয়ে আর্তের সেবায় নেমেছে। পাশে দাঁড়াচ্ছে। সহায়ক হচ্ছে।
আসলে শুধু ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করতে গিয়ে বিজেপি আদর্শগত হিমবাহ গড়তে পারেনি। সুরায় ভাসা বরফের মতো তাই গলতেও সময় নেবে না। শূন্য দিয়ে যার শুরু, আগামীতে শূন্যেই মিলিয়ে যাবে, অন্তত এরাজ্যে। দমবন্ধ হয়ে আসা হাইব্রিড মেঘনাদরা এখন সকলেই অক্সিজেনের খোঁজেই রয়েছে।
গ্রাফিক্স: ঋতিকা দাস