বিজেমূল। অর্থাৎ বিজেপি তৃণমূল দুইয়ের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে। বিধানসভা নির্বাচনে এই তত্ত্ব সামনে রেখেই ময়দানে নেমেছিল সিপিএম। ভোটের ফলে তারা ঠেকে শিখলো। বিজেমূল তত্ব অবশেষে খারিজ করতে চলেছে বামফ্রন্টের প্রধান শরিক। দলের নির্বাচন উত্তর পর্যালোচনায়, সিপিএম রাজ্য কমিটি বস্তুত স্বীকার করে নিয়েছে, প্রতিপক্ষ হিসেবে বিজেপি ও তৃণমূলের প্রতি সমদূরত্বের নীতি আমজনতা গ্রহণ করেনি। বরং ‘পার্টির পরিধির বাইরে বিশাল জনসমষ্টির সঙ্গে বামশক্তির বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে’ ।
বিলম্বিত বোধদয়ের এ এক হাতে গরম দৃষ্টান্ত। কথায় বলে, কেউ দেখে শেখে, কেউ বা ঠেকে। বাংলায় সিপিএম দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। গত বিহার বিধানসভা ভোটে যে সিপিএম বৃহত্তর বাম ঐক্যের শরিক হয়ে লড়াই করেছিল হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন রাখার প্রত্যয় নিয়ে, সেই দলই বাংলায় পরোক্ষে বিজেপির পালে হাওয়া যোগান দিতে তেড়েফুঁড়ে উঠেছিল তৃণমূল বিরোধিতায়। অর্থাৎ প্রধান আর অপ্রধান প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করতে ব্যর্থ । ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেই দেখা গিয়েছিল, অন্ধ তৃণমূল বিরোধিতায় নিজেদের ভোটের একটা সিংহভাগ পদ্ম শিবিরে ভিড়ে গিয়েছিল। চোখকে মন ঠাওর করে অনেক সিপিএম নেতাকেই বলতে শুনেছি, তাঁদের কমিটেড ভোটাররা নাকি তৃণমূলকে শায়েস্তা করতে বিজেপিকে বেছে নিয়েছে। পরের বিধানসভা ভোটে তারা নাকি ফিরে আসবে বামেদের ঘরে।
কেন ফিরবে ?
সিপিএম নেতাদের চটজলদি জবাব , মোদীভাই- দিদিভাই যে বোঝাপড়া করে চলছে,তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। এখান থেকেই মূলত সিপিএম নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজ মাধ্যমের দেওয়ালে দেওয়ালে মুচমুচে গল্প সহযোগে ছড়িয়ে দেওয়া
হলো বিজেমূল তত্ত্ব। কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, when theory grips the masses, it becomes a material force, ভোটের ফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সিপিএম মালুম পেয়েছে তাদের সেই তত্ব রাজ্য কমিটির দুই দিন ব্যাপী অধিবেশনের বহু আগেই masses অর্থাৎ আম জনতা বাতিল করে দিয়েছে। আসলে মানুষ তাঁর অভিজ্ঞতার বিনিময়ে শত্রু-মিত্র বেছে নেয়। বরং বলা যায়, সিপিএম বা বামফ্রন্টের বাইরে থাকা একটা বিশাল বাম মনোভাবাপন্ন জনগোষ্ঠী ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ইত্যাদি যে প্রচার করেছিল,তা জনতার দরবারে গ্রহণযোগ্য হয়। তার প্রাবল্য এতটাই যে সিপিএম তার রামে চলে যাওয়া ভোটারদের একাংশ পর্যন্ত বিজেপি বিরোধী হয়ে পড়ে। ২০১৬ সালে বামেরা যে ৩২টি আসন পেয়েছিল, এবার তার ৯টি বিজেপি বাকি ২৩ আসন গিয়েছে তৃণমূলের দখলে। গত লোকসভায় এদের একাংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল, বামেদের ভাড়ার শূন্য করে। এবার হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে রুখতে তারাই তৃণমূল তথা ‘জাতশত্রু’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিয়েছে।
‘আমাদের চাঁদা দিয়েছে, হই হই করে ব্রিগেড গিয়েছে, কিন্তু কাস্তে হাতুড়ি তারা নয় ভোট দিয়েছে ঘাসফুলে। সেটা আবার চুপি চুপি বলে গিয়েছে ভাবতে পারেন!’-
ছাত্রবয়স থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে পার্টি করা বর্তমানে কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যের ওই আর্তনাদের জবাবে বলতেই হলো, ভাবতে তো পারি। কিন্তু যে ভাবনাটা আপনাদের ভাবা উচিত ছিলো, তা তো ভাবেননি। বিজেপির ফ্যাসিস্ট প্রবণতার যে ব্যাখ্যা আপনারা দিয়েছেন,তার সঙ্গে তৃণমূল যতই অগণতান্ত্রিক আচরণ করুক না কেন,তাকে এক আসনে বসানো ভুল। এখন বলবো নিছক ভুল নয় একজন বামপন্থী হিসেবে অন্যায়। আসলে তৃণমূল তথা মমতার কাছে ২০১১ সালে পরাজয়কে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সিপিএম নেতৃত্বের একাংশ। রাজনীতি বিযুক্ত ব্যক্তি আক্রোশ প্রাধান্য পেয়েছিল। দলের শাখা স্তরের অনেকের সঙ্গে কথা বললেই দেখতাম, বিজেপির বিরুদ্ধে বলার চাইতে মমতাকে নিয়ে লঘুরসের তাচ্ছিল্য ভরা উপহাস করতে বেশি আগ্রহ ছিল তাদের। সিপিএমের তরফে তৃণমূলের বিরোধিতাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল ‘অরাজনৈতিক ব্যক্তিগত অসুয়া জনিত রাগের বহিঃ প্রকাশ’। মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগকারী কমরেডদের এই তথাকথিত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বার্তা ছড়িয়ে গিয়েছিল। আজ যখন বিধানসভায় বাম শূন্য হওয়ার পর টনক নড়েছে সিপিএমের।
দলের রাজ্য কমিটির অধিবেশন শেষে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়নে তাদের যে ভুল হয়েছিল তা কবুল করেছেন আলমুদ্দিনের কর্তারা।
‘প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধী মানসিকতা ছিল। কিন্তু বিজেপির আক্রমনাত্বক আগ্রাসী প্রচারে ক্রমান্বয়ে বিজেপি বিরোধী মানসিকতা গড়ে ওঠে। বিজেপির এই আস্ফালনের মধ্যে তৃণমূলের ভোট লুট, দুর্নীতি, সর্বক্ষেত্রে নৈরাজ্য, গণতন্ত্রহীনতা মানুষের মধ্যে নির্বাচনী বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি। বিজেপির আগ্রাসী আস্ফালন, বাংলা ও বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধ একটি উপাদান হিসেবে কাজ করেছে’- এমনই দাবি সিপিএমের।
কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের অর্থনৈতিক অনাচার থেকে পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, কোভিড পর্বে কাজ হারানো মানুষের অসহায়তা, কৃষিজীবীদের নিরাপত্তা কেড়ে নেওয়া আইন, শ্রম কোড চালু করার মতো বিষয়গুলি যে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর পথে অন্তরায় এবং তাকেই যে মানুষ অগ্রাধিকার দিচ্ছে,সেটা টের পায়নি এই বামেরা। আসলে বাম জমানার অন্তিম পর্বে সিপিএম মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে যে যান্ত্রিকতার শিকার হয়েছিল, তা ক্ষমতাচ্যুতির এক দশক পরেও বহাল রয়েছে। একদা পাড়ায় পাড়ায় মানুষের হাড়ির খবর রাখা কমরেড এখন মমতাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করাটাকেই রাজনৈতিক টাস্ক এবং শ্রেণি সংগ্রামের অনুশীলন বলে মনে করে। তাই তাদের বিকল্প নীতি ছিল ধোঁয়াশাময়।
একথা ভোটের আগে বলতে গেলে আপনাকে বিজেমূল তকমা সেটে দিতেন সিপিএম নেতা-কর্মীরা। এখন নিজেরাই বলছেন, ‘সংযুক্ত মোর্চা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলা যায়নি। আমাদের রাজনৈতিক প্রচার জনগণের মধ্যে দাগ কাটেনি। বিকল্প সরকার গঠনের স্লোগান প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। পার্টি পরিধির বাইরে বিশাল জনসমষ্টির সঙ্গে বাম শক্তির বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।’
‘বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে’ না হয়ে গিয়েছে? যাইহোক-এই স্বীকারোক্তি কি শুধু আনুষ্ঠানিক ?
সময়ই তার জবাব দেবে। তবে সম্প্রতি, সদ্য প্রাক্তন রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দোপাধ্যায়কে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকারের কর্মকান্ড নিয়ে সিপিএম কেন্দ্রের সমালোচনা করেছে। অন্তত এক্ষেত্রে অন্ধ তৃণমূল বিরোধিতার আত্মঘাতী পথে যায়নি একদা বিজেমূল তাত্বিকরা।