নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন. ঘনঘন কী হইতে পারে, কে আগাইয়া আছে, কে পিছাইয়া গেল? এমন শতেক চিন্তা মাথায় ঘোরে এবং নিজের দলের নেতাকর্মীদের চেয়ে অনেক বেশি কথা বলেন বিরোধী দলের আড়কাঠি আর সেই সব সাংবাদিকদের সঙ্গে যাঁরা নির্বাচনের পণ্ডিত। তারপর সময় ও সুযোগ বুঝে মাস দুই কি তিন আগে থেকেই দল বদলানো বা নিজের দলেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এবং রাজনৈতিক দলও, তারাও হিসেব নিকেশ চালাতে থাকে, কোন জোট সম্ভব কোন জোটে গেলে ভোট শতাংশ বাড়বে, কোন জোট তৈরি হলে নিজেদের ওজন বাড়বে ইত্যাদি। এই যে ইন্ডিয়া জোট বা এনডিএ জোট এসব তো এমনি সময় শোনা যায় না। নির্বাচন আসছে, ঢাক বেজে গেছে, অতএব জোট নিয়ে নানান জট এবং সেই জট খোলার চেষ্টা চলছে, একধারে নয় দুধারেই। এখানে রাহুল-ইয়েচুরি, রাহুল-মমতা, রাহুল নীতীশ কথা হচ্ছে, ওদিকেও দেবেগৌড়া গিয়ে অমিত শাহ জগৎপ্রকাশ নাড্ডার সঙ্গে কথা বলেছেন। মানে কোন জোটে সব থেকে বেশি লাভ, কোন জোটের সামাজিক সমীকরণ সবথেকে বেশি ভালো এ নিয়ে আপাতত বিস্তর গবেষণা চলছে। এ বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। কেবল নিজের নয়, বিভিন্ন শিবির তাকিয়ে আছে অন্য শিবির অন্য দলের দিকে আর সেটাই বিষয় আজকে, বাংলায় নতুন বছরে কি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হবে?
আপাতত যে জোট আছে এ বাংলায় তা তো সবার জানা। বিজেপি একধারে, পাহাড়ের রাজনীতি খুব সুকৌশলেই আপাতত তিন টুকরো, একদল বিজেপিকে সমর্থন করলে অন্যদল তৃণমূলকে সমর্থন করবে। আগের মতো গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থন পেলেই সাংসদ নির্বাচিত হবে, সেই মিথ চুরমার। এবং পাহাড়ের জোটের জট পুরোপুরি না কাটলেও পরিষ্কার হচ্ছে। আদিবাসী এলাকাতে গতবার বিজেপি যেমন বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিতে পেরেছিল সেই জায়গাটা বিধানসভার আগেই উবে গেছে। পুরুলিয়া থেকে জঙ্গলমহলে বিজেপির নির্বাচনী সঙ্গী নেই। কাজেই ওই পাহাড়ের এক গোষ্ঠী বাদ দিলে বিজেপি এ রাজ্যে একলা। কিন্তু এবারেও অপারেশন কমলের চেষ্টা যে হচ্ছে না তাও নয়। দু’ তিনজন কুনকি হাতি ঘোরাফেরা করছে, নির্বাচনের আগে যদি তৃণমূলের একটা ধস নামানো যায়।
আরও পড়ুন: রাজ্য সভাপতি সুকান্তবাবুর ঠাং ধরে কে দিলো টান?
সেই যদির কথা নদীর ধারেই থাক আর সেটা হলেও তা মহারাষ্ট্রের মতো তৃণমূল ভেঙে আলাদা দল এবং তার সঙ্গে জোট, এরকম হওয়াটা অসম্ভব। রাজ্যে ঘোষিত বাম-কংগ্রেস জোট তো আছে, বামেদের খুব ছোট্ট একটা অংশ এই জোটে খুশি নয় কিন্তু ওই যে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা, সিদ্ধান্ত ইজ সিদ্ধান্ত। কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যে একটা বড় অংশই তৃণমূলের সঙ্গে জোট চায়, সেই অংশ যাঁরা লোকসভার নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না, হলেও জিতবেন না। সেই অংশের চোখ আগামী বিধানসভার দিকে, তাঁরা জোটপন্থী আর যাঁরা এবারেই নির্বাচনে দাঁড়াতে চান, জিতব বলে মনে করেন, মনে করেন বামেদের ভোটটা পেলেই দিল্লির রাস্তা পাকা তাঁরা দলের মধ্যে জোট বিরোধী এবং সেই সমর্থন বা বিরোধিতা লুকিয়ে ছুপিয়েও নয়। অধীর চৌধুরী জানেন তৃণমূলের সঙ্গে জোট হলে ওনার জেতার চান্স আরও কমবে, মানে ভেতর থেকেই কলকাঠি নেড়ে তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হবে এটা ওনার বিশ্বাস। তার থেকে বরং ভালো বামেদের সঙ্গে জোট, সেখানে জিতলেও জিতে যেতে পারেন, তো সেই বহরমপুরের কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী গতকাল বলেছেন, বাংলায় কেউ কেউ গাঁয়ে মানে না আপনিই মোড়ল হওয়ার চেষ্টা করছেন। বলাই বাহুল্য যে এই বিশেষণ মমতা ব্যানার্জির জন্যই রেখেছেন। তা সত্ত্বেও কংগ্রেসের মতিগতি ভালো ঠেকছে না সিপিএম-এর, কোথাও যেন বেসুরো, দীপা দাসমুন্সি আপাতত তেলঙ্গানা রাজ্যে কংগ্রেসের অবজার্ভার, মানে রায়গঞ্জ কার? অধীর আগে নাম করেই বলতেন, মমতার নাম করে অজস্র চোখা চোখা বিশেষণ তিনি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এখন নাম উল্লেখ বন্ধ করেছেন। বাংলার অবজার্ভার বদলে যাঁকে আনা হল তিনি দুধেভাতে, মানে দিল্লির ইশারাতেই কাজ করবেন, সর্বোপরি বাংলা কংগ্রেসের জোটপন্থীরা খানিক উজ্জীবিত এবং হাওয়ায় ভাসছে, কং-তৃণমূল জোট হচ্ছেই। সব মিলিয়ে সিপিএম-এর জোট পন্থীরা শঙ্কায় আর দলের মধ্যে পিউরিটান জোট বিরোধী অংশ দিন গুনছেন, কং-তৃণমূল জোট হলে এনারা হাঁক ছাড়বেন। এসব মাথায় রেখেই কমরেড সেলিম বলেছেন, বিজেপি ও তৃণমূলের প্রতি যাঁরা দুর্বলতা দেখাবে তাদের থেকে সহস্র যোজন দূরে আমাদের অবস্থান হবে। উনি নিজেও জানেন সহস্র যোজন দূরেই আছে কেরল সিপিএম, রাজস্থান সিপিএম, এ রাজ্যেও সহস্র যোজন দূরে থাকলেও ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে বের হওয়ার উপায় তাদের নেই। তো যাই হোক এই বাম-কংগ্রেস জোট ভেঙে কং-তৃণমূল জোট হলে সেটাই হবে নতুন বছরে বাংলাতে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ। তৃণমূল কী চায়? যা চায় সেটাই কি মুখে বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? উনি ভালো করেই জানেন কং-তৃণমূল জোট হলে সংখ্যালঘু ভোট আবার উপচে পড়বে ইভিএম-এ, অন্তত ক্ষয়রোধ করা যাবে। অন্যদিকে বেড়ে খেলতে গিয়ে হঠাৎই একলা হয়ে পড়েছেন নওশাদ সিদ্দিকি, ভাই আব্বাস সিদ্দিকির গলাও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। বিজেপির অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট বলছে আইএসএফ লোকসভা নির্বাচনে কোনও ফ্যাক্টরই নয় কাজেই তারাও আর আইএসএফ নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। কাজেই একলা আইএসএফও কিন্তু নির্বাচনের আগে আবার নতুন করে জোটের কথা ভাবতেই পারে। সব মিলিয়ে নতুন বছরে নতুন জোট হচ্ছেই এমনটা বলা যাবে না, হচ্ছে না একথা বলারও সময় আসেনি। আমরা আমাদের দর্শকদের সেটাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, নতুন বছরে এই বাংলায় নতুন কোনও রাজনৈতিক সমীকরণের জন্ম হবে? নতুন কোনও জোট তৈরি হবে বা পুরনো কোনও জোট ভাঙবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
মধ্যভারতে বিহার বাদ দিলে হিন্দি হার্টল্যান্ড উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ইত্যাদি রাজ্যে কী হবে জানা আছে। দক্ষিণে কর্নাটক থেকে তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশে কী হবে তাও জানা। অন্য রাজ্যের মধ্যে পঞ্জাব, অসম আর ওড়িশার ফলাফলও মোটামুটি জানাই আছে। রাজনৈতিক দলের চোখ, পলিটিক্যাল পণ্ডিতদের চোখ পড়ে আছে বাংলায়, বিহারে, মহারাষ্ট্রে। এই তিন রাজ্যে বিজেপিকে ভালো করতেই হবে, অন্যদিকে এই তিন রাজ্যে বিরোধীরা ভালো ফলাফল করলে খেলা ঘুরে যাবে, তাই প্রত্যেকের চোখ পড়ে আছে এই তিন রাজ্যের নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের দিকে।