গত ২০১৯-এর নির্বাচনে বিজেপি ১৮টা আসন পেয়েছিল, কেবল তাই নয় বাকি কয়েকটা আসনে ভালো ভোট পেয়েছিল। এবং সে সবের হিসেবে তখনই বিজেপি বিধানসভার প্রায় ১৫০ আসনে এগিয়ে ছিল আর ২০০ আসনের টার্গেট সামনে রেখে ২০২১-এর নির্বাচনে নেমেছিল। অবকি বার দোশ পার। গরিবের ঘরে রুটি দিয়ে ঝিঙে পোস্ত খেতে খেতে চাণক্য অমিত শাহ জানিয়েছিলেন, অব কি বার দোশ পার, মমতা দিদি কো সবক শিখায়গা বংগাল কি জনতা। তো রেজাল্ট সবার জানা, সেই রেজাল্টের ভিত্তিতে বিজেপি বড়জোর ১১ জন সাংসদকে জিতিয়ে আনতে পারে, কিন্তু তারপরেও বাংলার নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। একদিকে তৃণমূলের বেশ কিছু শীর্ষ নেতারা দুর্নীতির অভিযোগে জেলে, ক্রমাগত সিবিআই আর ইডি হানায় তৃণমূল বিরোধী এক ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে রাজ্যের এলিট মহলে। মিডিয়ার এক বিরাট অংশ যথারীতি সক্রিয়, জেলে আবার যেতে হতে পারে এই ভয়ে কিছু বুড়ো খোকাও সত্যি কথা বলার অজুহাতে রাজ্য সরকার বিরোধী প্রচারে যতটা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন তার কণামাত্র বিরোধিতাও আজকের স্বৈরাচারী বিজেপির, বহুস্বরকে কুপিয়ে কবরে পাঠানো বিজেপির, সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানো বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁরা করছেন না। আপনি বাঁচলে তবে তো বাপের নাম। অন্যধারে এত কিছু করার পরেও এ রাজ্যে অন্তত মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্র মানুষজনের মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের সাহায্য পাওয়া এক বিরাট ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি ব্লক গড়ে উঠেছে যা এখনও মমতার সলিড ভোট ব্যাঙ্ক। এখনও মমতার দোরগোড়াতে ইডি বা সিবিআই গিয়ে পৌঁছতে পারেনি, যা পেরেছিল ভূপেশ বাঘেল বা অশোক গেহলতের কাছে। এখনও বাংলার সেই এলিট মহল মমতা বিরোধী বটে কিন্তু তারা বিজেপির পক্ষে ভোট দেবেন তা কিন্তু নয়। এবং বিজেপির সংগঠনের অবস্থা বোঝা গেছে পঞ্চায়েত ভোটের সময়। কাজেই প্রশ্ন তো উঠেছেই আর সেটাই বিষয় আজকে, বিজেপি ৩৫টা আসনের জন্য লড়াই শুরু করেছে, শেষ কততে হবে?
দক্ষিণবঙ্গ থেকে ক’টা আসন পেতে পারে বিজেপি? বাঁকুড়ার এমপি কেবল নয় তিনি মন্ত্রীমশাইও বটে, সেই তাঁকে ঘরে তালা দিয়ে আটকে রেখেছিল বিজেপির কর্মীরা। পুলিশ গিয়ে ছাড়ায়, একবার নয় তিনি বহুবার হেনস্থা হয়েছে তাঁর দলের কর্মীদের হাতে। তিনি জিতবেন? জিতবেন দিলীপ ঘোষ যাঁর সাংসদ আসনের ৭ জনের মধ্যে মাত্র একজন বিধায়ক জিতেছেন, তাও তাঁর নিজের ইমেজ ভাঙিয়েই জিতেছেন। পুরুলিয়ার আসন পাবে বিজেপি? হুগলি আরামবাগ আবার জিততে পারবে বিজেপি? পঞ্চায়েতের ভোটের রেজাল্ট কী বলছে? আপনি বলতেই পারেন পঞ্চায়েত ভোটের সঙ্গে লোকসভা ভোটের কী সম্পর্ক?
আরও পড়ুন: বাংলায় বিজেপি আসলে মাছ-মাংস খাওয়া ছাড়তে হবে?
অন্য রাজ্যে এই কথা বলা চলে, বাংলাতে না। প্রতিটা এলাকা কার্যত কন্ট্রোল করে ওই পঞ্চায়েতে জিতে আসা প্রধান বা সদস্যরা, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যরা, জেলা পরিষদের হাতে অসীম ডোল বিতরণের ক্ষমতা থেকে বিভিন্ন কন্ট্রাক্ট ইত্যাদির মধুভাণ্ড, এসব দখলে থাকলে চট করে নির্বাচনে অন্যরকম ফলাফল সম্ভব নয়। আমাদের বাংলায় পঞ্চায়েত যাদের হাতে তাদের হারাতে হলে রাজ্য জোড়া হাওয়া চাই, বিরাট ইস্যু চাই। সিপিএম-এর হাত থেকে খেয়াল করুন এমনকী পঞ্চায়েত চলে যেতে শুরু করেছিল ২০১১-র বহু আগে, বেশ কয়েকটা জেলা পরিষদ দখল করেছিল তৃণমূল। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের মতো ইস্যু উঠেছিল, ২০১১-র আগে ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে একগুচ্ছ আসন হারিয়েছিল সিপিএম। তার মানে প্রথমে পঞ্চায়েতে দাঁত বসাতে হবে, লোকসভায় আসন জিততে হবে তারপর বিধানসভাতে বড় ইস্যু নিয়ে জেতার স্বপ্ন দেখতে হবে। কোনটা আছে এখন? লোকসভায় দারুণ ফলাফল করার পরে বিধানসভাতে তার ধারেকাছেও আসতে পারেনি বিজেপি, পঞ্চায়েতে ধরাশায়ী বললেও কম বলা হবে আর আটটা বিধানসভার উপনির্বাচনে কেবল হারেনি, একটা বাদ দিয়ে বাকিগুলোতে তিন নম্বরে আছে। এই অবস্থায় ৩৫টা আসনের স্বপ্ন দেখা এবং দেখানো দুটোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বামনের চাঁদ ধরার ইচ্ছের গল্প। কিন্তু সেটাই সব নয়, জীবনের প্রতি পর্যায়ে একটা লক্ষ্য রাখাটা যেমন ভীষণ জরুরি, তেমনই মাথায় রাখতে হয় সেই লক্ষ্য যেন বাস্তবসম্মত হয়, জীবনের লক্ষ্য লটারিতে কোটি টাকা জেতা হতে পারে না। বিজেপি তার ঝুরঝুরে সংগঠন নিয়ে এক বিশাল টার্গেট সামনে রেখেছে যার বাস্তব ভিত্তি নেই, সে লক্ষ্য তো অর্জন হবেই না উল্টে নির্বাচন শেষ হলে হতাশা নামবে সংগঠনের সর্বাঙ্গে, “কাঁথি তমলুকেই যাদের সর্বশক্তি দিয়ে জেতার চেষ্টা করতে হবে, উত্তরবঙ্গে নিজেদের জেতা আসনের অর্ধেক যাদের হাতছাড়া হতে চলেছে সেই বিজেপি নাকি ৩৫টা আসন জিতবে, এই কথার বাস্তব ভিত্তি কতটা?” এই প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের দর্শকদের, শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
বাংলা বিজেপির এখন তিন ঘোড়া, এক ঘোড়া দক্ষিণবঙ্গে ঘুরছেন, লক্ষ্য কাঁথি আর তমলুক, মানে অন্তত নিজের জায়গাটা ধরে রাখা। অন্য ঘোড়া উত্তরবঙ্গের সুকান্ত মজুমদার, নিজের আসন জিততে পারবেন কি না তা নিয়েই সংশয়ে আছেন। তিন নম্বর ঘোড়া মনমরা দিলীপ ঘোষ, কোনও এক রহস্যময় কারণে তিনি মোদি-শাহের যাবতীয় সমর্থন হারিয়েছেন, তিনি নিজের আসন বাঁচাতে পারবেন এমন আশা কম। আর তিনটে তিনমুখো ঘোড়া নিয়ে বঙ্গ বিজেপির নড়বড়ে সংগঠনের সামনে টার্গেট ২০২৪-এ ৩৫টা আসন। ঢাক্কাইয়া কুট্টি বলল, কইবেন না কত্তা ঘোড়ায় হাসব।