সব মিলিয়ে বাংলার রাজনীতি বেশ জমে উঠেছে। দক্ষিণী ঝঞ্ঝা ইত্যাদির কারণে শীত আসছে না কিন্তু যত দিন এগিয়ে আসছে ততই বেড়ে যাচ্ছে রাজনীতির তাপমান। কুণাল ঘোষ থেকে দিলু ঘোষ প্রত্যেকেই অনর্গল বলছেন, আর রাজনীতির মানুষজন অনর্গল বললে পরে তা খবর হয়, হচ্ছেও। তো আপাতত দুই ঘোষের কিসসা। দুজনেই যাকে বলে তুখোড় বলেন, শুনলে হঠাৎ মনে হবে সে কী রে বাবা এমনটা বলে দিলেন। পরে বোঝা যায় যা বলেছেন তা বলার জন্য ছাপার জন্যই বলেছেন, মুখ ফসকে বলেননি। সিপিএম আমলে এক সুভাষ চক্রবর্তী ছাড়া এরকম বোলনেওয়ালা কম ছিলেন। যদি বা বলে ফেলতেন, তারপরেই না আমি তো অমনটা বলিনি, আমার বক্তব্যকে বিকৃত করা হয়েছে, বুর্জোয়া সংবাদপত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই দুজনের মজা হল যা বলেছেন বলেছেন, এক পাও ফেরত আসার ব্যাপার নেই। দিলু ঘোষ সটান বলে দিলেন বুদ্ধিজীবীদের ছাল ছাড়িয়ে দেব, বললেন তো বললেন, গরুর কুঁজে সোনা আছে বলে ফেললেন। একই রকম সটান বলে দেন কুণাল ঘোষও। উনিই বলেছিলেন সজল ঘোষকে ওরকমভাবে পুলিশ দিয়ে তুলে আনার কোনও মানেই হয় না ইত্যাদি। মদন মিত্রকে নিয়েও একইভাবে মন্তব্য করার ক্ষমতা রাখেন কুণাল, ববি হাকিমের পার্কিং ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন অনায়াসে। সব মিলিয়ে সাংবাদিকদের কাছে এই দুজনেই পলিটিক্যাল স্টোরির উৎস। আপনারা বলতেই পারেন, ওহ লাভলি মদন মিত্র কি কম কিছু? না উনি পলিটিক্যাল নন, ইদানিং খানিক গোপাল ভাঁড়ের রোলে আছেন, নিজেকেই খোরাক করে তুলছেন, এই দুজন কিন্তু সেরকম নন। আবার এঁরা সিপিএম নন, কোথাও কোনও শক্ত বাঁধন নেই, কাজেই এনাদের অনর্গল কিছু কথাই বিষয় আজকে, দিলু ঘোষ আর কুণাল ঘোষের গল্প।
প্রথমে শাসকদলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কথায় আসি। তিনি শুক্রবারে বলেছেন, শনিবারে ভুলেছেন, আমরা তো ভুলিনি। উনি দু’ তিনটে কথা বলেছেন, বলেছেন কারা বিজেপির ভিক্টোরিয়ার সামনে সভা করার অনুমতি দিতে বারণ করলেন, পুলিশ তো আজ্ঞাবাহী মাত্র, দলের যাঁদের বুদ্ধিতে এই সিদ্ধান্ত হল যা আদালত নাকচ করে দিল, শুধু তাই নয়, আদালত বলল এরপরে ২১ জুলাই অনুমতি দেওয়া হবে না ইত্যাদি। কুণাল বললেন যাঁরা এই পরামর্শ সরকারকে, পড়ুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েছেন, তাঁরা সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন। দ্বিতীয় বিষয়টি আরও সরেস। দলের বৈঠকে মঞ্চে অভিষেকের ছবি নেই, কেবল মমতার ছবি, এদিকে মঞ্চ বা ব্যবস্থাপনায় সুব্রত বক্সি।
আরও পড়ুন: Aajke (আজকে)| বদলা নয় বদল, শ্লোগান থেকে সরে আসছে তৃণমূল?
কুণাল ঠিক এই জায়গাটায় হাত দিয়েছেন, একদা অভিষেক শিবির থেকে শত হস্ত দূরে থাকা কুণাল আপাতত অভিষেক শিবিরে এন্ট্রি পেয়েছেন, সেটাকেই আরও শক্তপোক্ত করে নিতে চান। উনি বললেন তৃণমূল হল মমতা এবং অভিষেক। মানে বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট নয়, আরও একজনের পোস্ট আছে তৃণমূলে, বুঝিয়ে দিলেন। এবং সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত যে সঠিক নয়, সেসব সিদ্ধান্তের ফলে দলের মুখপাত্রদের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে তোতলাতে হচ্ছে, সেটাও জানিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, কুণাল ঘোষ ক্রমশ দলের মধ্যে আরেক প্রান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, যাঁকে প্রায় বাদের খাতায় রাখা হয়েছিল, এটা তাঁর কামব্যাক। অন্যদিকে দিলু ঘোষ, প্রায় বাদই পড়ে গেছেন, বলাও বন্ধ করেছিলেন কিন্তু অক্সিজেনটা কোত্থেকে এল জানা নেই, দেখা যাচ্ছে উনি আবার বাঙ্ময় হয়ে উঠেছেন। মহুয়া মৈত্রের লিপস্টিক, শখের ব্যাগের দাম নিয়ে কথা বলছেন ঘোষিত বালব্রহ্মচারী দিলু ঘোষ। কিন্তু সেসব বহু কথাবার্তার মাঝেই থাকছে দু’ একটা চোরা গুগলি, গিয়ে লাগছে দলের আর দুই মাথা শুভেন্দু অধিকারী আর সুকান্ত মজুমদারের গায়ে। মধ্যের নীরবতা ভেঙে ওনার এই উঠে আসা বোঝায় কোনও এক পক্ষ থেকে অক্সিজেনের জোগান শুরু হয়েছে। সেই পক্ষটিকে চিহ্নিত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন দলের বাকিরা। আমরা আমদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, তৃণমূলের কুণাল ঘোষ আর বিজেপির দিলু ঘোষ অনায়াসে দলের কিছু নেতাদের সমালোচনা করেন, প্রকাশ্যেই করেন এবং সেই সমালোচনা থেকে পিছু হঠেন না। কুণাল বলে দিলেন, দলের কিছু লোক সরকারকে ভুল পরামর্শ দিচ্ছেন, দিলু ঘোষ বললেন দলের কিছু নেতার পায়ের তলায় মাটিই নেই। সাধারণ মানুষ এই কথাগুলোকে কেমনভাবে নেন? শুনুন কী বলছেন মানুষজন।
মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে আলোচনার মধ্যে থাকা, নিজেদেরকে প্রাসঙ্গিক রাখা, মিডিয়াকেই কাজে লাগিয়ে নিজের দলের এক অংশকে চাপে রাখা, শিবির বদল করা, নিজের শিবির তৈরি করা, ওই মিডিয়াকেই ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে সাকার করা এসব নতুন কিছু নয়। ভারত জুড়ে এমনটার বহু বহু উদাহরণ আছে। কিন্তু এ বাংলায় তেমনটা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পরে তেমনটা আর হয়নি। সিপিএম আমলে মিডিয়া আর দল ছিল এক অঘোষিত শত্রু। একেবারে শেষের দিকে অনিল বিশ্বাস মিডিয়াকে খানিক কাজে লাগিয়েছিলেন, বা সিপিএম বুঝেছিল মিডিয়াকে কাজে লাগাতে হবে কিন্তু তাদের পরিকল্পনা তৈরির আগেই গঙ্গাযাত্রা হয়ে গেছে। এই জমানায় বিজেপির দিলু ঘোষ আর তৃণমুলের কুণাল ঘোষ কিন্তু সেই দায়িত্ব কেবল নিয়েছেন বললে ভুল বলা হবে, তুখোড়ভাবেই হ্যান্ডল করছেন বলাটাই বোধহয় সঠিক।